ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ ঢেলে সাজাতে মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার। এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে নেওয়া হয়েছে সাত উদ্যোগ। এতে ঋণ প্রয়োজন হবে ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (বাংলাদেশি ৭৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা)। এরই মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) মাধ্যমে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে ঋণপ্রস্তাবও করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। তিনটি প্রকল্পের জন্য চাওয়া হয়েছে ঋণ।
Advertisement
প্রস্তুতিমূলক সুবিধার জন্য ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলের কারিগরি সহায়তা (প্রথম সংশোধিত) প্রকল্পের আওতায় এ মহাপরিকল্পনার ছক তৈরি করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। মূলত কারিগরি প্রকল্পের মাধ্যমেই প্রকল্পগুলোর প্রাথমিক খসড়া তৈরি করা হয়েছে। নির্ধারণ করা হয়েছে প্রকল্পের ব্যয় ও রুট।
ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার ডাবল লাইন ডুয়েলগেজ নির্মাণ সমীক্ষা প্রকল্পের পরিচালক ও বাংলাদেশ রেলওয়ের পরিচালক (প্রকৌশল) মো. আবিদুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, মহেশখালী থেকে মাতারবাড়ি পর্যন্ত ২৬ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ করা হবে। এছাড়া চট্টগ্রামের পরিবর্তে বিজি ওয়ার্কশপ নির্মাণ করা হবে গাজীপুরে। এছাড়া ঢাকার জটলা নিরসনে গাজীপুরে একটা বিশাল আইসিডি (ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপো) নির্মাণ করা হবে। বাস্তবায়ন করা হবে গুরুত্বপূর্ণ সাতটি মহাপরিকল্পনা। মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রয়োজন ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বৈদেশিক ঋণ। এরই মধ্যে আমরা তিনটি প্রকল্পের ঋণ প্রাপ্তির জন্য উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছি। আশা করছি এসব উদ্যোগ বাস্তবায়নে এডিবিকে পাশে পাবো।
ঢাকা-লাকসাম ডুয়েলগেজে দরকার ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারঢাকা-চট্টগ্রাম রেলওয়ে লাইন বাংলাদেশ রেল নেটওয়ার্কের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই অংশটি ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে এবং উপ-আঞ্চলিক রেলওয়ে করিডোরের একটি বড় অংশ। এ উপ-অঞ্চলের পরিবহন ও ট্রান্স-শিপমেন্টের কেন্দ্রবিন্দু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশের। ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলওয়ে করিডোরে আখাউড়া-লাকসাম সেকশনটিই একমাত্র সিঙ্গেল লাইন, যা রেলওয়ে করিডোরে অভ্যন্তরীণ, উপ-আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রেল যোগাযোগের একমাত্র সীমাবদ্ধতা হয়ে দাঁড়াবে।
Advertisement
বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়ের ঢাকা-চট্টগ্রাম করিডোরে যাত্রী ও মালামাল পরিবহনের চাহিদা মেটানোর জন্য অবিচ্ছিন্ন ডাবল লাইন স্থাপন জরুরি। এজন্য ঢাকা-চট্টগ্রাম করিডোরে লাকসাম–চিনকি আস্তানা ও চট্টগ্রাম মিটারগেজ ট্র্যাককে পর্যায়ক্রমে ডুয়েলগেজ ডাবলট্র্যাক রূপান্তর প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। এটা বাস্তবায়নে ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় হবে (বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৫ হাজার ৩০০ কোটি টাকা)। প্রকল্পে ঋণ প্রাপ্তির জন্য ইআরডির মাধ্যমে উন্নয়ন সহযোগীর কাছ থেকে ঋণপ্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে।
