রাশিয়ার আক্রমণের মুখে ইউক্রেন ছেড়ে প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয়ের জন্য ছুটছেন লাখ লাখ মানুষ। এদের মধ্যে ইউক্রেনীয়দের পাশাপাশি বহু বিদেশি শিক্ষার্থীও রয়েছেন। তবে সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার বেলায় তারা ইউক্রেনীয় নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে বর্ণবাদী আচরণের শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। বেছে বেছে ইউক্রেনীয় নাগরিকদের গাড়িতে তুলে সীমান্ত পার করানো হচ্ছে এবং বিদেশিদের দাঁড় করিয়ে রাখা, এমনকি নির্যাতন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন অনেকে। এ নিয়ে বিবিসি, সিএনএন, আল-জাজিরাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
Advertisement
এক আফ্রিকান মেডিক্যাল শিক্ষার্থী সিএনএন’কে বলেছেন, ইউক্রেন-পোল্যান্ড সীমান্তের একটি চেকপয়েন্টে তাকেসহ অন্য বিদেশিদের বাস থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের রেখে বাসটি শুধু ইউক্রেনীয়দের নিয়েই চলে যায় বলে অভিযোগ করেছেন তিনি।
পশ্চিম ইউক্রেনের লভিভ শহরের একটি মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী রাচেল ওনিগবুলে রাজধানী কিয়েভ থেকে প্রায় ৪০০ মাইল দূরবর্তী সীমান্ত শহর শেহিনিতে আটকা পড়েছিলেন। তিনি বলেন, ১০টির বেশি বাস এসেছিল। আমরা দেখছিলাম, সবাই চলে যাচ্ছে। ভেবেছিলাম, তারা সব ইউক্রেনীয়কে নেওয়ার পরে এসে আমাদের নিয়ে যাবে। কিন্তু আমাদের বলা হয়, আর কোনো বাস নেই, হেঁটেই যেতে হবে।
২৮ ফেব্রুয়ারি হাঙ্গেরি-ইউক্রেন সীমান্তে অপেক্ষমান একদল শিক্ষার্থী। ছবি সংগৃহীত
Advertisement
নাইজেরীয় এ শিক্ষার্থী গত রোববার টেলিফোনে সিএনএন’কে বলেন, আমার শরীর ঠান্ডায় অসাড় হয়ে গিয়েছিল। আমরা প্রায় চার দিন ধরে ঘুমাইনি। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রতিটি পয়েন্টে ইউক্রেনীয়রা অগ্রাধিকার পেয়েছে। জিজ্ঞেস করার দরকার নেই কেন। আমরা জানি কেন। আমি শুধু বাড়ি ফিরতে চাই। রাচেল জানান, ঘটনাক্রমে সোমবার ভোরে তিনি সীমান্ত পার হওয়ার অনুমতি পান।
মারধরের অভিযোগসোমবার লভিভ থেকে টেলিফোনে ভারতের চতুর্থ বর্ষের মেডিক্যাল শিক্ষার্থী সাক্ষী ইজান্তকারও ইউক্রেন সীমান্তে নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন। তিনি বলেন, সীমান্ত পেরোতে তিনটি চেকপোস্ট পার হওয়া লাগে। আপনাকে প্রথম চেকপয়েন্ট থেকে দ্বিতীয় চেকপয়েন্টে যেতে চার থেকে পাঁচ কিলোমিটার হাঁটতে হবে। ইউক্রেনীয়দের যাওয়ার জন্য ট্যাক্সি ও বাস দেওয়া হচ্ছে, অন্য নাগরিকদের হাঁটতে হচ্ছে। ভারতীয়সহ অন্য দেশের নাগরিকদের সঙ্গে তারা খুবই বর্ণবাদী আচরণ করছে।
সাক্ষী বলেন, ৫০০ ইউক্রেনীয় যাওয়ার পর তারা ৩০ জন ভারতীয়কে যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছে। সেখানে প্রচুর লোক আটকা পড়েছে।
