মতামত

সুষ্ঠু নির্বাচন ও নতুন ইসির চ্যালেঞ্জ

আইনি কাঠামোয় অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে দেশে প্রথমবারের মতো গঠিত হলো প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ পাঁচ সদস্যের নির্বাচন কমিশন। যাদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হলো সবার অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান। একই সাথে ভোট ঘিরে মানুষের আগ্রহে যে ভাটা পড়েছে তা ফেরানো এবং ভোটারদের ভোটকেন্দ্রমুখী করার চ্যালেঞ্জও রয়েছে।

Advertisement

আগের দুটি কমিশন ২০১৪ ও ২০১৮ সালে যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করেছে, তা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। বিশেষ করে ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপিসহ বিরোধী জোটের বিরোধিতার কারণে ১৫৩ আসনে ভোটই হয়নি। বিভিন্ন নির্বাচনে কোনো কোনো কেন্দ্রে গণমাধ্যমকর্মীদের ভেতরে ঢুকতে বাধা দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে।

২০১৮ সালে পছন্দের প্রার্থীকে ভোটদানে বাধার অভিযোগ এলেও চটজলদি প্রতিকারের দেখা মেলেনি। এছাড়া নির্বাচন-পূর্ব, ভোটের দিন ও নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতা রোধে ভালো ব্যবস্থাও নিতে পারেনি তারা।

প্রতিবেশী দেশ ভারতের সংবিধানের পঞ্চদশ অধ্যায়ের ৩২৪ থেকে ৩২৯ অনুচ্ছেদে নির্বাচন কমিশন গঠন ও এর কার্যাবলি আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু নির্বাচনকালীন নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগের বিষয়ে সরাসরি কিছু বলা নেই। পাঞ্জাবের কংগ্রেস নেতা ও সাংসদ মহিন্দর সিং গিলের ১৯৭৭ সালে করা রিটে ৩২৪ অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যায় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বলেন, নির্বাচন আয়োজন ছাড়াও প্রশাসনিক ও বিচারিক ক্ষমতা রয়েছে নির্বাচন কমিশনের।

Advertisement

এই নির্দেশনার মাধ্যমে পরে নির্বাচনকালীন নির্বাহী ক্ষমতার সফল প্রয়োগ ঘটান নির্বাচন কমিশনাররা। যাতে চেঞ্জমেকারের ভূমিকায় ছিলেন ১৯৯০ সালে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পাওয়া তিরুনেল্লাই নারায়ণ আইয়ার সেশন বা টিএন সেশন। হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই শিক্ষার্থী ভারতের ১৮তম মন্ত্রিপরিষদ সচিব ছিলেন। সিইসির দায়িত্ব পালনের আগ মুহূর্তে ছিলেন পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য।

নির্বাচন কমিশনকে তার আত্মমর্যাদা ও সাংবিধানিক অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করেন সেশন। রাজীব গান্ধি খুন হলে, ভারতের রাষ্ট্রপতির সাথে পরামর্শ ছাড়াই লোকসভা নির্বাচন স্থগিত করেন। শুধু নির্বাচন কমিশনের ভেতরেই নয়, ইসি সম্পর্কে দীর্ঘদিনের প্রশাসনিক ধ্যান-ধারণাও পাল্টে দেন তিনি।

নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা প্রয়োগ নিয়ে ১৯৯৩ সালে ভারতের সরকারকে চ্যালেঞ্জ করে সব ধরনের নির্বাচন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধে ১৭ পাতার নির্দেশনা জারি করেছিলেন টিএন সেশন। এতে পশ্চিমবঙ্গ থেকে নির্বাচন করতে না পেরে ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন প্রণব মুখার্জি (পরে ভারতের ১৩তম রাষ্ট্রপতি)। সেশনের সংস্কার ব্যবস্থার পথ ধরে ১৯৯৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে শর্ত পূরণে ব্যর্থ প্রায় দেড় হাজার প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল হয়। দোর্দণ্ড এমন প্রতাপের কারণে টিএন সেশনকে অনেকেই বলতেন টাইট নাট সেশন। যিনি অন্যদের ‘টাইট’ দিতে সিদ্ধহস্ত।

বাংলাদেশের সংবিধানের ১২৬তম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বপালনে সহায়তা করা সব নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হইবে।’ সাংবিধানিক এমন সুরক্ষা কবচের যথার্থ ব্যবহার করাটাই চ্যালেঞ্জ। আবার এই বিধানের অধীনে নির্দেশনা উপেক্ষিতও হতে পারে। যেমন- ২০১১ সালে তৎকালীন সিইসি নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিলেও সেটি কার্যকর হয়নি।

Advertisement

প্রথম সংবাদ সম্মেলনে বর্তমান সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল সরাসরি জানিয়ে দিলেন, ভালো নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা দরকার। তিনি মুরুব্বি হতে পারবেন না। তার দায়িত্ব তাদের প্রতি অনুনয়-বিনয় করা। সদ্য বিদায় নেয়া সিইসি কেএম নূরুল হুদাও অনেকটা একই ধরনের চিন্তা-চেতনার ছিলেন। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সহিংসতার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মনোভাবকে দায়ী করেছিলেন।

ভালো নির্বাচনের আগে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করতে হয়। বিএনপিসহ বিরোধী বেশকিছু দলের অভিযোগ, এখানে বড় ধরনের গলদ রয়েছে। একই সাথে তাদের দাবি, নির্দলীয় বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া ভোটের পরিবেশ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তাই নতুন নির্বাচন কমিশনের প্রতি তাদের তেমন কোনো প্রত্যাশাও নেই। সিইসির এখনকার মনোভাব অব্যাহত থাকলে, বিএনপিসহ এসব দলকে নির্বাচনে নিয়ে আসা কঠিন হবে, যা মানুষকে আরেকবার আশাহত করতে পারে।

লেখক: বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল ২৪।

এইচআর/এএসএম