ফুটবলের মত বৈশ্বিক খেলা নয় ক্রিকেট। এই বিশ্বের প্রতিটা কোনায় ফুটবলের বিস্তার। সে তুলনায় অভিজাত ক্রিকেট অনেক বেশি সীমিত। বিশ্বের মাত্র ১০টি দেশ ক্রিকেটের সর্বোচ্চ পর্যায়ে মানে টেস্ট খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে। এই দশ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি। ক্রিকেটের কুলিন জগতে বাংলাদেশ নতুন। তবুও ক্রিকেট বিশ্বে বাংলাদেশের একটা আলাদা অবস্থান আছে। যতটা না পারফরম্যান্সের কারণে, তারচেয়ে বেশি ক্রিকেটের বিপুল জনপ্রিয়তার কারণে।
Advertisement
পাশের দেশ ভারতের মত বাংলাদেশের মত বাংলাদেশের মানুষও ক্রিকেটে খায়, ক্রিকেটে ঘুমায়। ক্রিকেটাররাই আমাদের হিরো। মজার কথা হলো শুধু বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা নয়, অন্য দেশের ক্রিকেটাররাও বাংলাদেশে তারকাখ্যাতি পান। অস্ট্রেলিয়ার কোনো তারকা ক্রিকেটার নিজ দেশে চাইলে রাস্তায় হাঁটতে পারবেন। কিন্তু বাংলাদেশে হাঁটতে গেলে ভিড় জমে যাবে।
বাংলাদেশসহ ক্রিকেট বিশ্বের জন্য শুক্রবার তিনটি ছিল শোকের। সকালে খবর আসে অস্ট্রেলিয়ার কিংবদন্তি উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান রডনি মার্শ মারা গেছেন। তার মৃত্যুটা শোক আনলেও বিস্ময় আনেনি। ৭৪ বছর বয়সী রডনি মার্শ হার্ট অ্যাটাক নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। তার মৃত্যুতে আরো অনেকের মত শোক জানিয়ে টুইট করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার আরেক কিংবদন্তি শেন ওয়ার্ন। কিন্তু সেই টুইট করার মাত্র ১২ ঘণ্টার মধ্যে রডনি মার্শের অনুসারী হলেন শেন ওয়ার্নও। রডনি মার্শের মৃত্যু শুধু শোক নিয়ে এসেছিল। কিন্তু শেন ওয়ার্নের মৃত্যু প্রথমে অবিশ্বাস, পরে গভীর শোকের চাদরে ঢেকে যায় গোটা ক্রিকেট বিশ্ব।
শেন ওয়ার্ন অবশ্যই সর্বকালের সেরা লেগ স্পিনার, অবশ্যই সর্বকালের সেরা স্পিনার। সর্বকালের সেরা বোলার, এমনকি সর্বকালের সেরা ক্রিকেটারের ছোট্ট তালিকায়ও থাকবে তার নাম। তবে মাঠের পারফরম্যান্স আর মাঠের বাইরের কর্মকান্ড বিবেচনায় নিলে শেন ওয়ার্নের মত বর্ণাঢ্য ক্রিকেটারই নয় শুধু, এমন ক্রীড়াবিদের সংখ্যাও হাতে গোনা। মাঠ এবং মাঠের বাইরের পারফরম্যান্স বিবেচনায় অনেকে বলছেন, ক্রিকেটের ম্যারাডোনা শেন ওয়ার্ন। দুজনের মধ্যে দারুণ মিল আছে। মাঠে দুজনই উৎকর্ষের চূড়া স্পর্শ করেছেন।
Advertisement
মাঠের বাইরে মাদক কেলেঙ্কারি, নারী কেলেঙ্কারি, মারামারি- সব্ই করেছেন তারা। দুজনেই বরণ করেছেন অকাল মত্যু। অবশ্য মৃত্যু প্রসঙ্গে ‘অকাল’ শব্দে অনেকের আপত্তি। অনিবার্য মৃত্যু কাকে কখন ডেকে নেবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তবে মানুষের গড় আয়ু হিসাব করলে শেন ওয়ার্নের মৃত্যুকে ‘অকাল’ই বলতে হবে।
