মতামত

স্ট্যান্ডিং টিকিট পাইছি...

ঘটনা ঘটল মাঝরাস্তায়। হতবিহ্বল চোখে ডানপায়ের স্যান্ডেলের দিকে তাকালাম। এটাকে এখন জবাই করা ছাগলের জিহ্বার মতো মনে হচ্ছে। গলায় ছুরির 'পোঁচ' খাওয়ার পর ছাগলের জিহ্বা যেমন মুখের একপাশে ঝুলে পড়ে, ডানপায়ের জুতার ওপরের অংশ সেরকমভাবে ঝুলে আছে।

Advertisement

হাতঘড়ি বা চশমার ক্ষেত্রে এমন ঘটনা ঘটলে সেগুলো চুপিসারে পকেটে ঢুকিয়ে ফেলা যেত। পায়ের জুতা নিয়ে এমন কর্ম করা যাচ্ছে না। সমস্যা আরও আছে। চোখে চশমা কিংবা হাতে ঘড়ি না থাকলে কেউ প্রশ্ন করবে না- অই মিয়া, তোমার হাতে ঘড়ি নাই কেন, চোখে চশমা নাই কেন? কিন্তু খালি পায়ে কাউকে রাস্তায় হাঁটতে দেখলে লোকজনের মনে কৌতূহল ও নানা প্রশ্নের উদয় হবে। পানিতে ঠোঁট ডুবিয়ে মাছরাঙা যেমন ঝুপ করে মাছ ধরে, তেমনি টুপ করে ছেঁড়া স্যান্ডেল হাতে তুলে নিলাম।

একটা জুতা পায়ে, আরেকটা হাতে। হাঁটছি আর ভাবছি- বাক্স-প্যাটরার কব্জা খুলে গেলে কেউ যেমন তা দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখে, ছিঁড়ে যাওয়া জুতা পায়ের সঙ্গে আপাতত দড়ি দিয়ে গিঁট্টু দিয়ে রাখলে কেমন হয়? পরক্ষণেই মনে হলো, এটা কোনো ভদ্র ব্যবস্থা নয়। তার চেয়ে বরং একজন মুচির সন্ধান করা যাক। মজনুর সাক্ষাতে লাইলি যতটা খুশি হয়েছিল, এ মুহূর্তে একজন মুচির দেখা পেলে আমি তারচেয়ে কম খুশি হবো না। ব্যাকুল হয়ে মুচির সন্ধান করছি, পকেটের মোবাইল ফোন বেজে উঠল। লবণ বেগম ভারি গলায় জানতে চাইল-

: তুমি এখন কোথায়?: গোয়িং টু ইস্টিশন। : স্টেশনে যাইতেছ, না ছিঁড়া জুতা হাতে লইয়া ঘুরতেছ?: এই তথ্য তোমারে কে দিল?: তথ্য কে দিছে, এইটা জানা জরুরি না; ঘটনা সত্য কিনা কও?নীরবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। লবণ বেগম ক্ষুব্ধ গলায় বলল-: জুতা কেনার জন্য গতমাসে তোমার হাতে দুই হাজার টাকা দিলাম। জুতা না কিইনা তুমি সেই টাকা চিমটি দিয়া ধইরা রাখলা। এখন হইল তো! ময়না ভাবি তোমারে ছিঁড়া জুতা হাতে লইয়া ঘুরতে দেইখা সঙ্গে সঙ্গে ফোন দিছে। কও, এইসব আর কত সহ্য হয়?

Advertisement

তেরছা চোখে মোবাইল ফোনের দিকে তাকালাম। যন্ত্র একখান আবিষ্কার হইছে বটে! এর যন্ত্রণায় আশি হাত পানির নিচে গিয়েও নিস্তার নেই! আমাকে চুপ থাকতে দেখে লবণ বেগম বলল-: তোমার স্টেশনে যাওয়ার দরকার নাই; টিকিট কাটারও দরকার নাই। : কী কও! ঢাকায় যাবা না?: না। তুমি এই মুহূর্তে ওই জুতা ডাস্টবিনে ফেলাইয়া নতুন জুতা কিনবা। তারপর সোজা বাসায় আসবা।

