# চাহিদা ৮৫ লাখ বেলের কাছাকাছি# উৎপাদন এক লাখ ৭৬ হাজার বেল# ঘাটতি মেটাতে খরচ ৩৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি# বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তুলা আমদানিকারক বাংলাদেশ
Advertisement
দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক। বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনসহ এ খাতে তৈরি হয়েছে ব্যাপক কর্মসংস্থান। তবে সর্বাধিক রপ্তানির এ খাতেও রয়েছে নানান সমস্যা। বিশেষ করে সুতার জন্য আমদানিনির্ভরতা এ খাতে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা। সুতা তৈরির জন্য প্রয়োজন তুলা, যার প্রায় পুরোটাই দেশের বাইরে থেকে আমদানি করতে হয়। এতে প্রতি বছর খরচ করতে হচ্ছে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। চাহিদার তুলনায় দেশে তুলার উৎপাদন ২ শতাংশেরও কম।
বর্তমানে বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৮৫ লাখ বেল তুলার চাহিদা রয়েছে। এর বিপরীতে দেশে উৎপাদন হচ্ছে মাত্র এক লাখ ৭৬ হাজার বেল, যা চাহিদার দুই শতাংশও পূরণ করতে পারছে না। এ কারণে ঘাটতি মেটাতে প্রতি বছর বিদেশ থেকে আমদানি করতে হচ্ছে ৮০ লাখ বেলের বেশি তুলা। যাতে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা।
এদিকে, চলতি বছর (২০২২ সাল) বাংলাদেশে তুলার চাহিদা আরও বাড়বে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে মার্কিন কৃষি বিভাগ (ইউএসডিএ)। সংস্থাটির সবশেষ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বিপণন বছরে বাংলাদেশে তুলার অভ্যন্তরীণ ব্যবহার বাড়বে। তৈরি পোশাকের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক খুচরা বিক্রেতা ও ব্র্যান্ড অন্য দেশ থেকে বাংলাদেশে ওয়ার্ক অর্ডার স্থানান্তর করার কারণেই মূলত বাড়বে এই চাহিদা।
Advertisement
মার্কিন এ সংস্থাটি তাদের পূর্বাভাসে বলছে, এই বছর বাংলাদেশের মিল ও স্পিনাররা ৮৮ লাখ ১০ হাজার বেল তুলা ব্যবহার করবেন, যা আগের বছরের চেয়ে ৩ দশমিক ৫২ শতাংশ বেশি।
এমন পরিস্থিতিতে তুলা উন্নয়ন বোর্ডের (সিডিবি) তথ্য বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছর দেশে ৪৪ হাজার হেক্টর জমিতে তুলা চাষ হয়েছে। এসময় তুলা উৎপাদন হয় এক লাখ ৭৬ হাজার ২৮৬ বেল।
যদিও প্রতিবছর তুলার উৎপাদন বাড়ার তথ্য দিচ্ছে সিডিবি। সংস্থাটি বলছে, দেশে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তুলার উৎপাদন ছিল এক লাখ ৫৩ হাজার বেল, যা গত পাঁচ বছরে ২৩ হাজার বেল বেড়েছে। সংস্থাটি আমদানিনির্ভরতা কমাতে ২০৪১ সালের মধ্যে ২০ লাখ বেল তুলা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এগোচ্ছে। সম্প্রতি তুলা উন্নয়ন বোর্ডের হাইব্রিড জাতের তুলা উদ্ভাবন ও চাষের ফলে দেশে উৎপাদন বাড়ছে।
এ বিষয়ে সিডিবির অতিরিক্ত পরিচালক ড. মো. ফখরে আলম ইবনে তাবিব জাগো নিউজকে বলেন, আবহাওয়া ও জমির স্বল্পতার কারণে চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত তুলার উৎপাদন বাড়ানো যাচ্ছে না। তারপরও দেশে উৎপাদন ক্রমেই বাড়ছে। আগামী ২০ বছরে উৎপাদন ১০ গুণ বাড়ানো চেষ্টা করা হচ্ছে।
Advertisement
‘যেখানে বাংলাদেশে হেক্টরপ্রতি তুলার গড় উৎপাদন ৬ বেলের কিছু বেশি, সেখানে বিশ্বের অন্য তুলা উৎপাদনকারী দেশগুলোয় উৎপাদন ১০ বেলের ওপরে।’
