পুরুষের সঙ্গে সমানতালে এগিয়ে যাচ্ছে দেশের নারী পুলিশ। এরই মধ্যে আসীন হয়েছেন বাহিনীটির বিভিন্ন উচ্চপদে। নেতৃত্ব দিচ্ছেন বেশ কয়েকটি ইউনিটের। বোমা ফাটার শব্দ কিংবা অস্ত্রের ঝনঝনানিতেও তারা অকুতোভয়। কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোতে অংশ নিচ্ছেন জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনে। সেখানেও দারুণ সফল তারা। পর্যায়ক্রমে বাড়ছে অংশগ্রহণ। উজ্জ্বল করছেন দেশের ভাবমূর্তি।
Advertisement
বাংলাদেশ পুলিশে নারীর অগ্রযাত্রা শুরু হয় ১৯৭৪ সালে মাত্র ১৪ সদস্য নিয়ে। বর্তমানে পুলিশের সব ইউনিট মিলে কাজ করছেন ১৫ হাজারেরও বেশি নারী। চ্যালেঞ্জ নিয়ে তারা এগিয়ে যাচ্ছেন পুরুষ সহকর্মীদের সঙ্গে। থানা থেকে ট্রাফিক, কন্ট্রোলরুম থেকে মাঠের অপরাধ দমন ও নিরাপত্তা- সবখানেই তাদের পদচারণা। পিছিয়ে নেই জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনেও।
অনেক প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করেই পুলিশের নারী সদস্যরা আজকের এই অবস্থানে। ১৯৭৪ সালে নিয়োগ পাওয়ার পর প্রায় দুই বছর পর্যন্ত পুলিশের নারী সদস্যদের জন্য কোনো নির্ধারিত ইউনিফর্মই ছিল না। ১৯৭৬ সালে বাহিনীটি তাদের নারী সদস্যদের জন্য ইউনিফর্মের ব্যবস্থা করে। ১৯৮৬ সালে প্রথম সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) পদে ফাতেমা বেগমের যোগদানের মাধ্যমে বাংলাদেশ পুলিশে উচ্চপর্যায়ে (বিসিএস) শুরু হয় নারীদের নিয়োগ।
এখন পুলিশ সদর দপ্তর থেকে শুরু করে পুলিশের সব ইউনিটেই নারী সদস্যরা কাজ করছেন। কয়েকটি ইউনিটের নেতৃত্বেও আছেন নারীরা। সারাদেশের আটটি ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার এবং ডিএমপির উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন পরিচালনা করছেন নারী সদস্যরাই। সার্কেল এসপি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন অনেকে।
Advertisement
বাংলাদেশ পুলিশ উইমেন নেটওয়ার্কের তথ্যমতে, বর্তমানে বাংলাদেশ পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে কর্মরত মোট নারীর সংখ্যা ১৫ হাজার ২৩৯, যা বাংলাদেশ পুলিশের মোট জনবলের ৮ দশমিক ০২ শতাংশ।
১৯৮৯ সাল থেকে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অন্যান্য বাহিনীর পাশাপাশি অংশ নিচ্ছে বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যরাও। নারী পুলিশ সদস্যরা এ কার্যক্রমে যোগ দেন ২০০০ সালে।
বাংলাদেশ পুলিশ উইমেন নেটওয়ার্ক (বিপিডব্লিউএন) সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন সম্পন্ন করেছেন এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৬২১ নারী পুলিশ সদস্য। বর্তমানে ১৪৪ জন জাতিসংঘ মিশনে বিভিন্ন দেশে দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলাদেশের নারীরা কাজ করছেন দারফুর, মালি, ডিআর কঙ্গো, দক্ষিণ সুদান ও জাতিসংঘ সদর দপ্তরসহ জাতিসংঘের তিনটি শান্তিরক্ষা অপারেশনে। এছাড়া লিঙ্গ সমস্যা, নারী ও শিশু বিষয়ক ক্ষেত্রে জাতিসংঘের নির্দেশনা বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশ পুলিশ কঙ্গোতে একজন নারী কর্মকর্তাকে পাঠিয়েছে।
চলতি বছরের ২ জানুয়ারি জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে অংশ নিতে ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোর রাজধানী কিনশাসায় গেছেন বাংলাদেশ পুলিশের ১৮০ সদস্যের নারী ফর্মড পুলিশ ইউনিট (এফপিইউ)।
Advertisement
বিপিডব্লিউএন জানায়, যুদ্ধ থেকে শান্তিতে রূপান্তরে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে নারী পুলিশ কর্মকর্তাদের অবদান অনস্বীকার্য। বাংলাদেশের নারী শান্তিরক্ষীরা লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা, সংঘাত ও সংঘর্ষ কমাতে, বিশেষ করে নারী ও শিশুদের জন্য নিরাপত্তা, স্থানীয় এলাকায় নারী পুলিশ কর্মকর্তাদের পরামর্শ দিয়ে চলেছে। এভাবে সংশ্লিষ্ট দেশে নারীর ক্ষমতায়ন ও সামাজিক উন্নয়নে নিজেদের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছেন নারীরা।
দেশের নারী পুলিশ সদস্যরা মিশনের কমিউনিটিতে রোল মডেল হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ফলে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশ নারী পুলিশ কর্মকর্তার চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) মো. কামরুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, পুলিশের সব ইউনিটে কাজ করছেন ১৫ হাজারেরও বেশি নারী পুলিশ সদস্য। চ্যালেঞ্জ নিয়ে তারা এগিয়ে যাচ্ছেন পুরুষ সদস্যদের সঙ্গে সমানতালে। যোগ্যতা ও সুযোগ অনুযায়ী বড়, গুরুত্বপূর্ণ পদেও দায়িত্ব সামলাচ্ছেন তারা। শুধু তাই নয়, দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনেও উজ্জ্বল ভূমিকায় নারী পুলিশ সদস্যরা। পুরুষ সদস্যদের মতোই তারা সমানতালে, সমান চ্যালেঞ্জে এগিয়ে যাচ্ছেন। পুলিশে নারীরা পেয়েছেন অভাবনীয় সাফল্য। মিলেছে স্বীকৃতিও। আইজিপি হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ড. বেনজীর আহমেদ সঠিক দিকনির্দেশনা দিয়ে নারী ও শিশুবান্ধব পুলিশিংয়ে জোর দেন। নারী পুলিশের বিভিন্ন সমস্যা সমাধান, নেতৃত্ব ও দক্ষতা বাড়ানোর লক্ষ্যে আইজিপির উদ্যোগগুলো বাস্তবায়নের পথে।
তিনি বলেন, ১৯৮৯ সাল থেকে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ করছে বাংলাদেশ পুলিশ। বিগত তিন দশকে শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ পুলিশের পেশাদারত্ব ও কর্মদক্ষতা আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসা অর্জন করেছে। ২০০৫ সাল থেকে শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ পুলিশের ফর্মড পুলিশ ইউনিট পাঠানো হয়। এরপর ২০১১ সাল থেকে কঙ্গোতে নারী ফর্মড পুলিশ ইউনিট পাঠানো হচ্ছে। ২০১৯ সাল থেকে বাংলাদেশ পুলিশের কর্মকর্তারা মিশনটিতে সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন।
এআইজি কামরুজ্জামান আরও বলেন, কোভিড-১৯ অতিমারির বৈশ্বিক সংকটময় পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যরা কঙ্গো, মালি, দক্ষিণ সুদানে শান্তিরক্ষা মিশনে দায়িত্ব পালন করছেন।
জানতে চাইলে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) ও বাংলাদেশ পুলিশ উইমেন নেটওয়ার্কের সভাপতি আমেনা বেগম জাগো নিউজকে বলেন, ২০০৬ সালে আমি যখন জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে যাই তখন ১৪০ জনের টিমে আমিই একমাত্র নারী কর্মকর্তা (সেকেন্ড ইন কমান্ড) ছিলাম। মিশনে যাওয়ার পর আমার কমান্ডো অফিসারসহ অন্য পুরুষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে একটি রুমে থাকতাম। তবে আমার বেডটি কার্টন দিয়ে একটি পার্টিশন করে দেওয়া হয়েছিল। সেখানে একই বাথরুম আমরা শেয়ার করেছি। মিশনে যারা ছিলেন সবাই আমার ভাইয়ের মতো। প্রথমত আমি যখন দায়িত্ব পালন করতে যাই তখন আমি মনে করি না নারী কিংবা পুরুষ। দ্বিতীয়ত আমি দায়িত্ব পালন করি ‘বাই রুলস অ্যান্ড রেগুলেশন’ অনুযায়ী।
তিনি বলেন, মিশনে গিয়ে অনেক সময় হোটেল কিংবা অর্ডার দিয়ে খাবার পাওয়া যাবে না। অথবা যখন আগুন, পানি ও গ্যাস পাওয়া যাবে না তখনো আপনাকে টিকে থাকতে হবে। জাতিসংঘ আমাদের জন্য একটি খাবার দেয়। সেটাকে বলা হয় মিল রেডি টু ইট (এমআরই)। এই খাবারটা খেয়েই হয়তো ৭-৮ দিন পর্যন্ত টিকে থাকতে হতে পারে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে যাওয়ার আগে টাঙ্গাইল পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারে একটি ট্রেনিং কোর্স করানো হয়। বাছাই প্রক্রিয়ায় যাদের নাম আসে ও চূড়ান্ত মনোনীত হন তাদের প্রশিক্ষণকেন্দ্রে পাঠানো হয়।
বাংলাদেশ পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (পাসপোর্ট) বিশেষ পুলিশ সুপার ফরিদা ইয়াসমিন জাগো নিউজকে বলেন, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনেও নারী সদস্যদের সংখ্যাটাও বেড়েছে। এটি নিঃসন্দেহে পজিটিভ একটি বিষয়। জাতিসংঘে ২০০০ সাল থেকে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের কাজের সুযোগ হয়। এরপর ২০১০ সাল থেকে সম্পূর্ণ কন্টিনেন্টে বাংলাদেশ পুলিশের নারী সদস্যরা জাতিসংঘে যাওয়া শুরু করেন। জাতিসংঘ মিশনে কাজ করতে গেলে ভাষাগত সমস্যা, আবহাওয়া, আলাদা সংস্কৃতি ও আলাদা পরিবেশের চ্যালেঞ্জ থাকে। এর মধ্যেও আমাদের মানিয়ে নিয়ে কাজ করতে হয়। নিজের দেশের পতাকার মান অক্ষুণ্ন রাখতে মর্যাদার সঙ্গে জাতিসংঘে আমাদের দেশের নারীরা কাজ করে চলেছেন।
টিটি/এএ/জিকেএস