এসব হচ্ছে রাগের কথা। গরীবের রাগ থাকতে নেই। লবণ বেগমের আদেশ অমান্য করলাম। নতুন জুতা কিনতে বললেই তো আর কেনা যায় না। মূল্যস্ফীতির ধাক্কায় পকেট ফক্কা। নতুন মাস কেবল শুরু হলো। বেতন পেতে এখনও অনেকদিন বাকি। পকেটের সামান্য কিছু টাকা নতুন জুতা কেনা বাবদ খরচ করে ফেললে মাসের বাকি দিনগুলো চলবে কিভাবে? পুরাতন জুতায় পট্টি মেরে স্টেশনে হাজির হলাম।

ঢাকাগামী ট্রেন আসবে বিকেল পৌনে পাঁচটায়। লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটতে হবে, এজন্য দুপুরের আগেই স্টেশনে চলে এসেছি। ট্রেন আসার আধঘণ্টা আগে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে লবণ বেগমের স্টেশনে হাজির হওয়ার কথা। ময়না ভাবির ফোনের প্রতিক্রিয়ায় সে যদি গাল ফুলিয়ে বসে থাকে, তাহলে কর্ম সাবাড়; আজ আর ঢাকায় যাওয়া হবে না। টিকিট হাতে পেয়েই লবণ বেগমকে ফোন করলাম-

: হ্যালো...: জুতা কিনছ?: জুতার ব্যবস্থা হইছে। তুমি দেরি না কইরা রওনা হইয়া যাও। আমি টিকিট কাইটা ফেলছি।একজন মানুষের চেহারা যত সুন্দরই হোক, মুচি যেমন তার মুখের দিকে না তাকিয়ে প্রথমে পায়ের দিকে তাকায়, লবণ বেগমও তাই করল। আমি ঢোক গিলে বললাম,: কয়েকটা দোকানে জুতার যেসব নমুনা দেখলাম, এক জোড়াও পছন্দ হইল না। তবে ঢাকায় যাইয়া আর দেরি করব না। প্রথমেই...লবণ বেগম চোখমুখ কঠিন করে ফেলল। আমি ভাব জমানোর চেষ্টা করতেই গম্ভীর কণ্ঠে সে জানতে চাইল-: ট্রেন আসতে আর কতক্ষণ?: ঘণ্টা পইড়া গেছে। এক্ষুণি চইলা আসবে।ট্রেন প্লাটফরমে ঢুকছে, এমন সময় লবণ বেগম নির্লিপ্ত কণ্ঠে জানতে চাইল-: আমাদের কোন বগি?: নির্দিষ্ট কোনো বগি নাই। : মানে?: সিটওয়ালা টিকিট পাই নাই। স্ট্যান্ডিং টিকিট পাইছি। লবণ বেগম ক্ষেপে গেল। বলল-: সিট পাও নাই, এই কথা আগে কও নাই কেন? : বলি নাই, ভাবছি-মমিসিং থেইকা ঢাকা তিন-সাড়ে তিন ঘণ্টার পথ। কষ্টমষ্ট কইরা কোনোরকমে পাড়ি দিয়া ফেলব। : কোনোরকমে পাড়ি দিয়া ফেলবা মানে? এইটা কি ...লবণ বেগমের কথা শেষ হওয়ার আগেই ক্যাচক্যাচ শব্দে ট্রেন থামল। লোকজনের ঠেলাঠেলি আর ধাক্কাধাক্কি কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করার পর লবণ বেগম বলল-

Advertisement

: এই গাদাগাদির মধ্যে বাচ্চারা দাঁড়াইয়া ঢাকা পর্যন্ত কিভাবে যাবে, কও আমারে! ভিড় আসলেই মারাত্মক। কী করব, বুঝতে পারছি না। হঠাৎ রেললাইনের উপরে স্থাপিত ফুটওভার ব্রিজের দিকে চোখ গেল। দেখলাম, মানুষজন পিঁপড়ার মতো সারিবদ্ধ হয়ে ফুটওভার ব্রিজে উঠছে। তারপর সেখান থেকে টুপ করে লাফ দিয়ে ট্রেনের ছাদের ওপর পড়ছে। ছাদবাসীদের মধ্যে নারীজাতি রয়েছে দেখে প্রেরণা পেলাম। দৃশ্যপটের দিকে লবণ বেগমের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললাম-