আইসিডি নির্মাণে ৩৫০ মিলিয়ন ডলার ঋণ খুঁজছে সরকারঢাকার অদূরে গাজীপুরের জয়দেবপুর ধীরাশ্রম রেলস্টেশনের কাছে প্রায় ১৬০ একর জায়গায় নির্মাণ হবে রেল ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো (আইসিডি)। বাংলাদেশ রেলওয়ের হিসাব অনুযায়ী এতে ৩৫ কোটি ডলার পর্যন্ত ব্যয় হতে পারে। এই আইসিডি নির্মাণে দুবাইয়ের ডিপি ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে যৌথভাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের চিন্তা করছে সরকার। এছাড়া ইআরডির মাধ্যমে এডিবি ঋণ প্রস্তাবও করা হয়েছে। কমলাপুরের আইসিডি অনেক আগেই ঢাকার বাইরে সরিয়ে নেওয়া উচিত ছিল বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এটা করা হলে ঢাকার ওপর চাপ ও যানজট কমবে। অন্যদিকে ধীরাশ্রমে আইসিডি স্থানান্তর করা হলে কমবে কনটেইনার জট। তাছাড়া কারখানাগুলো গাজীপুর-টঙ্গীকেন্দ্রিক, এতে আমদানি-রপ্তানিকারকদের সুবিধা হবে।
ডাবল লাইন হবে চট্টগ্রাম-দোহাজারী চট্টগ্রাম-দোহাজারী বিদ্যমান মিটারগেজ সিঙ্গেল লাইনকে ডুয়েলগেজ ডাবললাইনে রূপান্তর করা হবে। এতে মোট ব্যয় হবে ৯০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ৯০ কোটি ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৭ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা)। এরই মধ্যে প্রকল্পের আওতায় ৯০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ চেয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। চট্টগ্রাম-দোহাজারী রেলপথে ট্রেন কমিয়ে দেওয়ায় একটি ট্রেন আপ-ডাউন হচ্ছে। মাঝে মধ্যে মালবাহী ট্রেন ও ফার্নেস ওয়েলবাহী ট্রেন চলাচল করে। ফলে চট্টগ্রাম-দোহাজারী রেলপথ এখন অবহেলিত। এসব কারণেই রেলপথটি ঢেলে সাজানো হবে। চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী পর্যন্ত বিদ্যমান ৪৭ দশমিক ০৪ কিলোমিটার মিটারগেজ সিঙ্গেল লাইনকে ডুয়েলগেজে রূপান্তর করা প্রয়োজন, যাতে কক্সবাজার ও ঘুমধুম পর্যন্ত ব্রডগেজ ডাবল লাইনে ট্রেন চলাচল করতে পারে।
বাংলাদেশ রেলওয়ে জানায়, বাকি চারটি প্রকল্পের জন্য ঋণ প্রস্তাবের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।
Advertisement
চট্টগ্রামে নয় গাজীপুরেই রেলের বিজি ওয়ার্কশপচট্টগ্রামের পাহাড়তলীর মিটারগেজ ওয়ার্কশপের নিকটবর্তী স্থানে ব্রডগেজ (বিজি) ওয়ার্কশপ নির্মাণের জন্য প্রাথমিক পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। পরে সমীক্ষা রিপোর্ট অনুযায়ী ও আর্থিক উন্নয়নের কথা বিবেচনা করে ওয়ার্কশপ গাজীপুরে নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পাহাড়তলী ওয়ার্কশপ সংলগ্ন স্থানে বিজি ওয়ার্কশপ নির্মাণের জন্য যে পরিমাণে জায়গা দরকার তা নেই। ফলে বিজি ওয়ার্কশপ অন্যত্র স্থাপনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। গাজীপুরের দাড়িপাড়া এলাকায় বিজি ওয়ার্কশপ স্থাপন করলে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চল উভয় এলাকাকে সার্ভিস দেওয়া যাবে। এ বিবেচনায় বিজি ওয়ার্কশপ গাজীপুরে নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয় বলে জানায় বাংলাদেশ রেলওয়ে। এটা নির্মাণ করতে ৯৪২ মার্কিন ডলার বা ৯৪ দশমিক ২ কোটি ডলার বৈদেশিক ঋণ দরকার। দ্রুত সময়ের মধ্যে এটা বাস্তবায়নের জন এডিবি ঋণ চাইবে।
