ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান নিয়ে তুলকালাম শুরু হয়েছে পশ্চিমা দেশগুলোতে। রুশ বাহিনীর আগ্রাসী আচরণের নিন্দায় সরব যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডার মতো দেশগুলো। সেসব দেশের মিডিয়াতে রীতিমতো ধুয়ে ফেলা হচ্ছে ভ্লাদিমির পুতিন ও তার বাহিনীকে। ভুক্তভোগী ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার ঝড় বইয়ে দিচ্ছে পশ্চিমারা। অথচ এই দেশগুলোই ফিলিস্তিন, ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া যুদ্ধের ক্ষেত্রে চোখে যেন টিনের চশমা পরে থাকে। আজ ইউক্রেনের সাধারণ মানুষ রুশ আক্রমণ ঠেকাতে হাতে অস্ত্র তুলে নিলে তাদের ‘বীর মুক্তিকামী যোদ্ধা’ বলছে পশ্চিমারা, অথচ ফিলিস্তিনের মানুষ হাতে গুলতি ওঠালেও তা তাদের কাছে ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড’ হয়ে যায়। ইউক্রেন যুদ্ধ যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, পশ্চিমারা কতটা ‘হিপোক্রেট’।
Advertisement
গত বছর আল-আকসা মসজিদে ইসরায়েলি সশস্ত্র পুলিশের তাণ্ডব, জেরুজালেমের শেখ জাররাহ এলাকায় ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করে অবৈধ ইহুদি বসতি স্থাপন ও গাজায় ইসরায়েলি বিমান হামলা ঘিরে পশ্চিমা মিডিয়ার খবর এবং এখন রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের খবরের শিরোনাম পড়লেই তাদের দ্বিমুখী নীতি পরিষ্কার হয়ে ওঠে।
If you support Ukraine But not Palestine , Syria , Libya, Lebanon and Iraq. If you condemn Russia But not Israel, US and NATO.Then congratulations mate, you are on the highest tier of hypocrisy. #RussiaUkraine #RussianUkrainianWar #UkraineRussiaWar pic.twitter.com/z9PfuVEVaE
—Kesse (@King_Kesse) March 2, 2022বছরের পর বছর ধরে নিরীহ-নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলিদের বর্বরোচিত আচরণের খবর পশ্চিমের প্রায় সব সংবাদমাধ্যমেই প্রচার হয়। তবে কিছুটা ভিন্নভাবে। তাদের ‘প্রচার স্টাইলে’ আগ্রাসনবাদীর শক্তি প্রয়োগ অনেকটাই আড়াল করে রাখা হয়। ফিলিস্তিন-ইসরায়েল ইস্যুতে পশ্চিমা মিডিয়ার খবর ও নেতাদের কথাবার্তায় দখলদারি, গুলি করে হত্যা, গুলিবর্ষণ এবং বোমা হামলার মতো ঘটনাগুলোতে ‘ক্ল্যাশ’ (সংঘর্ষ), ‘কনফ্লিক্ট’ (সংঘাত) ও ‘প্রোপার্টি ডিসপুট’র (সম্পত্তি বিরোধ) মতো শব্দ ব্যবহার করতে দেখা যায়। এ ধরনের ‘প্যাসিভ ভয়েস’র ব্যবহারের মধ্য দিয়ে সহিংসতার ‘কারণ’ বা ‘টার্গেট’ চেপে যাওয়া হয়।
Advertisement
কিন্তু এখন ইউক্রেন সংঘাতের ক্ষেত্রে তারা ঠিকই ‘অ্যাগ্রেসন’ (আগ্রাসন), ‘ইনভেশন’ (আক্রমণ), ‘অ্যাটাক’ (হামলা), ‘কিল’ (হত্যা), ‘ইলিগ্যাল স্টেপ’ (অবৈধ পদক্ষেপ)-এর মতো শব্দ ব্যবহার করছে, যা ইসরায়েলের ক্ষেত্রেও হওয়ার কথা ছিল। মজার বিষয় হচ্ছে, এতদিন ধরে নিরীহ ফিলিস্তিনিদের হত্যা করা, তাদের জমি কেড়ে নেওয়া সেই ইসরায়েলই আজ রাশিয়ার কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানাচ্ছে, তাদের শান্তি বজায় রাখতে বলছে।
Nobody trust western media untill they start exposing Israel. And start declaring Israel as a war criminal. Palestine should get its land back. Calling Palestinian terrorist and Ukrainian heroes is just double standards #UNSecurityCouncil#Kharkiv#Ukraine #RussianUkrainianWar pic.twitter.com/qc3gcID731
— Voice For Ummah (@voiceforummah) March 2, 2022অবশ্য ইউক্রেনীয় মিত্রদের জন্য ইসরায়েলের এই ‘মন পোড়ার’ যথেষ্ট কারণও রয়েছে। গত বছর অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের বর্বরোচিত হামলার সময় ফিলিস্তিনি প্রতিরোধযোদ্ধাদের পাল্টা জবাবের সমালোচনা করে ইসরায়েলিয়েদের পক্ষ নিয়েছিলেন আজকের ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। ওই যুদ্ধে ইসরায়েলই ‘ভিকটিম’ (ভুক্তভোগী) বলে দাবি করেছিলেন তিনি। অথচ সেই সময় টানা ১১ দিনের ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ২৬০ ফিলিস্তিনি নিহত হন, যাদের মধ্যে ৬৭ জনই ছিল কোমলমতি শিশু। এগুলো জেলেনস্কির নজরে পড়েনি, হামলা ঠেকাতে হামাস যে রকেট ছুড়েছিল, পশ্চিমাদের মতো তিনিও শুধু সেটিই দেখেছেন।
The sky of #Israel is strewn with missiles. Some cities are on fire. There are victims. Many wounded. Many human tragedies. It is impossible to look at all this without grief and sorrow. It is necessary to stop the escalation immediately for the sake of people's lives.
