আন্তর্জাতিক

পরমাণু পরীক্ষায় নিষেধাজ্ঞার চুক্তি দুই যুগেও কার্যকর হলো না কেন?

ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানোর মধ্যে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লামিদির পুতিন রাশিয়ার পারমাণবিক বাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়ে উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে তুলেছেন। তার হুঁশিয়ারিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীতে আবারও পরমাণু হামলার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ফলে নতুন করে আলোচনায় উঠে এসেছে দুই যুগেরও বেশি সময় আগে সই হওয়া সর্বাত্মক পারমাণবিক পরীক্ষা নিষিদ্ধকরণ চুক্তি বা সিটিবিটি (কম্প্রিহেনসিভ নিউক্লিয়ার টেস্ট ব্যান ট্রিটি)। এতদিন হয়ে গেলেও আজপর্যন্ত তা কার্যকর না হওয়ার পেছনে হাত রয়েছে বেশ কিছু দেশের, যাদের মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, ইসরায়েল অন্যতম।

Advertisement

সিটিবিটি কী?উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, সিটিবিটি হলো একটি বহুপাক্ষিক চুক্তি, যাতে অস্ত্র পরীক্ষাসহ সামরিক-বেসামরিক যেকোনো ধরনের পারমাণবিক বিস্ফোরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ১৯৯৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয় এটি। কিন্তু এখন পর্যন্ত আটটি দেশ চুক্তি অনুমোদন না করায় তা কার্যকর হয়নি।

পেছনের ঘটনাআন্তর্জাতিকভাবে পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের আন্দোলন শুরু হয়েছিল সেই ১৯৪৫ সালে। কানাডা ও যুক্তরাজ্য এ বিষয়ে একটি সম্মেলন আহ্বানের মাধ্যমে শুরু করে এই উদ্যোগ। ১৯৪৬ সালের জুনে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস. ট্রুম্যানের দূত বার্নাড বারুচ জাতিসংঘের পারমাণবিক শক্তি কমিশনে ‘বারুচ পরিকল্পনা’ উত্থাপন করেন, যেখানে পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনের ওপর একটি আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার আহ্বান জানানো হয়। সেসময় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের পারমাণবিক আধিপত্য নস্যাতে যুক্তরাষ্ট্রের চক্রান্ত দাবি করে প্রস্তাবটি নাকচ করে দেয়।

১৯৪৫ সালের ১৬ জুলাই ট্রিনিটি পারমাণবিক পরীক্ষা এবং ১৯৬৩ সালের ৫ আগস্ট আংশিক পরীক্ষা নিষিদ্ধকরণ চুক্তি (পিটিবিটি) সই হওয়ার মধ্যবর্তী সময়ে বিশ্বজুড়ে ৪৯৯টি পারমাণবিক পরীক্ষা চালানো হয়। এসময় সিটিবিটির পূর্বসূরি হিসেবে পিটিবিটি বিভিন্ন ধরনের পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষার বিরুদ্ধে জনসমর্থন গড়তে কাজ করেছিল। বিশেষ করে, ১৯৫৪ সালের ১ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাসেল ব্রাভো পরীক্ষায় বিস্ফোরণের প্রভাব জনবসতিপূর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়া এবং একদল জাপানি মৎস্যজীবী অসুস্থ হয়ে পড়লে বিষয়টি সবার মনযোগ আকর্ষণ করে।

Advertisement

১৯৪৫ থেকে ১৯৬৩ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক পরীক্ষা চালিয়েছিল ২১৫টি, সোভিয়েত ইউনিয়ন ২১৯টি, যুক্তরাজ্য ২১টি এবং ফ্রান্স চালিয়েছিল অন্তত তিনটি পরীক্ষা। ক্যাসেল ব্রাভো ঘটনার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু পারমাণবিক পরীক্ষার বিষয়ে একটি ‘স্থবিরতা চুক্তি’র আবেদন করেন। অল্প সময়ের মধ্যে একই আহ্বান জানায় ব্রিটিশ লেবার পার্টিও।