২৭ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন-পোল্যান্ড সীমান্তের মেদিকা ক্রসিং পার হওয়ার অপেক্ষায় কিছু শিক্ষার্থী। ছবি সংগৃহীত
Advertisement
ভারতীয় এ শিক্ষার্থী জানান, তিনি শেহিনি-মেডিকা সীমান্তে ইউক্রেন অংশের নিরপত্তা রক্ষীদের অপেক্ষমান শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন করতে দেখেছেন।
রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ চলাকালে ১৮ থেকে ৬০ বছর বয়সী ইউক্রেনীয় পুরুষদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে ডিক্রি জারি করেছে ইউক্রেন সরকার। তবে এই আদেশ বিদেশি নাগরিকদের জন্য প্রযোজ্য নয়।
সাক্ষী ইজান্তকার বলেছেন, তিনি দেখেছেন, ভারতীয় পুরুষসহ অন্য অ-ইউক্রেনীয় নাগরিকদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, ওরা খুবই নির্দয়। দ্বিতীয় চেকপয়েন্ট ছিল সবচেয়ে খারাপ। তারা যখন সীমান্ত পার হওয়ার জন্য গেট খুলে দেয়, আপনি ইউক্রেন ও পোল্যান্ডের মাঝামাঝি থাকেন, ওখানে গেলে ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী ভারতীয় পুরুষ ও ছেলেদের আর পার হতে দেয় না। তারা শুধু ভারতীয় মেয়েদের ঢুকতে দিচ্ছিল। কার্যত, আমরা তাদের পায়ে ধরে কেঁদেছি আর সাহায্য চেয়েছি। ভারতীয় মেয়েরা ঢোকার পর ছেলেদের মারধর করা হয়। এমন নিষ্ঠুরতার সঙ্গে আমাদের পেটানোর কোনো কারণই ছিল না।
My heart goes out to the Indian students suffering such violence and their family watching these videos. No parent should go through this. GOI must urgently share the detailed evacuation plan with those stranded as well as their families. We can’t abandon our own people. pic.twitter.com/MVzOPWIm8D
— Rahul Gandhi (@RahulGandhi) February 28, 2022সাক্ষী বলেন, আমি এক মিসরীয় নাগরিককে রেলিংয়ের ওপর হাত রেখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম এবং সেই কারণে এক প্রহরী তাকে এত জোরে ধাক্কা দেয় যে, লোকটি কাঁটাতারের বেড়ার ওপর ছিটকে পড়ে জ্ঞান হারায়। আমরা তাকে সিপিআর দেওয়ার জন্য বাইরে নিয়ে গিয়েছিলাম। ওরা (ইউক্রেনীয় রক্ষী) কোনো কিছুর পাত্তা দিচ্ছে না। তারা ছাত্রদের মারধর করছে, আমাদের সঙ্গে দুটো কথাও বলেনি, শুধু ইউক্রেনীয়দের খেয়াল করছে।
ভারতীয় ওই শিক্ষার্থী জানান, সীমান্তে অন্তত একদিন অপেক্ষা করে শেষপর্যন্ত লভিভে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। প্রবল শীতের মধ্যে গরম কাপড় ও খাবার-পানি না থাকায় তার মতো আরও অনেকেই ফিরে গেছেন।
এ বিষয়ে জানতে সিএনএনের পক্ষ থেকে ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। তবে তাতে সাড়া পাওয়া যায়নি। ইউক্রেনীয় বর্ডার গার্ড সার্ভিসের মুখপাত্র অ্যান্ড্রি ডেমচেঙ্কো অবশ্য দাবি করেছেন, সীমান্তে বর্ণবাদী আচরণ ও হয়রানির অভিযোগ সত্য নয়। তাদের কর্মকর্তারা প্রচণ্ড চাপের মধ্যেও আইন মেনেই কাজ করছেন।
কেএএ/এএসএম