দেশজুড়ে

সড়কের অভাবে পর্যটক পায় না রেমা কালেঙ্গা

এখনও পর্যটকদের দৃষ্টি কাড়তে পারেনি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বনাঞ্চল হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার রেমা কালেঙ্গা অভয়ারণ্য। বন বিভাগের লোকবল সংকট, মাত্র কয়েক কিলোমিটার রাস্তা না থাকা আর পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধার অভাবে নয়নাভিরাম এ বনকে পূর্ণ পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে না। স্থানীয় জনগণের সহযোগিতায় নৈসর্গিক সৌন্দর্যমণ্ডিত এ বনাঞ্চলের গাছচুরি কিছুটা বন্ধ হলেও পুরো রোধ করাও সম্ভব হয়নি।

Advertisement

রেমা কালেঙ্গার রেঞ্জের বন কর্মকর্তা খলিলুর রহমান জানান, এ বনটি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বনাঞ্চল। সুন্দরবনের পরই এর অবস্থান। এখানে ৬শ প্রজাতির গাছ, ২১৫ প্রজাতির পাখি ও ৩৯ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী আছে। এটি অত্যন্ত নয়নাভিরাম একটি বন। পর্যটকদের থাকার জন্যও ব্যবস্থা আছে এখানে। একটি কটেজ নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু যাতায়াত ব্যবস্থা অত্যন্ত খারাপ হওয়ায় তেমন পর্যটক এখানে আসে না।

তিনি বলেন, এ বনে ৪টি বিট অফিস রয়েছে। অথচ এত বড় একটি বনের রক্ষায় আছে মাত্র ২৪ জন লোক। আমাদেরকে ভিলেজারদের (বনের গ্রামবাসী) সহায়তা নিয়ে বনটি রক্ষায় কাজ করতে হচ্ছে।

কালেঙ্গা বনাঞ্চলের বাসিন্দা ভিলেজার মো. ইসমাইল হোসেন জানান, এ বনে যা আছে তা অনেক বনেই নেই। শুধু সুন্দরবনেই এসব পাওয়া যায়। পর্যটকদের থাকার জন্য কটেজও আছে। কিন্তু সব থাকলেও শুধু রাস্তার সুবিধার জন্য এখনও তেমন পর্যটক আসে না।

Advertisement

তিনি বলেন, এখানে শুধু খাওয়ার কোনো হোটেল নেই। পর্যটকরা অর্ডার দিলে আমরা রান্না করে দিই।

ইকো গাইড ফয়জুল্লাহ্-আল নোমান জানান, এখানে যে পরিমাণ পর্যটক আসেন তাদের নিকট টিকিট বিক্রি করে যে আয় হয় তা থেকে কাউন্টারের ম্যানেজারের বেতনই হয় না। খরচ চালানো অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে।

তিনি বলেন, কালেঙ্গা অভয়ারণ্যটিতে কোনো রাস্তা নেই। এটি চুনারুঘাট শহর থেকে অনেক ভেতরে গহীন অরণ্যে পড়েছে। এখানে যাতায়াত ব্যবস্থাও ভালো না। যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো হলে হয়তো পর্যটক বাড়বে। এতে বনের যেমন আয় বাড়বে, তেমনি সরকার ভালো রাজস্ব পাবে।

বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, সুন্দরবনের পরই দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ বনাঞ্চল হিসেবে পরিচিত রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্য। বনটি ১৪ হাজার ৬৩২ একর এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। এর মধ্যে প্রায় ৩ হাজার ৬শ একর এলাকাকে ১৯৯৬ সালে বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বনটির বিস্তৃতি রয়েছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত পর্যন্ত। জেলা সদর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে চুনারুঘাট উপজেলার গাজীপুর ও রাণীগাঁও ইউনিয়নে এর অবস্থান।

Advertisement

চুনারুঘাট উপজেলা সদর থেকে এর দূরত্ব প্রায় ১৫ কিলোমিটার। এর মধ্যে ৭ কিলোমিটার রাস্তা কাঁচা ও সরু। শুষ্ক মৌসুমে রাস্তায় শুধু বালি আর বালি, বর্ষায় জমে থাকে কাদা। রাস্তা এত সরু যে গাড়িতে যাতায়াত করা বেশ কষ্টকর হয়ে পড়ে। এ রাস্তায় যাতায়াতের সহজ মাধ্যম মোটরসাইকেল ও অটোরিকশা।

বৃহৎ এ বন রক্ষায় ৪টি বিট অফিস থাকলেও রয়েছে প্রচণ্ড লোকবল সংকট। এখানে বনরক্ষী কমপক্ষে ৬০ জনের প্রয়োজন হলেও আছে মাত্র ২৪ জন। তাদেরও নেই প্রয়োজনীয় যানবাহন ও অস্ত্রশস্ত্র। বনে নেই কোনো বিদ্যুৎ ব্যবস্থা। ফলে সন্ধ্যা হলেই বিট অফিসসহ পুরো বনাঞ্চল নিঝুম অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়।

সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, বনটি এক সময় গাছচোরদের অভয়ারণ্য ছিল। ১১টি বনদস্যু বাহিনীর নেতৃত্বে দুই সহস্রাধিক গাছচোর অপরাধ সংঘটিত করে আসছিল। কী পরিমাণ গাছ চুরি হয়েছে তার প্রকৃত কোনো হিসাব কারও কাছে নেই। তাদের হামলায় বিভিন্ন সময় আহত হয়েছে বনরক্ষীসহ গ্রামবাসী। অনেকের প্রাণও গেছে।