১৯৫৫ সালে সাবেক সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভের একটি প্রস্তাবের ভিত্তিতে সর্বাত্মক পরমাণবিক পরীক্ষা নিষিদ্ধকরণের বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়। এতে অংশ নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। সেসময় পশ্চিমাদের ভয় ছিল, সোভিয়েত ইউনিয়ন পারমাণবিক পরীক্ষার নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে গোপনে অস্ত্র প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যেতে পারে। আর সোভিয়েতের দিক থেকে, যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য প্রস্তাবিত পারমাণবিক স্থাপনাগুলো পরিদর্শনের অনুমতিকে গুপ্তচরবৃত্তির পরিণাম হিসেবে দেখা হচ্ছিল।

এসব মতপার্থর্কের কারণে সর্বাত্মক নিষেধাজ্ঞার বদলে আংশিক নিষেধাজ্ঞা (পিটিবিটি) চূড়ান্ত হয়। ১৯৬৩ সালের ২৫ জুলাই উদ্যোক্তা তিন দেশসহ ১২৩টি দেশ পিটিবিটি’তে সম্মত হয়। এতে পানির নিচে, বায়ুমণ্ডলে ও মহাকাশে সামরিক-বেসামরিক পরীক্ষার উদ্দেশ্যে পারমাণবিক বিস্ফোরণ নিষিদ্ধ করা হয়।

পিটিবিটির ফলাফল ছিল মিশ্র। একদিকে চুক্তিটি কার্যকরের পর বায়ুমণ্ডলে তেজস্ক্রিয় কণার ঘনত্ব উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। তবে পারমাণবিক পরীক্ষা বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। ১৯৪৫ থেকে পিটিবিটি সই হওয়া পর্যন্ত যেখানে ৪৯৯টি পরীক্ষা হয়েছিল, সেখানে পিটিবিটি পরবর্তী ১০ বছরে পরীক্ষা চালানো হয় ৪৩৬টি। ১৯৬৪ থেকে ১৯৯৬ সালে সিটিবিটি চুক্তির আগ পর্যন্ত আনুমানিক ১ হাজার ৩৭৭টি ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক পরীক্ষা পরিচালিত হয়। ১৯৮০ সালে সবশেষ ভূপৃষ্ঠস্থ পরীক্ষা চালিয়েছিল চীন।

Advertisement

পিটিবিটি’কে ১৯৬৮ সালের পারমাণবিক সীমিতকরণ চুক্তির (এনপিটি) প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হয়, যেখানে সরাসরি এর কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। এনপিটি’তে পারমাণবিক অস্ত্রবিহীন রাষ্ট্রগুলোর জন্য পারমাণবিক অস্ত্র বা অন্যান্য পারমাণবিক বিস্ফোরক ডিভাইস তৈরি বা অর্জন নিষিদ্ধ করা হয়। পারমাণবিক অস্ত্রধারী রাষ্ট্রগুলোসহ এর সব স্বাক্ষরকারীই সম্পূর্ণ পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের লক্ষ্যে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল। তবে ভারত, পাকিস্তান ও ইসরায়েল ওই চুক্তিতে সই করতে অস্বীকৃতি জানায়। তাদের অভিযোগ ছিল, চুক্তিটি বৈষম্যমূলক। কারণ এতে পরমাণু অস্ত্র নেই এমন দেশগুলোর ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হলেও পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর অস্ত্রধারণ ঠেকাতে কোনো ব্যবস্থা ছিল না।