Advertisement
রুশ আক্রমণের মধ্যে ইউক্রেনীয়দের আরও একটি বিষয় সামনে আসছে, তা হলো ‘বর্ণবাদী আচরণ’। বিবিসি, আল-জাজিরাসহ বিভিন্ন মিডিয়ায় খবর এসেছে, যুদ্ধের কারণে দেশত্যাগে আগ্রহীদের বেছে বেছে সীমান্ত পার করাচ্ছে ইউক্রেন। কৃষ্ণাঙ্গদের ট্রেনে উঠতে দেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। ভারতীয় শিক্ষার্থীদের গায়ে হাত তোলার ভিডিও পর্যন্ত সামনে এসেছে।
যে ইউক্রেন বিদেশিদের সীমান্ত পার হতে বাধা দিচ্ছে, তারাই আবার নিজেদের রক্ষা করতে বিদেশিদের কাছেই বারবার আকুতি জানাচ্ছে, আরও নির্দিষ্ট করে বললে পশ্চিমাদের কাছে। পশ্চিমারাও তাতে গলে যাচ্ছেন। সাদা চামড়া-নীল চোখের ইউক্রেনীয়দের জন্য মুখে মুখে হলেও প্রতিবাদের ঝড় তুলছেন তারা, যা ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান, লিবিয়ার ক্ষেত্রে খুব একটা দেখা যায়নি।
“This isn’t a place, with all due respect, like Iraq or Afghanistan…this is a relatively civilized &relatively European -I have to choose those words carefully-city” No respect and no words chosen carefully. Honest devalument of the non-European life. pic.twitter.com/6qHXp2SrX3
— mahsa alimardani مثلا (@maasalan) February 26, 2022সাম্প্রতিক রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে পশ্চিমের বিভিন্ন মিডিয়ায় বর্ণবিদ্বেষী মন্তব্য বিতর্ক তৈরি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সিবিএস নিউজের ফরেন করেসপন্ডেন্ট চার্লি ডি’আগাতা তো বলেই দিয়েছেন, এটি ইরাক বা আফগানিস্তানের মতো জায়গা নয়, যেখানে কয়েক দশক ধরে সংঘাত চলছে। এটি ‘তুলনামূলক সভ্য, তুলনামূলক ইউরোপীয়’ একটি শহর, যেখানে এমন কিছু আশা করা যায় না। অর্থাৎ, ইরাক-আফগানিস্তানে যুদ্ধ হলে তা ঠিক আছে, কিন্তু তথাকথিত ‘সভ্য ইউরোপীয়’ দেশে যুদ্ধ মেনে নেওয়া যায় না।
“We’re not talking here about Syrians fleeing the bombing of the Syrian regime backed by Putin, we’re talking about Europeans leaving in cars that look like ours to save their lives.”Just when you thought you’ve seen it all in this world. Beyond belief. pic.twitter.com/8COA7arGP5
— Rayane Moussallem (@RioMoussallem) February 26, 2022একই ধরনের কথা এসেছে ফ্রান্সের বিএফএমটিভি’তেও। সেখানে এক বিশ্লেষক বলেছেন, ‘আমরা এখানে পুতিনসমর্থিত সিরীয় সরকারের হামলা থেকে পালানো সিরীয়দের কথা বলছি না, আমরা ইউরোপীয়দের কথা বলছি, যারা দেখতে আমাদের মতো।’
[Thread] The most racist Ukraine coverage on TV News. 1. The BBC - “It’s very emotional for me because I see European people with blue eyes and blonde hair being killed” - Ukraine’s Deputy Chief Prosecutor, David Sakvarelidze pic.twitter.com/m0LB0m00Wg
— Alan MacLeod (@AlanRMacLeod) February 27, 2022ইউক্রেনের সাবেক ডেপুটি জেনারেল প্রসিকিউটর ডেভিড সাকভারেলিডজে বিবিসি’তে বলেছেন, ‘এটি আমার জন্য খুবই আবেগপ্রবণ বিষয়। কারণ, আমি দেখছি স্বর্ণকেশী, নীল চোখওয়ালা ইউরোপীয় মানুষেরা প্রতিদিন পুতিনের ক্ষেপণাস্ত্র, হেলিকপ্টার ও রকেট হামলায় নিহত হচ্ছে।’ অর্থাৎ, স্বর্ণকেশী-নীল চোখের মানুষ মরতে দেখে তার দরদ উতলে উঠছে, অন্য বর্ণের লোক হলে হয়তো তা হতো না।
যুদ্ধ আমাদের কারোরই কাম্য নয়। ইউরোপের সাদা চামড়ার মানুষ হোক বা ফিলিস্তিনের মুসলিম- নিরপরাধ মানুষ মারা যাক, তা আমরা কেউই চাই না। আজ রাশিয়ার আক্রমণের মুখে জেলেনস্কি যেমন বুঝতে পারছেন, প্রকৃত আগ্রাসন কাকে বলে, তেমন বোধোদয় পশ্চিমাদেরও হোক- এমনটাই আশা করি।
কেএএ/জিকেএস