দেশজুড়ে

হাত ছেড়ে দিয়ে ৫০ কিমি চালাতে পারেন সাইকেল, দেখান নানান কসরত

শৈশবে পা ভেঙে যাওয়ায় একটু দেরিতেই সাইকেল চালানো শেখেন ইয়াসিন আলী। সাইকেল চালাতে পারতেন না বলে একটা সময় সহপাঠী, খেলার সাথীরা তাকে নিয়ে হাসি-তামাশা করতেন। এক পর্যায়ে সাইকেল নিয়ে কিছু করার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন ইয়াসিন।

Advertisement

সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে করেছেন কঠোর পরিশ্রম। লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য ছিলেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। অবশেষে স্বপ্নকে পূরণ করেছেন। মাত্র চার বছরের অনুশীলনেই সাইকেলকে নিয়েছেন নিজ আয়ত্বে। একটানা ৫০ কিলোমিটার রাস্তা হাত ছেড়েই সাইকেল চালিয়ে যেতে পারেন ইয়াসিন আলী।

এখানেই শেষ নয়, কোথাও না থেমে বা বিশ্রাম না নিয়েই ১০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে পারেন সাইকেলে। হাত ছেড়ে সাইকেল চালানোর সময় কিছু শারীরিক কসরত করেন তিনি। তার এ অসম্ভবকে সম্ভব করা দেখে হতবাক বিদ্রূপ করা সেই খেলার সাথীরা।

ইয়াসিন আলী দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার শিবরামপুর ইউনিয়নের আরাজী মিলনপুর এলাকার নজরুল ইসলাম ঢালীর ছেলে। শিক্ষাজীবনের শুরু হয়েছে মাদরাসায়। তার বয়স বর্তমানে ১৮ বছর। তিনি আরাজি লস্কর ইসলামিয়া দাখিল মাদরাসার দাখিল শ্রেণিতে পড়ছেন।

Advertisement

খবর পেয়ে বিষয়টি নিজ চোখে দেখতে যাওয়া হয় বীরগঞ্জ উপজেলার আরাজী মিলনপুর এলাকায়। তাকে অনুরোধ করা হয় হাত ছেড়ে সাইকেল চালানো এবং তার উদ্ভূত শারীরিক কসরত দেখানোর জন্য।

বেলা ১১টায় ইয়াসিন আলী বীরগঞ্জ উপজেলা পরিষদ থেকে সাইকেল চালানো শুরু করেন। প্রথমে মাত্র ১০ থেকে ১৫ সেকেন্ডের জন্য হাতলে হাত রেখে সাইকেল চালানোর পরই ছেড়ে দেন হাতল। হাত ছেড়ে দিয়েই সড়ক-মহাসড়ক ও গ্রামের রাস্তা পেরিয়ে ২৬ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেন। প্রায় আড়াই ঘণ্টা হাত ছেড়ে সাইকেল চালিয়ে পৌঁছান নিজ বাড়িতে। এরই মধ্যে দেখান সাইকেল চালাতে চালাতে পেছনে রাখা বোতল থেকে পানি খাওয়া, মাথায় টুপি পরা আবার খোলা, নানা অঙ্গভঙ্গি করা আর গান গাওয়াসহ নানান প্রদর্শনী।

নিজ এলাকায় তিনি যখন পৌঁছান তখন সময় প্রায় দুপুর দেড়টা। এই ২৬ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিলেও ইয়াসিন আলী মোটেও ক্লান্ত নন। পুরো রাস্তাটিতেই তাকে পর্যবেক্ষণ করা হয় পেছন থেকে মোটরসাইকেল চালিয়ে। এলাকায় গিয়ে কথা হয় তার পরিবার এবং এলাকাবাসীর সঙ্গে। পরিবার ও এলাকাবাসী এমন প্রতিভাকে টিকিয়ে রাখতে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

