রাব্বী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র। ছাত্রজীবনেই যুক্ত হয় গণমাধ্যমের সঙ্গে। শিক্ষাজীবন শেষে যোগদান করে বাংলাদেশ ব্যাংকে। পেশা পরিবর্তন হলেও গণমাধ্যমের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখেছে এখনও। চাকরি-বাকরি বা ক্যারিয়ার বিষয়ক লেখালেখি করে। মানুষকে স্বপ্ন দেখায়। কীভাবে ক্যারিয়ার গড়া যায়। জীবনের সফলতা লাভের উপায় কী? ইত্যাদি ইত্যাদি।রাব্বী সদা হাস্যোজ্জ্বল একজন মানুষ। আড্ডায় প্রাণবন্ত। উল্লাসে প্রস্ফুটিত। আড্ডায় কখনো সিগারেটে ঠোঁট লাগায়নি। আর তার ওপরে তল্লাশি চালানো হয় মাদকবহন করা হচ্ছে এমন সন্দেহে। শুধু তল্লাশিতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি জনগণের জানমালের নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশ। তারা বিনা কারণে নির্যাতনও করেছে তাকে। ক্রসফায়ারে মেরে ফেলার হুমকিও দিয়েছে। গোলাম রাব্বী সেই রাতের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছে, সেদিন রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বন্ধু তাকে মোহাম্মদপুর পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে যায়। সেখানে এক আত্মীয়ের বাসায় রাতে খাবার খেয়ে হেঁটে কলেজ গেটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। রাত তখনো গভীর হয়নি। আনুমানিক ১১টার মতো বাজে। রাস্তায় অনেক লোকজনও ছিল। বেশ কিছু দোকানপাটও খোলা ছিল। একাই হেঁটে কলেজ গেটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। সেখান থেকে গাড়িতে উঠে কল্যাণপুরের বাসায় ফিরবে বলে মনস্থির করেছিল।কিন্তু হঠাৎ করে পুলিশের গাড়ি এসে তাকে আটক করে। আটক করার পর পরই ২০/২৫ জন লোক আশেপাশে জড়ো হয়। তার বেশভূষা দেখে তারা পুলিশকে ছেড়ে দিতে অনুরোধ জানালেও পুলিশ তাতে কর্ণপাত করেনি। আটকের পর তাকে নিয়ে এসআই মাসুদ মোহাম্মদপুর এলাকায় গাড়ি নিয়ে চক্কর দিতে থাকে। প্রথমে তাকে বলা হয় ৫৪ ধারায় আটক দেখিয়ে মামলার আসামি করা হবে। এক পর্যায়ে এসআই মাসুদ বলেন, পুলিশের ক্ষমতা কী জিনিস বুঝস, তোকে মাদক ব্যবসায়ী বানাবো, গুলি করবো, কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবো তুই পুলিশের কাছ থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নিতে চাইছিলি। তোর আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবকে তাড়াতাড়ি টাকা নিয়ে আসতে বল। বেশি মানুষ আসলে তোর খবর আছে। কোনো পুরুষ নয়, সম্পর্কে তোর খালা, ফুফু, চাচি হয় এমন কাউকে টাকা নিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে আসতে বল, তারা এসে তোকে মুচলেকা দিয়ে নিয়ে যাবে, টাকা না আনলে তোর কপালে খারাপি আছে।অবশেষে মুঠোফোনে ক্ষুদেবার্তার মাধ্যমে রেডিও ধ্বনির সাংবাদিক জাহিদ হাসানসহ তিন-চারজন খবর পেয়ে আসাদ গেট যান। তাদের দেখে পুলিশ পিকআপ ভ্যান টান দেয়। আড়ং থেকে আসাদ গেট এলাকায় যানজটে আটকা পড়ে পুলিশ ভ্যান। এরপর উদ্ধার করতে গেলে রাব্বীর কাছে গাঁজা, হিরোইন পাওয়া গেছে বলে দাবি করে। বিভিন্ন কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে রাত ১টার দিকে তাকে ছেড়ে দেয়। আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, কেমন ছিলো রাব্বীর মতো একজন স্বপ্ন নির্মাতার দুঃস্বপ্নের রাত। যে দুঃস্বপ্নের নির্মাতা তারই নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশ কর্তা। গত শনিবার রাত ১১টার পরে যে দুঃসহ ঘটনার গর্তে আবর্তিত হয়েছিল সে, তা সারাজীবনেও ভুলে থাকার মতো নয়। সকালে রাব্বীর স্ট্যাটাস পড়ে শরীর থরথর করে কাঁপছিলো। পরিচয় পেয়ে পুলিশ কেন আরো হিংস্র হয়ে ওঠে? তাহলে আমি কি কখনোই সাংবাদিক পরিচয় দেব না? পুলিশ কেন অযথা মেরে ফেলার হুমকি দেবে? অথচ এদেশে অপরাধীরা দিব্যি পার পেয়ে যাচ্ছে। কখনো দেখিনি চেকপোস্ট বসিয়ে অপরাধী ধরা গেছে। কেবল নিরীহ অফিস থেকে বাসাগামী কিছু মানুষ হয়রানির শিকার হয়েছে। কেউ মুখ খুলেছে, কেউ খোলেনি। যুগে যুগে কি লিমন, কাদের ও রাব্বীর মতো আরো নাম যুক্ত হবে? দীর্ঘ হবে নির্যাতিতের সংখ্যা?