সকালে ঘুম থেকে উঠে ফেসবুক ঘাঁটাঘাঁটিটা ইদানীং আরও অনেকের মতো আমারও নিউ নরমাল অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। অভ্যাসবশে ফেসবুক ঘাঁটতে গিয়ে চোখে পড়লো ছবিটা। একাত্তরে গাইবান্ধামুক্ত হওয়ার পর সেখানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর স্থাপনায় পাওয়া গিয়েছিল একটা নেগেটিভের রিল। আর সেটি ডেভেলপ করে পাওয়া ছবিগুলোর একটি ফেসবুকের কল্যাণে এখন আমার মোবাইলের মেমোরিতে।
Advertisement
ছবিতে দেখা যাচ্ছে একজন পাকিস্তানি সেনা টার্গেট প্র্যাকটিস করছে। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বন্ধুকটা হাতে নিয়ে সে গুলি ছুড়ছে টার্গেটে। একজন সেনার এমন একটি ছবি ফেসবুকে আসার কোনো কারণ থাকতে পারে না, আর আসলেও ফেসবুক থেকে আমার মোবাইলের মেমোরিতে ঢুকে পড়ার কোনো সঙ্গত কারণ থাকার কথা নয়।
আর যদি এসেও পড়ে তবে তা জনকণ্ঠের মতো প্রতিষ্ঠিত একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিতব্য কোনো কলামের উদ্ভোধনী প্যারাগ্রাফে অতি অবশ্যই স্থান করে নিতে পারে না। ছবিটি নিয়ে এত কথা বলার উদ্দেশ্য একটাই- ছবিটি এক কথায় একাত্তরের বাংলাদেশ! পাক সেনাটির টার্গেট প্র্যাক্টিসের লক্ষ্যবস্তু দুই হাত উপরে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা ত্রিশ লাখের মধ্যে কোনো একজন নাম না জানা বাঙালি শহীদ।
দুই.মার্চ মানেই বাংলাদেশ। ১২ মাসে তের পার্বনের এই দেশে প্রতিটি মাসেই এমন কিছু না কিছু ঘটনা আছে, যা জাতি রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের সৃজন আর জাতি হিসেবে বাঙালির বিকাশকে প্রভাবিত করেছে। এর মধ্যেও মার্চ ব্যতিক্রম, কারণ মার্চে এমন চারটি তারিখ আছে যেগুলোর কোনো একটি আমাদের ক্যালেন্ডার থেকে হারিয়ে গেলে হয় বাংলাদেশের জন্মই হতো না, আর হলেও সেই বাংলাদেশ হতো জেনেটিক্যালি ডিফর্মড একটি রাষ্ট্র কাঠামো। মার্চের ১৭-তে জাতির পিতার জন্মদিন। বলাইবাহুল্য বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা থেকে রূপকার, এসব কিছুই এই মহামানব আর বাংলাদেশটার তার অতিমানবীয় অবদান। ’৪৮-এ মার্চের ১১-তে স্বাধীন পাকিস্তানে প্রথমবারের মতো কারাবরণ করেছিলেন জাতির জনক ভাষা আন্দোলনেও নেতৃত্ব দিতে গিয়ে, যেখান থেকে শুরু স্বাধীন বাংলাদেশের অভিযাত্রা।
Advertisement
আর মার্চের ৭ তারিখে সেদিনের রেসকোর্সে বঙ্গবন্ধুর যে অবিস্মরণীয় ভাষণ, তা শুধু বিশ্ব মানবের ঐতিজ্যেরই অংশ নয়, তা বাঙালির মুক্তির সনদও, বাঙালির ম্যাগনাকার্টা। ২৫ মার্চের কালো রাতে ঢাকাসহ সারাদেশে রক্তের হলিখেলায় মেতে উঠেছিল পাক সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চলাইটের নামে। রাজারবাগ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পিলখানা- বাঙালি পুলিশ, ছাত্র-জনতা আর সিপাহির রক্তের মিলিত স্রোতধারায় সেদিনই পাকাপাকি হয়েছিল বাঙালির সাথে পাকিদের স্থায়ী বিচ্ছেদ।
ভবিতব্য নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল সেদিনই, সেই ক্ষণে পাকিস্তান নামক ব্যর্থ রাষ্ট্রটির, যার ধারাবাহিকতায় ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে ইথারে ইথারে ছড়িয়ে পড়েছিল বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার অমোঘ ঘোষণাটি। আমার কাছে মার্চ-ই তাই বাঙালি আর বাংলাদেশের ইতিহাসে সব চাইতে হ্যাপেনিং মাস- আমার কাছে মার্চ-ই বাংলাদেশ। আমার ধারণা আমার মতো আর দশজনও আমার সাথে এ বিষয়টায় একমত পোষণ করবেন।