২০১১ সালে স্থানীয় জনগণের উদ্যোগে বন রক্ষায় গাছচোরদের সম্পৃক্ত করে সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তাদের মামলা মোকদ্দমা থেকে রক্ষা করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে দেওয়া হয়। এর ফলে গাছ চুরি কিছুটা কমেছে। তবে তা একেবারে বন্ধ হয়নি। ১১ ফেব্রুয়ারিও রেমা কালেঙ্গায় গাছ কাটা অবস্থায় এক বনদস্যুকে আটক করে র্যাব। তার কাছ থেকে গাছ কাটার যন্ত্র ও দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করা হয়।

এদিকে এত বড় একটি অভয়ারণ্য। এখানে আশপাশে কয়েক কিলোমিটারের মাঝে বড় কোনো বাজার নেই। খাবারের জন্য কোনো ভালো মানের হোটেলও নেই।

যেভাবে যাওয়া যাবে রেমা কালেঙ্গা অভায়ারণ্যে

বাংলাদেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে বাসে বা ট্রেনে হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জে পৌঁছাতে হবে। শায়েস্তাগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশন থেকে ১০ টাকা জনপ্রতি (ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক) টমটমে করে শায়েস্তাগঞ্জ নতুন ব্রিজ। আর বাসে হলে নামতে হয় নতুন ব্রিজে। সেখান থেকে ২০ টাকা সিএনজি অটোরিকশায় ভাড়ায় চুনারুঘাট মধ্যবাজার। সরাসরি ৭০ টাকা সিএনজিভাড়ায় কালেঙ্গা বাজার নেমে ১০-১৫ মিনিট হাঁটলেই রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য মেইন গেটে পৌঁছে যাবেন।

এছাড়া সরাসরি শায়েস্তাগঞ্জ থেকে কালেঙ্গা অভয়ারণ্যে যেতে চাইলে অটোরিকশা ভাড়া করে ৬০০ থেকে ৮০০ টাকায় যাওয়া আসা করা যায়। এছাড়া ঢাকা থেকে বাস বা ট্রেনে শ্রীমঙ্গল নেমেও সেখান থেকে জিপ নিয়ে রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্যে পৌঁছানো যায়। শ্রীমঙ্গল থেকে বনের ভেতর দিয়ে কালেঙ্গা যাওয়ার পথটি বেশ সুন্দর। জিপ ভাড়া লাগবে ২ হাজার থেকে ৩ হাজার টাকা।

সুযোগ সুবিধা

এখানে থাকার জন্য ২টি কটেজ রয়েছে। ছোট এক কক্ষের কটেজটি প্রতি রাতে ১ হাজার টাকা। আর বড় কটেজটিতে রয়েছে ৪টি কক্ষ। প্রতিটি কক্ষ ১ হাজার টাকা ভাড়া প্রতি রাতের জন্য। খাবারের জন্য বনে ইকো গাইডদের অর্ডার দিলে তারা রান্না করে দেন। এখানে একটি সরকারি রেস্ট হাউস আছে যা ভাড়া দেওয়া হয় না।

বনে যা আছে

এই অভয়ারণ্যে ৬৩৮ প্রজাতির উদ্ভিদ, গাছ-পালা, লতা-পাতা আছে। উল্লেখযোগ্য উদ্ভিদগুলোর মধ্যে রয়েছে- আওয়াল, সেগুন, কাঁকড়, নেউড়, হারগাজা, গন্ধরই, হরতকী, বহেরা, জাম ডুমুর, কাঁঠাল, চামকাঁঠাল, কাউ, কদম, রাতা, চিকরাশি, চাপালিশ, নিম, বনমালা ইত্যাদি।

আরও আছে ৭ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ১৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ১৬৭ প্রজাতির পাখি। উল্লেখযোগ্য পাখিগুলো হচ্ছে ভিমরাজ, পাহাড়ি ময়না, কাও ধনেশ, বনমোরগ, ফোটা কান্টি সাতভারলা, শ্যামা, শালিক, শামুক খাওরি, টুনটুনি ইত্যাদি।

৩৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- কালো বন্য শুকর, সাদা বন্য শুকর, বানর, হনুমান, মুখপোড়া হনুমান, খরগোশ, হরিণ, মেছোবাঘ, মেছোবিড়াল, বনকুকুর প্রভৃতি। তবে হরিণ দেখতে হলে খুব ভোরে নিঃশব্দে হাঁটতে হবে। অন্যান্য প্রাণী সাধারণত দিনের বেলায়ও দেখা যায়।

বন দেখবেন যেভাবে

রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে আছে আধা ঘণ্টা, এক ঘণ্টা ও তিন ঘণ্টার তিনটি ট্রেইল বা পথ। প্রতিটি ছবির মতো সুন্দর আর সাজানো। অভয়ারণ্যের ভেতরে আছে সুউচ্চ একটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। টাওয়ারের উপর থেকে দেখা যায় বনের ভেতরের দূর-দূরান্তের দৃশ্যাবলী। টাওয়ারের নিচেই আছে আঁকাবাঁকা একটি মনোরম লেক।

এফএ/জেআইএম