: ট্রেনের ছাদে উইঠা বসলে কেমন হয়?লবণ বেগম চোখের পলক না ফেলে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সময় চলে যাচ্ছে। দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার। যে কোনো মুহূর্তে সবুজ বাতি জ্বলে উঠতে পারে। সবুজ বাতি জ্বলার পর ট্রেনের পরিচালক সবুজ নিশান উড়িয়ে দেবে। লবণ বেগমের উদ্দেশে কাতর স্বরে বললাম-

: যা করার দ্রুত করতে হবে। লবণ বেগম পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। পুনরায় কিছু বলার জন্য ঠোঁট ফাঁক করতেই লবণ বেগমের নাক ফুলে উঠল। টেনে টেনে কয়েকবার নিঃশ্বাস নিয়ে বলল-: সবকিছু করা শেষ, শুধু ট্রেনের ছাদে উঠাটাই বাকি ছিল। চলো উঠি...: এই রকম রাগ কইরা বললে তো হবে না!: রাগ করি নাই। রাগের মর্ম যে বোঝে, তার সঙ্গে রাগ করা যায়। তোমার সঙ্গে রাগ কইরা লাভ নাই। চল, ট্রেন ছাইড়া দিবে।কথা কখনও কখনও পাথরের চেয়ে ভারী হয়। লবণ বেগমের কথাগুলো সেরকমই মনে হচ্ছে। ভারমুক্ত হওয়ার কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি, লবণ বেগম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল-: এক কাজ করো। তুমি চইলা যাও।: তোমরা যাবা না?: না। : এইটা কী রকম কথা!: এইটা ভালো কথা। তোমার অফিস আছে, তুমি যাও। কয়েকদিন পরে আমি বাচ্চাদের লইয়া বাসে চইলা আসব।

ট্রেন ছাড়ার বাঁশি বাজল। স্ত্রী-পুত্রদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অনেক কষ্টে একটা কামরায় উঠতে সক্ষম হলাম। তবে কিছুদূর যাওয়ার পর অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠল। গফরগাঁও স্টেশনে নির্ধারিত যাত্রাবিরতির পর নিচে নামলাম। এখানেও প্রচুর মানুষ। তারা দরজা-জানালা ভেদ করে ট্রেনের কামরায় ঢোকার প্রাণান্তকর চেষ্টা করছে। দ্বিতীয়বার ট্রেনের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা না করে এক লোকের সহযোগিতায় ছাদে উঠে বসলাম।

ট্রেনের ছাদে বসে আছি। এখন গামছা পার্টি কিংবা দড়ি পার্টির খপ্পরে না পড়লেই হয়! ট্রেন চলছে গজারি বনের ভেতর দিয়ে, সবুজ অন্ধকারের বুক চিরে। উপরের দিকে তাকালাম। আকাশে রজব মাসের নবীন চাঁদ। এ চাঁদ একদিন পূর্ণিমায় যাবে। অমল-ধবল জ্যোৎস্নায় ভাসাবে বিশ্ব চরাচর। সেই আলোয় ভাসবে বাংলাদেশও। আমাদের যোগাযোগ ও যাতায়াত ব্যবস্থাও নিশ্চয়ই একদিন অনেক উন্নত হবে। বিশ্বের ধনী দেশগুলোর মতো আমরাও তখন স্বাচ্ছন্দে ট্রেন ভ্রমণ করব। তখন ট্রেনে স্ট্যান্ডিং প্যাসেঞ্জার বলে কিছু থাকবে না। ট্রেনের ছাদে ভ্রমণ করার কথা ভুলেও কেউ চিন্তা করবে না। এমন দিন আসবে; নিশ্চয়ই আসবে।

লেখক : সাংবাদিক, রম্যলেখক। mokamia@hotmail.com

এইচআর/এমএস