তিন.বাঙালির ইতিহাসে মার্চের গুরুত্ব যে কতটা প্রবল সে বিষয়ে সব সময়ই সচেতন আমাদের প্রতিপক্ষও। মার্চকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশবিরোধী চক্রান্তগুলোকে আমরা তাই প্রায়শই ইতি-উতি উঁকি দিতে দেখি। গত মার্চেও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মুজিববর্ষ উপলক্ষে বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে তাতানো হয়েছিল রাজপথ। আগুন সন্ত্রাসে ভস্মীভূত হয়েছিল সমৃদ্ধ জনপদ। এবারের মার্চেও থেমে নেই ষড়যন্ত্র আর ষড়যন্ত্রের যত যন্ত্রীরা। মিডিয়ায় এসেছে মার্চে বাংলাদেশ থেকে ইসলামাবাদে মিডিয়া ডেলিগেশন আর ইয়ুথ ডেলিগেশন পাঠানোর চেষ্টা চালাচ্ছে ঢাকার পাকিস্তান হাইকমিশন। লক্ষটা খুবই পরিষ্কার।
স্বাধীনতার পঞ্চাশে দাঁড়িয়ে বাঙালি যখন তার ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাবে আর সামনে ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে তার বর্তমানকে উদযাপন করবে, তখন তাতে কিছুটা হলেও কালি ঢেলে দেওয়ার আরও একটি চক্রান্ত ছাড়া এই উদ্যোগটি অন্য কিছু নয়। পাকিস্তানফেরত এসব বাংলাস্তানি মিডিয়া ও ইয়ুথ ডেলিগেকরা আমাদের মিডিয়া আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পাকিস্তান বন্দনার তুবরি ছোটাবে, এই নষ্ট উদ্যোগের একমাত্র উদ্দেশ্য এটাই।
Advertisement
ঢাকার পাকিস্তান হাইকমিশনের জন্য এসব অবশ্য নতুন কিছু নয়। ঢাকা আর দিল্লিতে জাল টাকা ছড়িয়ে দুই দেশের অর্থনীতিকে এলোমেলো করার অভিযোগে এর আগে বাংলাদেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে পাকিস্তানি ডিপ্লোমেটদের। জঙ্গি অর্থায়ন থেকে শুরু করে এমনকি একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলার সাথেও সম্পৃক্ততা ছিল ঢাকায় পাকিস্তানের এই অশুভ আস্তানাটির।
চার.১৯৭৬-এ৭ মার্চ বাংলাদেশের ক্ষমতায় ছিলেন জেনারেল জিয়া। একাধারে রাষ্ট্রপতি আর প্রধান সামারিক আইন প্রশাসকের পদ দুটো অবৈধভাবে দখলে রেখেছিলেন তিনি। সে সময় দেশে সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও ’৭৬-এর মার্চের ৭ তারিখে আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় একটা বিশাল ইসলামী জলসার আয়োজন করা হয়েছিল। এতে উপস্থিত ছিলেন জিয়ার উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এয়ার ভাইস মার্শাল তোয়াব আর ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানি ও লিবিয়ার রাষ্ট্রদূতরা। এই জলসায় দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধী দাবি জানিয়েছিল বাংলাদেশের নাম, জাতীয় পতাকা আর জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের। তাতে সম্মতিও দিয়েছিলেন তোয়াব। স্লোগান উঠেছিল, ‘তোয়াব ভাই, তোয়াব ভাই, চাদ-তারা পতাকা চাই’!
পাঁচ.যে জায়গা থেকে এই লেখাটা শুরু বাঙালি আর বাংলাদেশ যাতে সেই জায়গাটায় কখনই ফিরে না যায়, ভুলেও যাতে মনে না করে সেই ইতিহাস, মার্চজুড়েই সেই লক্ষ্যেই মাঠে থাকে একদল ষড়যন্ত্রী আর পেছন থেকে তাদের নেতৃত্ব দেয় পাকিস্তানের শাসক আর প্রশাসনযন্ত্র। এই চক্রটিই আবারো সক্রিয় হবে আগস্টে এবং তারপর আবারও ডিসেম্বরেও। যে মার্চের এতগুলো ঘটনার মধ্যে দিয়ে যেই বাংলাদেশটির জন্ম সেই বাংলাদেশকে যদি তার জন্মের সার্থকতা খুঁজে পেতে চায়, তাহলে মার্চজুড়েই আমাদের বারবার মার্চের কাছেই ফিরে যেতে হবে।
লেখক: ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম