বিশেষ প্রতিবেদন

শত বাধা পেরিয়ে ই-কমার্সেও সফল নারী

সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে উঠছে গোটা বিশ্ব। সবকিছুই এখন অনলাইনকেন্দ্রিক। কোনো জিনিস কেনা, বিক্রি করা কিংবা কোনো সেবা নেওয়া- সবই হাতের মুঠোয়। মহামারি করোনাভাইরাস আরও বেশি বিস্তার ঘটিয়েছে অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোর। বাড়িয়েছে মানুষের অনলাইন নির্ভরতা। বাংলাদেশেও দ্রুত বিস্তার ঘটছে ই-কমার্সের। বিশেষ করে করোনাকালে এ খাতে এসেছে যুগান্তকারী পরিবর্তন। এই সময়ে বেড়েছে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যাও। এতে খাতটি হয়েছে আরও সমৃদ্ধ।

Advertisement

তবে গত বছরের শেষ দিকে ইভ্যালিসহ কয়েকটি বড় অনলাইন প্ল্যাটফর্মে বিশৃঙ্খলার কারণে বড় ধাক্কা আসে এ খাতে। ফলে শৃঙ্খলা ফেরাতে চলতি বছর ইউনিক বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন (ইউবিআইডি) চালু করে সরকার। প্রথম ধাপে নিবন্ধন পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশের স্বত্বাধিকারী নারী।

নারী উদ্যোক্তারা বলছেন, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও অনেক এগিয়ে যাচ্ছে। শত বাধা পেরিয়ে ই-কমার্সের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হচ্ছেন অনেক নারী। তবে দেশের পাইকারি বাজার ও পণ্য কেনার স্থানগুলো নারীবান্ধব না হওয়ায় সমস্যায় পড়তে হচ্ছে উদ্যোক্তাদের। তাদের আশা, সামনের দিনে এই পরিস্থিতি আরও ভালো হবে।

তেমনই একজন নারী উদ্যোক্তা মুসফেরা জাহান। তিনি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ‘মম ফানুস’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও ‘গেরস্ত বাড়ি’র চেয়ারম্যান। প্রথম ধাপে ইউনিক বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন পায় তার প্রতিষ্ঠান।

Advertisement

মুসফেরা জাহান জাগো নিউজকে বলেন, ‘মম ফানুস’ মূলত বুটিক্স আইটেম, হ্যান্ড পেইন্ট, ব্লক ও হাতের কাজের পণ্য বিক্রি করে। ‘গেরস্ত বাড়ি’তে পাওয়া যায় গুঁড়া ও রেডি মসলা।

নিজের ব্যবসা শুরুর বিষয়ে এই উদ্যোক্তা বলেন, ‘আমি ২০১৭ সালে অনলাইনে ব্যবসা শুরু করি। প্রথমদিকে এটি শুধু অনলাইনভিত্তিক ছিল। তখন সাপোর্ট ছিল পরিবারের। আমাকে সবদিক থেকে সহযোগিতা করেছে। এখন অনলাইনের পাশাপাশি অফলাইনেও কাজ করি, এই পরিসরটা আমি বড় করতে পেরেছি পরিবারের সমর্থন থাকায়।’

ই-কমার্স নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করে তিনি বলেন, ই-কমার্স এখন ভালো করছে। আগামীতেও ভালো করবে। এটা বর্তমান অবস্থা দেখেই বলছি। কারণ করোনার সময় মানুষ অনলাইন কেনাকাটায় নির্ভরশীল হয়ে গিয়েছিল। এছাড়া এখন কর্মজীবী নারীর সংখ্যা বেশি। শপিংয়ে গিয়ে কেনাকাটা করার মতো সময় অনেকের নেই। তাই ই-কমার্সেই তারা বেশি নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে। একসময় পত্রিকার পাতা উল্টাতে উল্টাতে চা খেতাম, কিন্তু এখন অনলাইনেই খবর পড়ি। এটা একটা বড় কারণ।

‘মম ফানুস’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ‘গেরস্ত বাড়ি’র চেয়ারম্যান মুসফেরা জাহান

Advertisement

নারী উদ্যোক্তা হওয়ায় কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে কি না জানতে চাইলে মুসফেরা বলেন, সমস্যা কিছুটা তো রয়েছে। আমাদের ব্যবসাগুলো অনলাইনকেন্দ্রিক হলেও সোর্সিং তো অফলাইনে করতে হয়। আমার শুরুটা পোশাক নিয়ে। এখন গুঁড়া মসলার জন্য আলাদা প্রতিষ্ঠান করেছি। আমার কিন্তু নিজে দেখে, যাচাই করে কাপড় আনতে হয়। সেজন্য আমাকে যেতে হয় টাঙ্গাইল, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায়। পুরুষ হলে এক্ষেত্রে সমস্যা হতো না। কিন্তু যেহেতু আমি নারী, আমাকে কোথাও গেলে অনেক বিবেচনা করে যেতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে নিরাপত্তার ব্যাপার থাকে। ফলে আরেকজনের সহায়তা নিতে হয়, এটা বড় সমস্যা।