রাব্বী আশঙ্কা প্রকাশ করেছে, সেও হতে পারতো কাদের কিংবা লিমন! আল্লাহ রক্ষা করেছেন। কেমন দেশে বসবাস করি আমরা। আর কতো লিমন-কাদের জন্ম নেবে? রাব্বী তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছে, ‘যে রাব্বী ‘স্বপ্নের বাংলাদেশ’ আর ‘বিশ্বকে মানুষের বসবাস উপযোগী করা ও রাখার জন্য’ সর্বতভাবে নিজে ইতিবাচক চিন্তা করে- কাজ করে- লেখে- বলে; এমনকি ভালো কিছু করার কথা সব সময় ভাবে; একইসাথে অন্যকে ভাবতে সাহায্য করে- উৎসাহ যোগায়, সে আজ কি দেখলো…!’রাব্বী আজ কী দেখলো? আমরাই এ কী শুনলাম? রাব্বীর মতো একজন গণমাধ্যমকর্মী, বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা যদি এমন নির্যাতনের শিকার হয় তবে সাধারণ জনগণের নিরাপত্তার তো প্রশ্নই ওঠে না। যে মানুষটি জীবনে বহুবার এমন ঘটনা ‘সংবাদ উপস্থাপক’ হিসেবে পড়েছে। একজন সমাজ সচেতন মানুষ হিসেবে বহুবার এমন ঘটনার ঈঙ্গিত পত্রিকা-টিভি-রেডিও-অনলাইনের ভাষায় আঁচ করতে পেরেছে; কিন্তু নিজের কাছে প্রত্যক্ষ প্রমাণ নাই- তাই বিশ্বাসযোগ্য মনে হলেও ‘এমনটা হতে পারে না’ বলে এড়িয়ে গেছে। আজ তার জীবনেই ঘটে গেল এমন ভয়াবহ ঘটনা।যখন সবগুলো গণমাধ্যম ফলাও করে সংবাদটি প্রকাশ করছে। তখন সারাদেশের মানুষ লজ্জায় ছি ছি করেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও নিন্দার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। অথচ অভিযুক্ত ওই পুলিশ কর্মকর্তা এসআই মাসুদ রানা দম্ভোক্তি করে বলেছে, ‘আমি নির্দোষ, আমার কিচ্ছু হবে না। নিরপেক্ষ তদন্ত হোক। আমিই নির্দোষ প্রমাণিত হবো। থানার সবাই আমার পক্ষে। আর আমি শুধু একা ছিলাম না আমার সঙ্গে শাহজাহান ও লতিফ নামে আরও দুই কনস্টেবল ছিল।’যদিও অভিযুক্ত মোহাম্মদপুর থানার পুলিশ উপ-পরিদর্শক (এসআই) মাসুদ রানা শিকদারকে ক্লোজড করা হয়েছে। সোমবার তাকে দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। তবে জনমনে প্রশ্ন, দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করে নিলেই কি বিচার হয়ে গেল? গণমাধ্যমের সূত্রমতে, ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার ওয়াহেদুল ইসলাম বলেছেন, ‘প্রাথমিক তদন্তে এসআই মাসুদ শিকদারের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় তার বিরুদ্ধে এ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগো নিউজ রাব্বীর ঘটনায় সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছে। সেখানে এসআই মাসুদের খুঁটির জোর সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। দেশে যখন সৎ-নির্ভিক পুলিশ অফিসারের সুকীর্তি ফলাও করে ছাপা হচ্ছে সেখানে এসআই মাসুদের মতো পুলিশ সদস্যরা বড়ই বেমানান। রক্ষক যদি ভক্ষক হয়, তবে জাতীয় জীবনে চরম হতাশা বা গ্লানি নেমে আসে। এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি চাইনা আমরা। দেখতে চাই না আর কারো চোখের জল। সৎ অফিসারের প্রমাণও তো আছে ভুরি ভুরি। তবে এমন দু’একজন কর্মকর্তার জন্যই বদনাম হয় পুরো ডিপার্টমেন্টের। এ দায় ভার কে নেবে? আমরা চাই তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। পুলিশে চাকরি করার ন্যূনতম যোগ্যতা তার মধ্যে নেই। যার হাতে এদেশের একজন সুনাগরিক লাঞ্ছিত হয়, তার হাতে দেশরক্ষার তো প্রশ্নই আসে না। গোলাম রাব্বী বিভাগীয় কমিশনার বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। সেখান থেকে তদন্তের মাধ্যমে বিচারের আশ্বাস দেয়া হয়েছে। আমরা আশা করবো, নিরপেক্ষ তদন্ত হোক। সুষ্ঠু বিচার হোক। আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই এমন গর্হিত কাজের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। আর বলতে চাই- ‘আমাকে আমার স্বপ্ন দেখতে দাও, আমাকে আমার স্বপ্নের পথে হাঁটতে দাও।’লেখক : কবি ও গণমাধ্যমকর্মী।এইচআর/পিআর
Advertisement