রেল যাবে মাতারবাড়িমহেশখালী ও মাতারবাড়ির প্রস্তাবিত পাওয়ার প্ল্যান্ট হাবের সঙ্গে নতুন ডুয়েলগেজ রেলসংযোগ নির্মাণ করবে সরকার। এ খাতে বৈদেশিক বিনিয়োগ দরকার প্রায় দেড় বিলিয়ন মার্কিন ডলার। প্রতি ডলার সমান ৮৫ টাকা ধরে বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ ১২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। কক্সবাজারের মহেশখালী থেকে মাতারবাড়ি পর্যন্ত ২৬ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর থেকে সরাসরি রেলপথে কনটেইনার ঢাকা আইসিডিতে পরিবহন করা যাবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি শেষে নকশা প্রণয়নের কাজও শেষ করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গেও যুক্ত হবে এই রেলপথ। এছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রাম করিডোরে টঙ্গী-ভৈরববাজার-আখাউড়া মিটারগেজ ডাবল ট্র্যাককে পর্যায়ক্রমে ডুয়েলগেজ ডাবল ট্র্যাকে রূপান্তর প্রকল্পে বাংলাদেশ রেলওয়ের ঋণ দরকার ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৪ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা)। ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলওয়ে লাইন বাংলাদেশ রেলওয়ে নেটওয়ার্কের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ করিডোর। বাংলাদেশ রেলওয়ের আয়ের প্রধান অংশ আসে এই করিডোর দিয়ে অভ্যন্তরীণ কনটেইনার পরিবহন ও যাত্রী পরিবহনের মাধ্যমে।
ফৌজদারহাট-চট্টগ্রাম পোর্ট ইয়ার্ড সেকশনের বিদ্যমান মিটারগেজ সিঙ্গেল লাইনকে ডুয়েলগেজ ডাবল লাইনে রূপান্তর প্রকল্পে বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রয়োজন ৫৩৪ মিলিয়ন বা ৫৩ দশমিক ৪ কোটি মার্কিন ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ ৪ হাজার ৫৩৯ কোটি টাকা)। ইআরডি সূত্র জানায়, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ ঋণের জন্য প্রস্তাব করলে কমিটি তৈরি করে ইআরডি। পরে কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কোনো প্রস্তাব জাপান-এডিবি, কোনো প্রস্তাব বিশ্বব্যাংক-চীনসহ সংশ্লিষ্ট উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে পাঠানো হয়।
ইআরডির অতিরিক্ত সচিব (এডিবি) ড. পিয়ার মোহাম্মদ জাগো নিউজকে বলেন, এডিবি আমাদের এখন অন্যতম বৃহৎ উন্নয়ন সহযোগী। ঋণের জন্য বাংলাদেশ রেলওয়েসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থা প্রস্তাব করলে আমরা আমাদের কমিটির কাছে পাঠাই। কমিটি যাচাই-বাছাই করে প্রকল্পের টাকা কোন উন্নয়ন সহযোগীর কাছ থেকে পাওয়া যেতে পারে। কমিটির সিদ্ধান্তের পরে আমরা প্রস্তাব পাঠাই। অনেক সময় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়-বিভাগ আমাদের বলে কোন উন্নয়ন সহযোগীর কাছে ঋণ পাওয়া যাবে। সেই অনুযায়ী প্রস্তাব পাঠাই। তবে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা দেশের স্বার্থ আগে চিন্তা করি।
বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রকল্পে ঋণ নেওয়ার সময় আউটপুট আগে দেখা উচিত বলে জানান পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, বাংলাদেশে নিযুক্ত এডিবির কান্ট্রি ডিরেক্টরের (এডিমন গিনটিং) সঙ্গে আমি বৈঠক করেছি। এডিবি বাংলাদেশের রেল প্রকল্পে সব সময় অর্থায়ন করে। আমি কান্ট্রি ডিরেক্টরকে পরিষ্কার বলে দিয়েছি আউটপুট দেখেই যেন রেল প্রকল্পে ঋণ দেয় এডিবি। রেলে প্রকল্প গ্রহণ করলাম কিন্তু আউটপুট কিছু এলো না তাহলে তো ঋণ নিয়ে কোনো লাভ নেই।
এমওএস/এএ/এমএস