আরেক নারী উদ্যোক্তা হলেন ‘নিথানবিডি’র স্বত্বাধিকারী ফারাহ দিবা। তিনি কাজ করেন মেয়েদের পোশাক, ছেলেদের পাঞ্জাবি, বেবি ড্রেস, ফ্যাশন এক্সেসরিজ ও হোম ডেকর (ঘর সাজানোর সামগ্রী) নিয়ে।

তিনি জাগো নিউজকে বলেন, শুরু থেকেই অনেক জায়গায় বলেছি ‘নারী উদ্যোক্তা’ শব্দটায় আমার আপত্তি আছে। উদ্যোক্তার শুধু উদ্যোক্তাই হওয়া উচিত। পুরুষরা উদ্যোক্তা হলে শুধু উদ্যোক্তাই বলা হয়। যতদিন পর্যন্ত এই ক্লাসিফিকেশনটা থেকে যাবে, ততদিন এটি বড় সমস্যা।

ফারাহ দিবা বলেন, প্রতিটা মেয়ের গল্প অনেকটা একই রকম। তাদের নানা বাধার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। স্বতন্ত্রভাবে ব্যবসা শুরু করা, নতুন কিছু নিয়ে উদ্যোগ নিয়ে তা পরিচালনা করা একটা স্ট্রাগল। বেশিরভাগ নারী উদ্যোক্তা মধ্য বয়সে এসে ব্যবসা শুরু করে। কিন্তু এখন আশার কথা হচ্ছে, শিক্ষাজীবন থেকেই উদ্যোক্তা হতে শুরু করেছে মেয়েরা।

নিথানবিডি’র স্বত্বাধিকারী ফারাহ দিবা ইউনিক বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন (ইউবিআইডি) নিচ্ছেন

পণ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে নারীদের সমস্যার মুখে পড়তে হয় উল্লেখ করে এই উদ্যোক্তা বলেন, অনেক নারী আছে, যারা সোর্সিং থেকে শুরু করে কোনো কিছুতেই হেল্প পায় না। এটা বড় সমস্যা। ব্যক্তিগতভাবে আমি আমার মা, স্বামী, মেয়ে- সবার সাপোর্ট পেয়েছি। আমি সোর্সিংয়ের জন্য যতবার গেছি আমার স্বামী সঙ্গে থেকেছে। আমাদের দেশের পাইকারি মার্কেটগুলো নারীবান্ধব নয়। কাঁচামাল সংগ্রহের মূল জায়গাগুলো নারীবান্ধব নয়। আমি সেজন্য কখনো একা যাইনি। নারীদের কিছু বিষয় না বলা থেকে যায়।

ভবিষ্যতে ই-কমার্স নিয়ে কতটা আশাবাদী জানতে চাইলে দিবা বলেন, ‘আমি প্রচণ্ড আশাবাদী। ই-কমার্স একটা বিশাল ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। এটা সময়ের দাবি। আমি ২০১৮ সালে ব্যবসা শুরু করি। ২০১৯ সালে পুরোদমে মার্কেটে যুক্ত হলাম।’

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেলের প্রধান এ এইচ এম সফিকুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ফেসবুককেন্দ্রিক ব্যবসায় নারীরাই বেশি কাজ করছে। ‘উই’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান আছে তারা তো নারীদের নিয়েই কাজ করছে। ই-কমার্সে কোনো বাধা নেই নারীদের। কিন্তু জেনারেল যে সামাজিক বাধা সেটা রয়েছে।

ই-কমার্সে সামনে নারী উদ্যোক্তাদের সম্ভাবনা কতটুকু জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে আস্থার জায়গা ফিরলে ও ইউনিক আইডেন্টিফিকেশন করে নারীরা যদি ব্যবসা করতে পারে তাহলে তো অসুবিধা নেই। কিন্তু বিভিন্ন পেজে ড্রেস দেখিয়ে যে ভিডিও আপলোড করে, সেখানে কিন্তু এখনো আস্থার জায়গা ফিরে আসেনি। নারীরা যেমন হ্যান্ডমেড প্রোডাক্ট বিক্রি করে, সেখানে কিন্তু অনেকক্ষেত্রে প্রতারণাও আছে। মানুষ কিন্তু আস্থা পায় না। তাই আস্থা ফেরাতে বিশ্বাসটা তৈরি করা জরুরি। আশাকরি সামনের দিনগুলোতে নারী উদ্যোক্তারা আরও ভালো করবেন।

আইএইচআর/জেডএইচ/এএ/জেআইএম