মাত্র ৫২ বছর বয়সে শেন ওয়ার্নের মত ক্রীড়া ব্যক্তিত্বের মৃত্যু আসলে অপুরনীয়। ম্যারাডোনাও মাত্র ৬০ বছর আয়ু পেয়েছিলেন। অনেকেই অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনকেই তাদের অকাল মৃত্যুর জন্য দায়ী করছেন। তবে কে তার জীবন কীভাবে যাপন করবেন; তা একান্ত তার ইচ্ছা, তার স্বাধীনতা।
আসলে প্রত্যেকটি মানুষের জীবন আলাদা, স্বপ্ন আলাদা, বেঁচে থাকার আকাঙ্খা আলাদা। এই যে বিশ্বে কোটি কোটি মানুষ, প্রত্যেকেই কিন্তু পৃথিবীতে এসেছেন, কোনো না কোনো লক্ষ্য নিয়ে। সবাই চান যাওয়ার আগে পৃথিবীতে চিহ্ন রেখে যেতে। কিন্তু আমরা অধিকাংশই পৃথিবীতে জন্ম নেই, কিছু জাগতিক দায়িত্ব পালন করি এবং হারিয়ে যাই। কিন্তু ওয়ার্ন বআ ম্যারাডোনার মত মানুষেরা পৃখিবীতে চিহ্ন রেখে যান। তাদের মানুষ স্মরণ করে যুগের পর যুগ।
লতা মুঙ্গেশকর, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় বা বাপ্পি লাহিরীরা তাদের কর্মে বেঁচে থাকেন হাজার বছর। শেন ওয়ার্ন বা ম্যারাডোনা ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রতিভা নিয়ে জন্মেছিলেন। অনেকে মনে করেন, তারা যদি নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করতেন, তাহলে তারা আরো অনেককিছু করতে পারতেন। কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করেই তারা যা করেছেন, তা তো আর কেউ করতে পারেনি। প্রতিভাকে আসলে নিয়ন্ত্রণের বেড়াজালে আটকে রাখা যায় না।
Advertisement
প্রতিভাবানরা একটু বেখেয়ালিই হন। বিশ্বের আরো অনেক ক্রিকেটার বা ফুটবলার তো নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করেও তাদের ধারেকাছেও যেতে পারেননি। তাই বলে কেউ ভাববেন না, আমি অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনকে উৎসাহিত করছি। স্কুল ক্রিকেটে বিনোদ কাম্বলির সাথে পার্টনারশিপের বিশ্ব রেকর্ড গড়েছিলেন শচীন টেন্ডুলকার। বলা হচ্ছিল, কাম্বলি শচীনের চেয়েও বেশি প্রতিভাবান। কিন্তু নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনে শচীন বনেছেন ক্রিকেটের ঈশ্বর। আ ঈশ্বরপ্রদত্ত অমিত প্রতিভা নিয়ে জন্মানো কাম্বলি হারিয়ে গেছেন উচ্ছৃঙ্খলতায়। ব্রাজিলের ফুটবলার রোনালদিনহোকে মানা হয় সর্বকালের সেরা প্রতিভাবানদের একজন হিসেবে। কিন্তু উচ্ছৃঙ্খলতা তাকেবো সেরা হতে দেয়নি।