চাহিদার তুলনায় উৎপাদনের ঘাটতিতে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ তুলা আমদানি করতে হয়। ২০১৯-২০ অর্থবছর আমদানি করতে হয়েছে ৭১ লাখ বেল তুলা। ২০২০-২১ অর্থবছরের সুনির্দিষ্ট তথ্য না পাওয়া গেলেও পোশাকশিল্পের ভালো অর্ডার থাকার কারণে এর পরিমাণ ৮০ লাখ বেলের বেশি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে মোট আমদানি করা তুলার মধ্যে ভারত থেকে ১৯ শতাংশ, মালি থেকে ১৩, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১২, ব্রাজিল ও বেনিন থেকে ১০ শতাংশ করে তুলা সংগ্রহ করা হয়। বাকি তুলা আরও কিছু দেশ থেকে আমদানি করা হয়। এদিকে ২০২০-২১ অর্থবছর শুধু ভারত থেকেই ৩২ শতাংশ তুলা এসেছে। এরপর আছে ব্রাজিল (১৫%), বেনিন (১২%) ও যুক্তরাষ্ট্র (৯%)।
এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তুলা আমদানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। তৈরি পোশাকশিল্প তুলা আমদানির ওপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল হওয়ায় আমদানির দিক দিয়ে চীনের পরই বাংলাদেশের অবস্থান।
বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি করা তৈরি পোশাকের ৭৪ শতাংশেরও বেশি কটনের (তুলার তৈরি)। তবে এক্ষেত্রে বৈশ্বিক চিত্র পুরোপুরি ভিন্ন। সামগ্রিকভাবে, বিশ্বের ৭৮ শতাংশ তৈরি পোশাকের মূল উপকরণ হাতে বোনা কাপড়।
তুলার জোগান না থাকা ও হাতে বোনা পোশাকের চাহিদার কারণে বাংলাদেশকেও সেদিকে এগোতে হচ্ছে। এ বিষয়ে পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক সভাপতি এবং স্টার্লিং গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. সিদ্দিকুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের এত তুলা উৎপাদনের সক্ষমতা নেই। জমিও নেই। তারপরও যতটুকু সম্ভব বাড়ানো গেলে পোশাকখাতের বড় সুবিধা হতো।
তিনি বলেন, এজন্য (তুলার জোগান কম) চাহিদা-দাম ভালো বলে আমাদের ম্যান মেড (হাতে বোনা) পোশাকে যেতে হচ্ছে। কটন পোশাকের ভবিষ্যৎ এখন ভালো নেই।
বাংলাদেশে তুলা স্পিন করার সক্ষমতা বেশ ভালো অবস্থায় রয়েছে। স্থানীয় স্পিনাররা নিটিং খাতের ৯৫ শতাংশ সুতা এবং ওভেন খাতের ৪০ শতাংশ উপকরণের জোগান দিতে সক্ষম। দেশে সুতা ও কাপড়ের বার্ষিক ব্যবহারের পরিমাণ প্রায় নয় লাখ ৫০ হাজার টন ও ৬৩০ কোটি মিটার।
বাংলাদেশে বর্তমানে ৪৩৩টি সুতার কারখানা ও ৮২৭টি কাপড়ের কারখানা রয়েছে। এছাড়া ১৯টি সিনথেটিক স্পিনিং মিল ও আটটি অ্যাক্রিলিক স্পিনিং মিলও চালু আছে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) তথ্য অনুযায়ী, দেশের বার্ষিক সুতা স্পিনিং ও কাপড় উৎপাদনের সক্ষমতা ৩৩০ কোটি কেজি। বাংলাদেশ বছরে এক কোটি ১৫ লাখ বেল অপরিশোধিত তুলা ব্যবহারের সক্ষমতা রয়েছে।
বিটিএমএর সহ-সভাপতি ফজলুল হক জাগো নিউজকে বলেন, করোনা পরিস্থিতি কিছুটা ভালোর দিকে থাকায় বিশ্বের অন্যান্য দেশে কাপড়ের চাহিদা অনেক বেড়েছে। ফলে স্থানীয় মিল মালিকরা তাদের সক্ষমতা বাড়িয়েছেন। এতে এবছর তুলার চাহিদা আরও বাড়বে।
বিশ্বে ৭৫টিরও বেশি দেশে তুলা চাষ করা হয়। তুলা উৎপাদনে প্রতিনিধিত্বকারী দেশগুলোর মধ্যে ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান ও ব্রাজিল অন্যতম।
এনএইচ/কেএসআর/এএ/এমএস