গোটা বিশ্ব এখন রুদ্ধশ্বাসে নজর রাখছে রাশিয়া-ইউক্রেন রণাঙ্গনে। কেন বাজলো এই যুদ্ধের দামামা, এই যুদ্ধে কে জিতবে কে হারবে, এই যুদ্ধের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব কী হবে—তা নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।
Advertisement
রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের বিভিন্ন দিক জাগো নিউজের কাছে তুলে ধরেছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এই অধ্যাপকের দুই পর্বের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু। আজ থাকছে প্রথম পর্ব।
জাগো নিউজ: রক্ত ঝরছে ইউক্রেনে। রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যকার এই সংঘাতকে যুদ্ধ নাকি আগ্রাসন বলে বিবেচনা করবেন?
ড. ইমতিয়াজ আহমেদ: আমি প্রথমত যুদ্ধই বলতে চাই। যুদ্ধ বলার প্রধান কারণ হচ্ছে (যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট) ন্যাটোর সম্প্রসারণ। ১২টি দেশ নিয়ে ন্যাটোর যাত্রা। এখন সেখানে ৩০টি দেশ সদস্য হয়েছে। ইউক্রেনকেও সদস্য করতে চাইছে বা ইউক্রেন সদস্য হতে চাইছে।
Advertisement
রাশিয়ার আপত্তি এখানেই যে, ইউক্রেন যেন কোনোভাবেই ন্যাটোর সদস্য না হয়। ২০১৪ সালের একটি যুদ্ধে সেখানে বাফার জোন তৈরি করা হয়। বাফার জোনের দুটি অঞ্চলকে রিপাবলিক বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সেখানে রুশ ভাষার জনগোষ্ঠী বেশি। তারা স্বীকৃতি চাইছিল। রাশিয়া তার সমাধান দিয়েছে। ইউক্রেনের সেনারা দীর্ঘদিন থেকে জুলুম করে আসছিল এবং সেটা যুদ্ধের প্রত্যাশা নিয়ে, যেন ন্যাটোর সদস্য হওয়া সহজ হয়।
ইউক্রেনীয় বাহিনীর প্রতিরোধের মুখে খারকিব শহরে ক্ষতিগ্রস্ত রুশ সামরিক যান/ছবি: সংগৃহীত
জাগো নিউজ: ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হতে চাইছে বলেই কি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা যায়?
ড. ইমতিয়াজ আহমেদ: প্রশ্নটি রাজনৈতিকভাবে সঠিক। কিন্তু বাস্তবতা কঠিন। ইউক্রেনে বহু রুশ ভাষার মানুষও রয়েছে। রুশপন্থিও আছে। তারা ন্যাটোর সম্প্রসারণ নীতির বিরোধিতা করে আসছে আগে থেকে।
Advertisement
বর্তমান প্রেসিডেন্ট (ভলোদিমির জেলেনস্কি) নির্বাচিত হয়ে রুশ ভাষার মানুষের অধিকার নাকচ করে দিচ্ছেন। এই প্রেসিডেন্ট ফ্যাসিস্ট বলে অনেকে মনে করছেন। তিনি নাৎসিদের উৎসাহ দিচ্ছেন।
প্রশ্ন হচ্ছে, ইউক্রেনের মানুষ চাইলে সমস্যা কোথায়? এক সময় কিউবার মানুষও চেয়েছিল সেখানে রাশিয়ার সেনা থাকুক এবং পরমাণু কর্মসূচি চলুক। যুক্তরাষ্ট্র তো তা মানেনি। দক্ষিণ আমেরিকার কোনো দেশ যদি রাশিয়ার সঙ্গে সামরিক জোট করতে চায়, তাহলে কি যুক্তরাষ্ট্র তা মেনে নেবে? অবশ্যই না। আগেও মানেনি।
আর আমেরিকা তো ইউক্রেনের পাশে দাঁড়াচ্ছেও না। প্রশ্ন হচ্ছে, ন্যাটো পূর্বদিকে আর কতটুকু এগোবে বা তার দরকার কেন?
জাগো নিউজ: ন্যাটোর সম্প্রসারণনীতি তো বিস্তার ঘটাবেই...
ড. ইমতিয়াজ আহমেদ: প্রশ্ন এখানেই। আপনার অস্তিত্ব নষ্ট করে আমি বিস্তার ঘটাতে পারি না।
অনেক হিসাব কাজ করছে এখানে। রাশিয়া থেকে জার্মানিতে গ্যাসলাইন যুক্ত হচ্ছে। এটি বাস্তবায়ন হলে আমেরিকার ওপর জার্মানির নির্ভরতা কমে যাবে।
রাশিয়া-ইউক্রেনের আকাশ এখন যুদ্ধবিমানের দখলে/ছবি: সংগৃহীত
জার্মানিতে ১১৯টি সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। যুক্তরাজ্যে আছে ২৫টি। ইতালিতে আছে ৪৪টি, বেলজিয়ামে আছে ১১টি। অন্য দেশেও রয়েছে। আমেরিকার ঘাঁটি ইউরোপে কেন?
আমেরিকা এমন একটি যুদ্ধ চাইছিল, যেন ন্যাটোর অবস্থান আরও পোক্ত করা যায় এবং সেনা ঘাঁটি রাখার যৌক্তিকতা মেলে ধরা যায়।
দ্বিতীয়ত, ইউক্রেন এখন কী করবে? তারা কি রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবে? এটি করলে রাশিয়া আরও মারমুখী হয়ে ভেতরে প্রবেশ করবে। এটিই আমেরিকার দরকার এখন।
জাগো নিউজ: যুক্তরাষ্ট্রের ফাঁদে পা দিয়ে রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ করলো—এমনটিই বলতে চাইছেন?