আলাপচারিতায় ইয়াসিন আলীর বাবা নজরুল ইসলাম ঢালী জাগো নিউজকে বলেন, ‘একদিন সকালে ছেলের সঙ্গে বসে নাস্তা করলাম। পরে সে সাইকেল চালিয়ে রংপুর মর্ডানে পৌঁছে আমাকে ফোন দেয়। আমি অবাক হলাম, একটু ভয়ও পেলাম। পরে ছেলেকে ওভাবে ফিরতে নিষেধ করলে সে জানায় তার কাছে এইটা ব্যাপার না। বিষয়টি এলাকাবাসীকে জানালে বিশ্বাস করে না। পরে আরও জানলাম সে হাত ছাড়া দীর্ঘপথ সাইকেল চালাতে পারে। এটা আমার কাছে খুব গর্বের। তাছাড়া সে অনেক বড় হয়ে সাইকেল চালানো শিখে এমন কিছু করছে। আমি চাই সে সাইকেল প্রতিযোগিতায় অংশ নিক।’

Advertisement

কথা হয় ইয়াসিনের বড় ভাই সাদেকুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘সে তো সাইকেল চালাতে পারতো না ১৪ বছর পর্যন্ত। এরপর অনেক বলাবলির পর সাইকেল চালানো শেখে। এরপরে শুনি আজ গেছে রংপুরে, কাল গেছে দিনাজপুরে। একদিন বাড়িতে না বলে দিনাজপুর মেডিকেলে গেছিল। তারপরে বিরলে তার এক বন্ধুর বাসা।’

তিনি বলেন, ‘আমরা যেখানে দুই চার কিলোমিটার সাইকেল চালাতে হিমশিম খাই, সেখানে সে একটানা ৫০ কিলোমিটার সাইকেল চালাতে পারে। বিষয়টি সত্যি অবাক করার। আমাদের কাছে যা দুই-চার কিলোমিটার তার কাছে ৫০ কিলোমিটারও তাই।’

স্থানীয় ক্যাবল ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমি একদিন সেলুনে বসে চুল কাটাচ্ছি। এমন সময় একজন বলাবলি করছে বিষয়টি। শুনে এটি অবিশ্বাস্য মনে হলেও নিজ চোখে দেখার পর বিশ্বাস করেছি।’

ইয়াসিনের ভাগিনা পারভেজ মোশাররফ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি মামার পাঁচ বছর আগে সাইকেল কিনেছি। মামার যখন পা ভেঙে গেলো তখনই আমি সাইকেল চালানো শিখি। তিনি খুব দরিদ্র পরিবারের ছেলে। সাইকেলটিও ভাঙা। তিনি যদি ভালো একটি সাইকেল পেতেন তবে হয়তো তার মনের স্বপ্নগুলো পূরণ করতে পারতেন।’

বিষয়টি নিয়ে কথা হয় ইয়াসিন আলীর সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘ছোটবেলায় আমার পা ভেঙে যাওয়াতে আমি একটু দেরি করেই সাইকেল চালানো শিখেছি। এজন্য আমাকে অনেকেই অনেক কথা বলতো। আমি তা কানে দিইনি। তখনই জেদ চাপে আমি সাইকেল নিয়ে কিছু একটা করবো। আমি সাইকেল চালানোকে আমার প্রিয় খেলা হিসেবে নিয়েছি। আমি এখন একটানা ক্লান্তিহীনভাবে ৫০ কিলোমিটার হাত ছেড়ে দিয়ে সাইকেল চালাতে পারি। মাত্র ১০ ঘণ্টায় ২০০ কিলোমিটার সাইকেল চালাতে পারি।’

ইয়াসিনের স্বপ্ন সাইকেলের হাতল ছেড়ে দিয়ে প্রথমে নিজের দেশ ও পরে বিশ্ব ঘুরবেন। দেশের পতাকা বিশ্ব দরবারে তুলে ধরবেন। কিন্তু আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে সে এখনো নিজ জেলার বাইরেই যেতে পারেননি। নিজের স্বপ্ন পূরণে সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন ইয়াসিন আলী।

এমদাদুল হক মিলন/এসআর/জিকেএস