বিশেষ প্রতিবেদন

এক দশকে খুন-গুম-অপহৃত ৩০ সাংবাদিক, মেলে না বিচার

** বিচার না হওয়ায় হতাশ স্বজন-সহকর্মীরা** সাংবাদিকতায় ভয়ভীতি ঢুকলে রাষ্ট্রই ক্ষতিগ্রস্ত হবে, মত বিশেষজ্ঞদের

Advertisement

‘মামলা চালানোর মতো আর্থিক অবস্থা আমার নেই। আমার মেয়ে নিয়েই আমি চলতে পারি না। চার্জশিট দেওয়ার পর কয়েকদিন মামলাটা চলেছিল। এখন মামলা স্থগিত হয়ে আছে। আমার স্বামী হত্যার বিচার চাই। কিন্তু মামলা চালানোর মতো টাকা না থাকায় বিচার কবে পাবো জানি না।’

জাগো নিউজকে এ কথা বলছিলেন হত্যাকাণ্ডের শিকার চুয়াডাঙ্গায় সাংবাদিক সদরুল আলম নিপুলের (৪২) স্ত্রী মোছা. নিলুফা ইয়াসমিন। ২০১৪ সালের ২১ মে খুন হয়েছিলেন নিপুল। চুয়াডাঙ্গা থেকে প্রকাশিত দৈনিক মাথাভাঙ্গা পত্রিকার এ সাংবাদিককে হত্যার পর তার দেহ ১০ টুকরা করা হয়। সদর উপজেলার মোমিনপুর রেলস্টেশন থেকে লাশের টুকরা ও তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়।

২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারে নিজ বাসায় খুন হন মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সারোয়ার ও তার স্ত্রী এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনি। এই সাংবাদিক দম্পতি হত্যাকাণ্ডের পর দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হলে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী খুনিদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসার ঘোষণা দেন। কিন্তু হত্যাকাণ্ডের এক দশক পেরিয়ে আজও শুরু হয়নি ওই হত্যাকাণ্ডের বিচারকাজ। এরই মধ্যে ৮৬ বার পিছিয়েছে এই হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার তারিখ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত বিচারের কথা বলা হলেও দেখা যাচ্ছে না তার প্রতিফলন।

Advertisement

শুধু নিপুল বা সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের বিচারই নয়, দেশের অধিকাংশ সাংবাদিক হত্যার বিচারই ঝুলে যাচ্ছে বা আটকে যাচ্ছে দীর্ঘসূত্রতায়।

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য মতে, গত ১০ বছরে দেশে হত্যা, গুম, খুন, অপহরণের শিকার হয়েছেন ৩০ সাংবাদিক। এসব ঘটনায় জড়িতদের বিচার হওয়ার নজির দেখা গেছে খুব কমই।

যেমন- ২০১২ সালের ১৫ জুন যশোর থেকে প্রকাশিত দৈনিক গ্রামের কাগজের সাংবাদিক জামাল উদ্দীন হত্যা, ২০২০ সালের ৩ সেপ্টেম্বর সাভারের ধামরাইয়ে বিজয় টেলিভিশনের ধামরাই উপজেলা প্রতিনিধি সাংবাদিক জুলহাস হত্যাকাণ্ডসহ অধিকাংশ ঘটনার বিচার এখনো হয়নি।

প্রায় এক দশক আগের সাংবাদিক জামাল উদ্দীন হত্যার বিচার এখনো না হওয়ায় হতাশ তার পরিবার। এখনো বাবার হত্যার বিচার চান ছেলে তন্ময় ইসলাম চঞ্চল। বাবার মৃত্যুর পর দুই বোন ও মাকে নিয়ে সংসারের হাল ধরতে চঞ্চল পাড়ি জমান বিদেশে। বাবার হত্যার বিচারের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করায় ২০১২ সালে আমার বাবাকে হত্যা করা হয়। আমার দাদা মামলাটি করেন। দাদা মারা গেলে চাচা মামলাটি চালান। আমি এর মধ্যে বিদেশ চলে যাই। পরে কীভাবে কী করেছে আমি জানি না। দুই বছর ধরে মামলাটি স্থগিত রয়েছে। আমি হত্যাকাণ্ডটির বিচার আজও পাইনি। বিচার পেতে মামলাটি কীভাবে চালানো যায় সেই চেষ্টা চালাচ্ছি।

