ফিচার

মানসিক-শারীরিক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে শিক্ষাবঞ্চিত বেদে শিশুরা

যে শিশুদের সকাল শুরু হয় সাপ খেলা দেখানোর মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ দিয়ে, সেসব কোমলমতি শিশুদের জীবনও রঙিন হতে পারতো। বলছি দেশের আনাচেকানাচে ছড়িয়ে থাকা বেদে জনগোষ্ঠীর শিশুদের কথা। সারা দেশের সব শিশুরা যখন নতুন বই হাতে নিয়ে পাঠ্য বইয়ের সুগন্ধী নেয় তখন বই উৎসবের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় বেদে জনগোষ্ঠীর শিশুরা। আর এভাবেই চলছে যুগের পর যুগ।

Advertisement

অনেক শিশুরা স্কুলে ভর্তি হলেও তাদের দেখা হয় বৈষম্যের চোখে। ক্লাসের অন্য শিশুরা বেদে জনগোষ্ঠীর শিশুদের সঙ্গে কথা বলে না। সাপ ধরা ও খেলা দেখানোর মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সঙ্গে ছোটবেলাই জড়িয়ে যায় এই শিশুরা, ফলে মারাত্মকভাবে প্রভাব পরে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে।

আমাদের দিন কাটে মানুষের গালি আর কু-কথা শুনে, ব্যবসার কাজে এখন আর বাইরে যেতে পারিনা এভাবেই দুর্বিষহ জীবনের আর্তনাদের কথা জানাচ্ছিলেন বেদে জনগোষ্ঠীর এক নারী। নবজাতক কোলে মরিয়ম নামের এক কিশোরী বলেন, ওর জন্ম হইছে ৩ মাস আগে, এখন ওকে বড় করতে হবে।

ময়মনসিংহ অঞ্চলের বেদে জনগোষ্ঠীর মানুষদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই জনগোষ্ঠীর মানুষদের মাঝে বাল্যবিবাহের প্রবণতা বেশি, সমাজ তাদের আলাদা চোখে দেখায় সমাজের মূল অংশে আসতে পারছেনা, ফলে বাল্যবিবাহের কারণে ঝুঁকিতে মেয়েদের জীবন, অনিশ্চিত অন্ধকার জগতে শিশুরা।

Advertisement

বেদে জনগোষ্ঠীর শিশুদের বেড়ে ওঠাতে নেই একাডেমিক শিক্ষার ছোঁয়া। যুগের পর যুগ চলে যাচ্ছে এভাবেই। ফলে স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিষয়ে নেই জ্ঞান। সামাজের বিচ্ছিন্ন একটি অংশ হওয়ায় সমাজ থেকেও পাচ্ছেনা দিকনির্দেশনা। জন্মের পর থেকে শিশুরা বড়দের কাছ থেকে শিক্ষা বলতেই পায় সাপ বানর খেলা দেখানোর শিক্ষা।

বেড়ে ওঠে ভয়ংকর ঝুঁকিপূর্ণ অভিজ্ঞতা নিয়ে, মেয়েদের শেখানো হয় সিঙ্গা লাগানো, তাবিচ বিক্রিসহ নানা ধরনের ঝাড়-ফুঁক। বেসরকারি সংস্থা ও সংগঠনের উদ্যোগে বিভিন্ন সময় শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হলেও কিছুদিন পরেই বন্ধ হয়ে যায়।

সময়ের পরিক্রমায় যুগ বদলে গিয়েছে সবার গায়ে এখন আধুনিকতার ছোঁয়া। তবে তাদের জীবনে নেই আধুনিকতা। বেদে জনগোষ্ঠীর শিশুরা জানায়, তাদের আধুনিক জীবনের বিচরণের ইচ্ছা। তারা অন্য শিশুদের মতো পড়াশোনা করে চাকরি করতে চায়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সব কিছুর সঙ্গে শিশুদের মানসিকতা পরিবর্তন ঘটছে, শিশুদের মানসিকতার ও ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাওয়াটা শিশুদের মানসিক বিকাশকে প্রতিহত করে।

Advertisement

সমাজসেবা অধিদপ্তরের জরিপ মতে, বাংলাদেশে বেদে জনগোষ্ঠী প্রায় ৭৫ হাজার। বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন তথা এ জনগোষ্ঠীকে সমাজের মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্ত করতে বর্তমান সরকার বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নিয়েছে।