ফুটবল বিশ্ব রোনালদিনহোর ঝলক দেখলেও প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ দেখেনি। আসলে জীবন একেজনের কাছে একেকরকম। কে কীভাবে তা যাপন করবে, সেটা তার স্বাধীনতা। মানুষের অন্তর্নিহিত শান্তিটাই আসল। কে কীসে শান্তি খুজে পাবে, তা তার ইচ্ছা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের অনার্সের প্রথম ব্যাচের মেধাবি ছাত্র আনিস চৌদ্দগ্রামের গ্রামের বাড়িতে সাধারণ জীবন যাপন করে মরে গেছেন। তার বন্ধুদের অনেকেই দেশে-বিদেশে প্রতিষ্ঠিত।
এখন কার কাছে জীবনের মানে কী, সাফল্যের সংজ্ঞা কী; কে জানে। আনিস স্যার হয়তো গ্রামের নিভৃত জীবনই ভালো লেগেছে। চাইলে তো তিনি ঢাকা বা ওয়াশিংটনে বিলাসি জীবনযাপন করতে পারতেন। বিলাস হয়তো তাকে টানেনি। আমাদের ক্লাশের ফার্স্টবয় আতাউর এখন গ্রামে থাকে। বিকালে চায়ের দোকানে আড্ডা মারে। তাই বলে কি আপনি তাকে ব্যর্থ বলবেন? আতাউর হয়তো এটাই চেয়েছিল। গ্রামের জীবনই তার কাছে ভালো লাগে। আমি শেষ জীবনে গ্রামে ফিরে যেতে চাই। আর আতাউর তো গ্রামেই থাকছে। চাইলে তো আনিস স্যার বা আতাউর আমাদের সংজ্ঞায় অনেক ‘সফল’ হতে পারতো। তারা চায়নি, সেটা তাদের ইচ্ছা।
প্রত্যেক মানুষের অধিকার আছে, তার নিজের জীবন বেছে নেয়ার। কদিন আগে নিউজে দেখলাম, এক ব্যাংকার কয়েক কোটি টাকার সম্পতি রেখে মারা গেছেন। কিন্তু তার মরদেহ ২৪ ঘণ্টা গ্যারেজে ফেলে রেখে সন্তানেরা ব্যস্ত ছিল সম্পত্তি নিয়ে কামড়াকামড়িতে। আরেক নিউজে দেখলাম, মা মারা গেলে সম্পত্তি পাবে, এই অপেক্ষা সহ্য হয়নি সন্তানের। আগে আগে সম্পত্তি ভোগ করতে ভাড়াটে খুনী দিয়ে মাকে খুন করায় সেই সন্তান। হায় অর্থ, হায় সাফল্য, হায় জীবন!
কেউ মারা গেলে আমরা কাঁদি, শোক করি। কিন্তু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে মৃত্যু শোক নয়, উৎসব। গত শুক্রবার রাজধানীর সবুজবাগে ধর্মরাজিক বৌদ্ধ বিহারে এক ব্যতিক্রমী অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া দেখেছেন সবাই। উৎসবমুখর পরিবেশে দাহ করা হয়, বাংলাদেশে বৌদ্ধদের সর্বোচ্চ ধর্মগুরু শুদ্ধনন্দ মহাথেরোর মরদেহ।
বৌদ্ধরা বিশ্বাস করেন, মৃত্যু হলো দুঃখ-দুর্দশার এই জগত থেকে মুক্তিলাভ, আরো বড় কোনো লক্ষ্য অর্জনের পথে যাত্রা। শুদ্ধানন্দ মহাথেরো মারা গিয়েছিলেন দুই বছর। এই দু্ব বছর তার মরদেহ বিশেষ কায়দায় সংরক্ষণ করা হয়েছিল, সবাইকে দেখানোর জন্য, জাগতিক মৃত্যু থেকে কারো রেহাই নেই।
বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু এখন প্রায় ৭৩ বছর। আগের তুলনায় যা অনেক বেড়েছে। অনেকে ১০০ বছরও আয়ু পান। কিন্তু তবুও মানুষের বাঁচার আকাঙক্ষা ফুরায় না। শতবর্ষী মানুষও আরো বাঁচতে চান। তারাশঙ্করের 'কবি' উপন্যাসের নিতাইয়ের হাহাকার আমাদের কণ্ঠে, অন্তরে-‘এই খেদ মোর মনে,ভালোবেসে মিটল না আশ, কুলাল না এ জীবনেহায়! জীবন এত ছোট কেনে,এ ভুবনে?’৫ মার্চ, ২০২২
এইচআর/জিকেএস