মতামত

কন্যা সন্তানে বিনিয়োগ, লাভ না লসের হিসাব?

আমি জানি আমার এই হেডলাইন দেখে অনেকেই আঁতকে উঠবেন। অবাক হবেন। বিশেষ করে নারীবাদীরা হয়তো ভাবতে শুরু করবেন নারীরা কি পণ্য যে তার হিসাব লাভ বা লোকসানে করা লাগবে?

Advertisement

তারপরও আমি আজকের আলোচনাটা এই হিসাবের লাইন ধরেই করতে চাই। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে নিয়ম করে লেখি আমরা। গতানুগতিক নারীর ক্ষমতায়ন, নারী স্বাধীনতা ইত্যাদি নিয়ে লেখি। কেন? কারণ আমরা চাই, সমাজে নারীরা যেন তাদের যোগ্য স্থানটি পায়। তারা যেন তাদের যোগ্যতার স্বীকৃতিটুকু পায়। সম্পত্তিতে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা নারীর আর্থিক স্বাধীনতার সাথে সরাসরি জড়িত। অতি সম্প্রতি হিন্দু নারীদেরও সম্পত্তিতে অধিকারের ইস্যুটি আলোচনায় এসেছে। অর্থাৎ, নারীদের অধিকারের হিসাবটি আলোর মুখ দেখতে পাচ্ছে।

এবার আসি মূল আলোচনায়। সমাজে এই যে পুত্র সন্তান ও কন্যা সন্তানের মধ্যে পার্থক্য করা হয় এর পিছনে কারণটা সম্পর্কে কি আমরা পরিষ্কার? কারণ একটা সময় কিন্তু নারীদেরই জয়কয়কার ছিলো। তারাই ছিলো ড্রাইভিং সিটে। সমস্ত সিদ্ধান্ত নিতো নারীরা। তাহলে কেমন করে ধীরে ধীরে পুরুষরা সেই জায়গাটা দখল করে নিলো?

আমি সেই একাডেমিক আলোচনায় যাচ্ছিনা। তবে যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে অর্থনীতিতে দখলদারিত্বের যে বিষয়টা সামনে চলে এসেছে সেখানে নারীরা নেই। তাদের সকল ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করেছে পুরুষরা। নারীরা হয়ে গেলো নির্ভরশীল একটি গোষ্ঠী। পরিবার প্রথার প্রচলনের ইতিহাসেও কিন্তু নারীর এই পিছিয়ে যাওয়ার গল্পটি পরিষ্কার। সমাজ তাকেই কদর করে যার ক্ষমতা আছে। যে অন্যকে কিছু দিতে পারবে। পরনির্ভরশীল কোন ব্যক্তিকে কেউ আদর যত্ন করেনা। আর এটাই হচ্ছে পরিবারে ছেলে শিশু আর কন্যা শিশুর মধ্যে পার্থক্য করার কারণ।

Advertisement

ঐতিহাসিক কারণেই নারীরা হয়ে গেছে অন্যের দ্বারস্থ। শুনতে খারাপ লাগলেও সামর্থহীনের পাশে পরিবারও দাঁড়ায়না। আরেকজন এনে দিলে সে খাবে, পরবে, শিখবে। আমাদের পরিবারগুলো তাই মনে করে ছেলে হচ্ছে তার বংশের আলো। তার পিছনে খরচ করলে একটা সময়ে গিয়ে সে পরিবারের দায়িত্ব নিবে। হাল ধরবে। পিতামাতারা মনে করে বয়স্ক হয়ে গেলে একমাত্র পুত্রই তাদেরকে দেখাশুনা করবে।

মেয়েরা হচ্ছে দুইদিনের মেহমান। তারা পরের বাড়ী চলে যাবে এটাই নিয়ম আর সেখানে থেকে সে পরিবারের দায়িত্ব নিতে পারবে সে আশা করার কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নাই। এইসব হিসাব নিকাশ আমাদের পরিবারগুলোকে বিভক্ত করে রাখে।

পুত্র সন্তানকে মাছের মাথা, বড় টুকরা দেয়া হয়। মুরগীর রান তোলা থাকে তাদের জন্য। মানে খাবারের পুষ্টির বিষয়টা কেবল পুত্র সন্তানের জন্যই দরকার। এসব চিন্তার কথা কিন্তু এমনে এমনেই আসেনি। এসেছে সেই যে বিনিয়োগ ধারণা এবং জীবনের এক পর্যায়ে গিয়ে তার প্রতিদানের আশা তার থেকেই।

অর্থাৎ, যেখানে লাভ নাই সেখানে বিনিয়োগ কম করাই শ্রেয়। আমি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে শিখেছি যে পুত্রের আশায় আমাকে জন্ম দিয়েছিল আমার পিতামতা এবং এ নিয়ে আমার অভিজ্ঞতা কোন অংশেই সুখকর নয়। কেবল একজন পুত্র সন্তানের লোভে অনেক পিতামাতাই বছরে বছরে সন্তান নেয়। একাধিক বিয়ের ঘটনা ঘটে।

Advertisement

এমন চিত্রের কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু তার পুরোটাই এসেছে শহর কেন্দ্রিক। প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনও কন্যা শিশুকে দেখা হয় পরিবারের বোঝা হিসাবে। এর প্রমাণ কিন্তু করোনাকালে বাল্য বিয়ের হার বৃদ্ধির ঘটনা। মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার হার কমে যাওয়ার ঘটনা।

একটা বিষয় একদম পরিষ্কার হয়ে গেছে যে নারীর এই যে অগ্রগতি এসেছে আমাদের দেশে, এর গোটাটাই মানসিক পরিবর্তন আনতে পারেনি। নারীর প্রতি যে প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি সেখানে খুব একটা পরিবর্তন আসেনি। পরিবারে তার কন্যাকে যখন উচ্চশিক্ষা বা কর্মসূত্রে বাইরে পাঠায় তার পিছনেও রয়ে গেছে আর্থিক হিসাবের ইস্যুটা।

মেয়েটা আয় করলে পরিবারেও কিছুটা দিতে পারবে এই ধারণাই এখনও শক্তিশালী। একজন কর্মজীবী নারী হিসাবে অনেকসময় এমন কথাও শুনি যে নারীরা বড় পদে ঠিক মানানসই না। এখনও কাজের ধরন অনুযায়ী নারী পুরুষের পার্থক্য করা হয়। তবে একথাও কেউ কেউ স্বীকার করেন যে, নারীরা ধৈর্যশীল। তাদের মধ্যে সততা পুরুষের চেয়ে বেশি। তারা ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করতে পারে এবং এরা নিষ্ঠাবান হয়।

আমি এই আলাপটিকে ইতিবাচক অর্থেই নিতে চাই। সত্যিকার অর্থেই কর্পোরেট জগতে এখনও পর্যন্ত নারীরা লড়াই করেই এগিয়ে আসছে বা টিকে থাকছে। সেখানে যতটুকু সুযোগ সে পায় তার সবটাই তাকে প্রমাণ করেই অর্জন করতে হয়।

কেউ অবলীলায় দিয়ে দেয়না। নারীরা দায়িত্ববান এই কথাটি আসলেই সত্য। একটি পরিবারে পিতামাতার দায়িত্ব নেয়ার প্রশ্নে সবচেয়ে এগিয়ে থাকে মেয়েরা। তারা হয়তো সামর্থবান হয় না কিন্তু পিতামাতার প্রতি সামর্থ অনুযায়ী দায়িত্ব পালনে কোনদিনও পিছপা হয় না। এখনও পর্যন্ত এমন কোন উদাহরণ তৈরি হয়নি যেখানে সম্পত্তির জন্য পিতামাতাকে অস্বীকার করেছে কোন মেয়ে। কিন্তু পুরুষের বেলায় এমন উদাহরণ প্রচুর।

লেখক: অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, কলামিস্ট।

এইচআর/জিকেএস