২০১২-১৩ অর্থবছর হতে ২০১৮-১৯ পর্যন্ত বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি দু’টি একত্রে ছিল। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এ কর্মসূচি পৃথক হয়ে ‘বেদে জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি ‘নামে স্বতন্ত্র কর্মসূচি হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে’।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের ওয়েব সাইটে এসব তথ্য থাকলেও বাস্তবতা ভিন্ন। তাদের জীবনমানে উন্নয়নের ছোঁয়া পাওয়া তো মিলেই না, উল্টো মিলে অভিযোগ। শেরপুর, জামালপুর, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল ও ফেনীতে অবস্থানরত বেদে শিশুরা এখনো স্কুলগামীই হতে পারেনি যাযাবর জীবনযাপনের ফলে।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের ওয়েব সাইটে বেদে জনগোষ্ঠীর শিশুদের বৃত্তির কথা উল্লেখ থাকলেও বাস্তবতা একদম ভিন্ন যেখানে এই জনগোষ্ঠীর শিশুরা স্কুলেই যায় না সেখানে বৃত্তির বিষয়টি ভাবিয়ে তোলার মতো বিষয় মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন এর নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনামের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, সরকারের উচিত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত বেদে জনগোষ্ঠীর শিশুদের পরিসংখ্যান তৈরি করা, সেই জরিপ অনুযায়ী বয়স ভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রমের উদ্যোগ গ্রহণ করা, নয়ত এক অনিশ্চিত জীবনের দিকে চলে যাবে বেদে জনগোষ্ঠী শিশুরা, ফলে বাড়ছে মানসিক বিকৃতি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সালমা আক্তার বলেন, বেদে জনগোষ্ঠীর শিশুরা স্কুলে গেলে তাদের ভিন্ন চোখে দেখা হলে শিশুদের মাঝে মানসিক সমস্যা তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। এক গবেষণায় দেখা গেছে বেদে জনগোষ্ঠীর অনেক মানুষ তাদের ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি থেকে বেড়িয়ে আসেনা, শিশুদের মানসিকতাকে ঠিক রাখতে প্রয়োজন তাদের জীবনমান উন্নয়ন। তাদের জন্য আলাদা কোটা রাখা, যেন তারা প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পায়।

তিনি আরও বলেন, বাল্যবিবাহের প্রবণতা বেশি তাদের মধ্যে যারা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী, বেদে জনগোষ্ঠীর মানুষ যেহেতু সমাজের মূল অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন সেহেতু তাদের মধ্যেও প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। বাল্যবিবাহ শুধু মেয়েদেরই হয়না ছেলেরাও কিন্তু বাল্যবিবাহ করছে। যার মূল কারণ শিক্ষার অভাব। আর এটা স্বাস্থ্য ঝুঁকির মারাত্মক অংশ।

তিনি আরও বলেন বেদে জনগোষ্ঠীর মানুষদের যদি শিক্ষার আওতায় আনা যায় বাল্যবিবাহ প্রবণতা কমে আসবে। তারা নিজেরা ভবিষ্যত নিয়ে ভাববে এর জন্য দরকার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ।

শিশুদের লালনপালন ও শারীরিক বিকাশের ব্যপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সব বাবা মায়েরাই সন্তান পালনের ব্যপারে সহনশীল তবে স্বাস্থ্য ঝুঁকি তাদের মধ্যে অবশ্যই আছে। শিশুরা রোগাক্রান্ত হলে কবিরাজ তাবিজ কবচ ও পানিপড়ার উপর নির্ভশীল হয়ে থাকে। ডাক্তারি চিকিৎসার ক্ষেত্রে তারা এখনো আসতে পারেনি। সেক্ষেত্রে শিশুদের শারীরিক ক্ষতির পরিমাণ বেশি।

তারা যেখানে বসবাস করে ইউনিয়ন, পৌরসভা ও স্থানীয় সরকারের কার্যক্রম অনুযারী কমিউনিটি ক্লিনিকের সেবা গ্রহণের ব্য্যপারে উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে। শিক্ষার অভাবে তারা অপরাধের দিকেও ঢুকে যাচ্ছে আর অপরাধ চক্রও তাদের অসহায়ত্বকে কেন্দ্র করে তাদের বেছে নিচ্ছে।

শিক্ষা স্বাস্থ্য চিকিৎসা ও কর্ম ক্ষেত্রে সুযোগ না পেলে যে কোনো জনগোষ্ঠীই অপরাধের দিকে ঝুঁকবে, এভাবে হারিয়ে যাবে জনগোষ্ঠী। শিশুরা পর্যাপ্ত যত্ন পেলে তাদের মধ্যে শারীরিক সুস্থতা ও বিকাশের পাশাপাশি মানবিক মূল্যবোধ তৈরি হবে, গড়ে ওঠবে নতুন সুন্দর সমাজ।

কেএসকে/এমএস