চট্টগ্রাম-ইতালি রুটে পরীক্ষামূলকভাবে সরাসরি কনটেইনারবাহী জাহাজ চলাচল শুরু হয় গত বছরের শেষের দিকে। যাত্রায় সফল হলে এ বছরের শুরুর দিকে রপ্তানি পণ্যবোঝাই কনটেইনারবাহী একটি জাহাজ চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ইতালির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। এর মধ্যদিয়ে চট্টগ্রাম-ইতালি রুটে সরাসরি পণ্য নিয়ে জাহাজ চলাচল শুরু হয়। সবশেষ ছেড়ে যাওয়া জাহাজটির রেখে যাওয়া কিছু কনটেইনার নিয়ে মার্চের শুরুর দিকে অপেক্ষাকৃত ছোটো একটি জাহাজ সরাসরি ইতালির উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার কথা রয়েছে।
Advertisement
চট্টগ্রাম-ইতালি রুটে সরাসরি পণ্য পরিবহনে খরচ কমছে ব্যবসায়ীদের। সময়ও বাঁচছে অনেক। একসময় ইউরোপে পণ্য পৌঁছাতে ৩০ থেকে ৪০ দিন সময় লাগলেও এখন ২০ দিনের মধ্যে পণ্য পৌঁছানো যাচ্ছে। সবমিলিয়ে এই রুটে নতুন জাহাজ চলাচলের ক্ষেত্রে আগ্রহী হতে দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন শিপিংলাইনকে। নেদারল্যান্ডস, পর্তুগালসহ বিভিন্ন দেশের পক্ষ থেকে সরাসরি পণ্য পরিবহনে আগ্রহী হতে দেখা গেছে। তাদের পক্ষ থেকে বন্দর কর্তৃপক্ষ, ব্যবসায়ী এবং সংশ্লিষ্টদের কাছে এরই মধ্যে বৈঠকের আহ্বানও জানানো হয়েছে।
সবশেষ চট্টগ্রাম-ইতালি রুটে কনটেইনারবাহী জাহাজ পরিচালনার উদ্যোগ নিয়েছে ‘সি কনসোর্টিয়াম বাংলাদেশ লিমিটেড’ নামের একটি কোম্পানি। নির্দিষ্ট তারিখ জানানো না হলেও মার্চেই তাদের সার্ভিস চালু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এই রুটে নতুন করে জাহাজ পরিচালনার উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন ব্যবসায়ী ও বন্দর ব্যবহারকারীরা। তারা এটিকে দেশের অর্থনীতির জন্য সুখবর বলে জানিয়েছেন। এর মধ্যদিয়ে ইউরোপের বাজারে দেশের পোশাকের নতুন নতুন বাজার সৃষ্টি হবে বলেও আশাবাদী ব্যবসায়ীরা।
Advertisement
জানা গেছে, ১৯৭৭ সালে কনটেইনারে পণ্য পরিবহন শুরু হয়। এরপর থেকে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কনটেইনার নিয়ে জাহাজ প্রথমে সিঙ্গাপুর, কলম্বো ও মালয়েশিয়ার বন্দরে যেতো। সেখানে মাদার ভেসেলে করে কনটেইনার যেতো ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর সৃষ্ট লকডাউনকে কেন্দ্র করে নানা সময় জট লাগে ট্রান্সশিপমেন্ট এসব বন্দরে।
গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে ভয়াবহ জট লাগে ওই বন্দরগুলোতে। চট্টগ্রাম বন্দরে কোনো জট না থাকলেও ওই কারণে নির্ধারিত সময়ে পণ্য হাতে পাচ্ছিলেন না ইউরোপের ক্রেতারা। তখন থেকে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ইউরোপে সরাসরি কনটেইনার পরিবহন করার আহ্বান জানানো হয় ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন মহল থেকে। তবে এটি মোটেও সহজ ছিল না। কারণ রপ্তানি-আমদানির ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষা করে সরাসরি জাহাজ পরিচালনায় নানা জটিলতা রয়েছে।
তবে জটিলতা থাকলেও একপর্যায়ে চট্টগ্রাম-ইতালি রুটে পরীক্ষামূলক যাত্রা শুরু হয়। গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর খালি কনটেইনার নিয়ে ‘ক্যাপ ফ্লোরেস’ নামে একটি জাহাজ পরীক্ষামূলকভাবে এই রুটে যাত্রা করে। যাত্রা সফল হওয়ায় এই রুটে জাহাজে সরাসরি পণ্য পরিবহনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরপর গত ১৭ জানুয়ারি ইতালির রেভেনা বন্দর থেকে ৯৪৫ টিইইউএস (২০ ফুট দৈর্ঘ্যের একক) খালি কন্টেইনার এবং ৭ টিইউউএস গার্মেন্টস কাঁচামাল নিয়ে ‘সোঙ্গা চিতা’ জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। ৫ ফেব্রুয়ারি জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছায়।