১৯৭৭ সালের অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সোভিয়েত ইউনিয়ন ফের পারমাণবিক পরীক্ষা নিষিদ্ধকরণের আলোচনা শুরু করে। সত্তরের দশকে তাদের এ আলোচনায় বেশ অগ্রগতি হয়। ১৯৮৫ সালে সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচেভ একতরফাভাবে পারমাণবিক পরীক্ষায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। ১৯৮৬ সালের ডিসেম্বরে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান সর্বাত্মক পারমাণবিক পরীক্ষা নিষেধাজ্ঞার পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন। ১৯৮৭ সালের নভেম্বরে এ বিষয়ে ফের আলোচনা শুরু হয়। সমঝোতাপরবর্তী দশকগুলোতে নানা রাজনৈতিক সংকটের কারণে পারমাণবিক পরীক্ষা নিষিদ্ধকরণ আলোচনা অনেকটা ঝিমিয়ে পড়ে। ১৯৯১ সালে স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হওয়ার আগপর্যন্ত এতে খুব সামান্যই অগ্রগতি হয়েছিল। সেই বছর পিটিবিটি’র স্বাক্ষরকারীরা চুক্তিটিকে সর্বাত্মক নিষেধাজ্ঞায় রূপান্তরিত করতে একটি সংশোধনী সম্মেলনের আয়োজন করে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের দৃঢ় সমর্থনে ১৯৯৩ সালে সিটিবিটির জন্য আলোচনা শুরু হয়।

চুক্তি সইপরের তিন বছর চুক্তির মূলপাঠ ও এর দুটি সংযুক্তি খসড়া তৈরির জন্য ব্যাপক চেষ্টা চালানো হয়। তবে নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলনে চুক্তির মূলপাঠ নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। এরপর অস্ট্রেলিয়া মূলপাঠটি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে পাঠায়, যেখানে এটি খসড়া প্রস্তাব আকারে পেশ করা হয়েছিল। অবশেষে ১৯৯৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর সাধারণ পরিষদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সম্মতিতে সিটিবিটি গৃহীত হয়।

চুক্তির বাধ্যবাধকতারাষ্ট্রগুলো কোনো পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা বা অন্য কোনো পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটাবে না। প্রতিটি রাষ্ট্রের এখতিয়ার বা নিয়ন্ত্রণে থাকা যেকোনো জায়গায় এ ধরনের পারমাণবিক বিস্ফোরণ নিষিদ্ধ।

প্রতিটি রাষ্ট্র অন্যদের পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা বা অন্য কোনো পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটানো, এতে উৎসাহিত করা বা যেকোনো উপায়ে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকবে।

চুক্তির অবস্থা১৯৯৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গৃহীত হওয়ার পর ওই বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে এটি স্বাক্ষরের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। সেসময় পারমাণবিক শক্তিধর আট দেশের মধ্যে পাঁচটিসহ মোট ৭১টি দেশ এতে সই করে। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১৭০টি দেশ সিটিবিটি’তে সই করার পাশাপাশি এর অনুমোদন দিয়েছে। ১৫টি দেশ সই করলেও এখনো অনুমোদন দেয়নি। দ্বিতীয় সংযুক্তিতে (অ্যানেক্স ২) তালিকাভুক্ত ৪৪টি দেশ অনুমোদন দেওয়ার ১৮০ দিন পরে চুক্তিটি কার্যকর হবে। এই দ্বিতীয় সংযুক্তির দেশগুলো হলো তারা, যারা ১৯৯৪ ও ১৯৯৬ সালের মধ্যে সিটিবিটি’র আলোচনায় অংশ নিয়েছিল এবং সেই সময়ে পারমাণবিক বিদ্যুৎ চুল্লি বা গবেষণা চুল্লির অধিকারী ছিল। ২০১৬ সাল পর্যন্ত এ ধরনের আটটি দেশ চুক্তিটি অনুমোদন করেনি। এর মধ্যে চীন, মিসর, ইরান, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি সই করেছে কিন্তু অনুমোদন দেয়নি এবং ভারত, উত্তর কোরিয়া ও পাকিস্তান এতে সইও করেনি।

বাংলাদেশ ১৯৯৬ সালের ২৪ অক্টোবরই সিটিবিটি’তে সই করে এবং ২০০০ সালের ৮ মার্চ এতে অনুমোদন দেয়। বর্তমানে যুদ্ধরত রাশিয়া ও ইউক্রেন উভয়ই এ চুক্তিতে সইয়ের পাশাপাশি অনুমোদন দিয়েছে।

কেএএ/জিকেএস