ড. ইমতিয়াজ আহমেদ: অনেকে তাই মনে করছেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন তো নেই। তাহলে কেন ইউরোপে সেনা ঘাঁটি থাকবে। বাংলাদেশে যদি অন্য দেশের সেনা ঘাঁটি থাকে, তাহলে কি আমরা স্বাধীন থাকতাম? ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো কি আসলেই স্বাধীন? এই প্রশ্ন তো যৌক্তিক। তারা কেন নিজেরা নিজেদের নিরাপত্তা দিতে পারছে না?
ইউরোপের দেশগুলো যখন এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে রাশিয়া-চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ছে, তখনই আমেরিকা বিরাগভাজন হলো। রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতে ন্যাটো কিছুটা স্বস্তি ফেলছে বলে মনে করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলে ন্যাটোর এই স্বস্তি কতদিন থাকে, তা দেখার বিষয়।
জাগো নিউজ: কিন্তু ন্যাটো তো ইউক্রেনকে সরাসরি সহায়তা করলো না। রাশিয়ার কব্জায় ইউক্রেন। যুক্তরাষ্ট্র তো পেছনে চলে গেলো।
ড. ইমতিয়াজ আহমেদ: অনেকটা তাই। কিন্তু পেছনের খবরও রাখতে হবে। কী ঘটবে তা এখনই বলার সময় আসেনি। ন্যাটো ইউক্রেনকে নৈতিক সমর্থন দেবে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের জোট ইইউ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে।
দেখার বিষয় ইউক্রেন আসলে কী করে। তারা যদি বাংলাদেশের মতো কূটনৈতিক কৌশল নিতে পারে, তাহলে হয়তো রক্ষা মিলবে। সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব জরুরি। ইউক্রেন তা করেনি। রাশিয়ার বিরুদ্ধে গিয়ে লাভ হবে না। যুক্তরাষ্ট্র অনেক দূরের দেশ। রাশিয়ার সীমানা ঘিরে ইউক্রেন। কার সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়লে ভালো থাকবে তা বুঝতে হবে।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি
ন্যাটোকে একেবারে রাশিয়ার সীমানার কাছে নিয়ে এলে তো দেশটি বসে থাকবে না। রাশিয়া পরাশক্তি। এটি বুঝতে পারার কথা। ইউক্রেন নিরপেক্ষ থাকলেই তো এই পরিস্থিতিতে পড়তে হয় না। বিশেষ সামরিক জোটে গিয়ে নিজের বিপদ ডেকে আনার কী দরকার? সমাধান ইউক্রেনের হাতেই।
জাগো নিউজ: ইউক্রেন আগে থেকেই রাশিয়ার সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত। নতুন তো নয় এবং এটি তার নীতি...
ড. ইমতিয়াজ আহমেদ: হ্যাঁ। কিন্তু বাস্তবতা তো বুঝতে হবে। ইউক্রেনে প্রচুর মানুষ রুশ ভাষায় কথা বলেন এবং তারা রুশ নীতিতে বিশ্বাসী। এটি অস্বীকার করার তো উপায় নেই।
জাগো নিউজ: রাশিয়ার যে শক্তির প্রকাশ, এটার মধ্য দিয়ে কি নিজেকে প্রধান পরাশক্তি হিসেবে জানান দিচ্ছে?
ড. ইমতিয়াজ আহমেদ: সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর কতগুলো বছর আমরা ইউনিপোলারের মধ্যে ছিলাম। এটি এখন ভেঙে যাচ্ছে। এর পেছনে চীনের একটি বড় ভূমিকা আছে। চীনের সঙ্গে আমেরিকার টেনশন ঘনীভূত হচ্ছে।
চীনের উঠে আসা বিশ্বের রূপ বদলে দিয়েছে। ভারতও কিছুটা ক্ষমতা এখন রাখে। ভারত আমেরিকাকে স্পষ্টত বলে দিয়েছে, ইউক্রেনের ব্যাপারে তাদের সঙ্গে নেই। আলোচনার মধ্য দিয়ে সমাধান হোক। তার মানে নিরাপত্তার আরেক বলয় কোয়াডে ভারতের উপস্থিতি নিয়ে এখন সংশয় দেখা দিলো।
দীর্ঘ সময়ের মধ্য দিয়ে রাশিয়াও এখন পরাশক্তির আকার ধারণ করে চলছে।
নিরাপত্তার প্রশ্ন নিয়ে (সাবেক আমেরিকান প্রেসিডেন্ট) ডোনাল্ড ট্রাম্পও কিন্তু জার্মানিকে প্রশ্ন করেছিলেন, তোমাদের নিরাপত্তার ব্যয় আমরা দেবো কেন? জার্মানি যুক্তরাষ্ট্রকে বলেছে, তোমার সেনা নিয়ে যাও। তার মানে পৃথিবী আর আগের রূপে নেই। আমরা হয়তো আবারও মাল্টিপোলারের দিকে যাচ্ছি। বহুমুখী হিসাব কাজ করছে রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যকার পরিস্থিতিতে।
এএসএস/এইচএ/জিকএস