দুদিন পর ৭ ফেব্রুয়ারি ৯৫২ টিইইউএস ককনটেইনার নিয়ে আবার সোঙ্গা চিতা জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ইতালির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। এরপর ২৭ ফেব্রুয়ারি গন্তব্যে পৌঁছে চিতা। ইতিহাস রচনার ওই যাত্রার উদ্বোধনের সময় উপস্থিত ছিলেন- চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান, চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলম, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অ্যাম্বাসেডর চার্লস স্টুয়ার্ট হোয়াইটলি, ইতালির অ্যাম্বাসেডর এনরিকো নুনজিয়াতাও এবং তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সভাপতি ফারুক হাসান।
Advertisement
এদিকে বন্দর সূত্র জানায়, সময়মতো পণ্য বোঝাই না হওয়ায় সোঙ্গা চিতা জাহাজ ৩১ টিইইউস কনটেইনার ফেলে যায়। ফেলে যাওয়া এসব কনটেইনার এবং নতুন করে আরও ৯৭ টিইইউস কনটেইনার পণ্য ইতালি যাওয়ার জন্য চট্টগ্রাম বন্দরে আসছে জাহাজ ‘এএসটি মাল্টা’। আগামী ২ মার্চ জাহাজটির চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছানোর কথা রয়েছে। এরপর ১২৮ টিইইউস কনটেইনার পণ্য সরাসরি নিয়ে জাহাজটি সরাসরি যাবে ইতালিতে। যদিও জাহাজটি নিয়মিত চীন-ইতালি রুটে চলাচল করে।
আবার, চট্টগ্রাম-ইউরোপ রুটে জাহাজ সার্ভিস চালুর উদ্যোগ নিয়েছে সি কনসোর্টিয়াম বাংলাদেশ লিমিটেড। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ও ব্যবসায়ীরা তাদের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। বর্তমানে কোম্পানিটি এই রুটে যাত্রার ক্ষেত্রে সম্ভাব্যতা যাচাই করছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে মার্চেই তাদের যাত্রা শুরু হতে পারে।
সি কনসোর্টিয়ামের সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার মাইকেল রুদ্রিগেজ জাগো নিউজকে বলেন, চট্টগ্রাম-ইউরোপ রুটে সরাসরি জাহাজ পরিচালনার সম্ভাব্যতা আমরা যাচাই-বাছাই করছি। এক্ষেত্রে আমদানি-রপ্তানি পণ্য ভারসাম্য হবে কি-না যাচাই করা হচ্ছে। শুধু জাহাজ চালু করলে হবে না, এটি নিয়মিত পরিচালনা করতে হবে। জাহাজ চালুর ক্ষেত্রে বন্দর কর্তৃপক্ষ আমাদের সমর্থন দিচ্ছেন। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে যাত্রার তারিখ আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে। এ বিষয়ে বিজিএমইএ’র সহ-সভাপতি রাকিবুল আলম চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, গত ৭ ফেব্রুয়ারি কনটেইনারবাহী একটি জাহাজ ইতালির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। ইউরোপে সরাসরি কনটেইনার যাওয়ায় একদিকে কমছে খরচ, অন্যদিকে বাঁচছে সময়। এ কারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশ বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে যাবে। যথাসময়ে পণ্য পৌঁছাতে পারায় ইউরোপে বাংলাদেশ বাণিজ্যের নতুন ক্ষেত্র শুরু হবে। এরই মধ্যে ইউরোপের ক্রেতারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছেন। সবমিলিয়ে ব্যবসায়ীরা বেশ আশাবাদী। এই রুটে আরও জাহাজ পরিচালনায় উদ্যোগ নিতে আমরা কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানাবো।
বন্দর ব্যবহার ব্যবহারকারী ফোরাম ও চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, নতুন করে চট্টগ্রাম-ইউরোপ রুটে জাহাজ পরিচালনার উদ্যোগ সুখবর। এটি ব্যবসায়ীদের জন্য অত্যন্ত সুখবর। করোনার জট থেকে মুক্ত হতে আমরা চট্টগ্রাম থেকে ইউরোপে সরাসরি কনটেইনার পরিবহনের দাবি জানিয়েছিলাম। আমাদের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। ইতালির একটি বেসরকারি কোম্পানি সোঙ্গা চিতা জাহাজের মাধ্যমে কনটেইনার নিয়ে গেছে। জটিলতা কাটিয়ে এই রুটে জাহাজ চলাচলের সংখ্যা বাড়ুক এটিই ব্যবসায়ীদের প্রত্যাশা।
চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক জাগো নিউজকে বলেন, চট্টগ্রাম থেকে ইতালি সরাসরি কনটেইনারবাহী জাহাজ চলাচল শুরুর পর বিভিন্ন কোম্পানি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। আমরা তাদের সমর্থন দিচ্ছি। এরই মধ্যে নেদারল্যান্ডস ও পর্তুগাল আমাদের সঙ্গে বৈঠক করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। তাদের বৈঠকে ব্যবসায়ীদেরও রাখতে বলেছেন। আমরা শিগগিরই তাদের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হবো।
মিজানুর রহমান/ইএ/এসএইচএস/জিকেএস