Advertisement

এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক (এসআই) আমিনুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, হত্যাকাণ্ডটি বেশ চাঞ্চল্যকর ছিল। মামলার তদন্ত প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করে আমরা চার্জশিট দিয়ে এসেছিলাম তখন। এখন আদালতের বিষয়ে আমাদের কিছু বলার নেই।

শুধু গত এক দশকেরই নয়, তার আগের হত্যাকাণ্ডগুলোরও বিচারের নজির মিলছে কম। ২০০০ সালে যশোরে জনকণ্ঠের বিশেষ প্রতিনিধি সামসুর রহমান কেবল হত্যা, ২০০১ সালে খুলনার ‘দৈনিক অনির্বাণ’ পত্রিকার সাংবাদিক এস এম নহর আলী হত্যা, ২০০২ সালে খুলনার ‘দৈনিক পূর্বাঞ্চল’র স্টাফ রিপোর্টার হারুনার রশীদ খোকন হত্যার বিচার মেলেনি আজও। ২০০৪ সালের ১৫ জানুয়ারি খুলনা প্রেস ক্লাবের সামনে বোমা হামলায় একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক মানিক সাহাকে হত্যার মামলায় ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর রায় ঘোষণা হলেও সেই সাজা নিয়ে অসন্তোষ থেকে গেছে স্বজন-সহকর্মীদের।

সাগর-রুনি হত্যার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার তারিখ পিছিয়েছে ৮৬ বার

এমন সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের বিচার না পেয়ে হতাশ ও ক্ষুব্ধ স্বজনরা। সাংবাদিক সামসুর রহমান কেবলের ছোট ভাই সাজেদুর রহমান বকুল জাগো নিউজকে বলেন, আমার ভাইয়ের হত্যা মামলায় ১৬ জনের নামে পুলিশ চার্জশিটে দিয়েছিল। তারপর বাদীকে না জানিয়ে মামলা যশোর থেকে খুলনায় স্থানান্তর করা হয়। চার্জশিটে দেওয়া ১৬ আসামির নামের মধ্যে মামলার পলাতক আসামি দুইজনের বাড়ি খুলনায়। ফলে যশোর থেকে খুলনা গিয়ে মামলা চালানো আমাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। মামলাটি যশোরে স্থানান্তরের জন্য ২০০৫ সালে হাইকোর্টে রিটও করা হয়। তারপর থেকে এখনো এই মামলার কার্যক্রম স্থগিত। ২২ বছর ধরে একটা মামলার বিচার হয়নি। আমরা হতাশ ও ক্ষুব্ধ।

‘খুন হয়ে যাবে বিচার হবে না, এটা স্বাভাবিক পরিবেশ নয়’সাংবাদিক হত্যার বিচার না হওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল জাগো নিউজকে বলেন, দেশে সাংবাদিক হত্যার বিচার হয় না। নির্যাতন-নিপীড়নের কোনো বিচার হয় না। আজ পর্যন্ত প্রায় তিন ডজনের বেশি সাংবাদিক হত্যার শিকার হয়েছেন, নির্যাতিত হয়েছেন শত শত। কোনো সাংবাদিক হত্যা, নির্যাতনের বিচার হয়েছে তা বলা যাবে না। কোনো দৃষ্টান্ত নেই। খুন হয়েছে অথচ বিচার নেই। সাগর-রুনির হত্যার বিচারে কত সময় নেওয়া হচ্ছে। সাংবাদিকতা খুব ঝুঁকিপূর্ণ পেশা এটা ঠিক আছে। কিন্তু খুন হয়ে যাবে, নির্যাতিত হবে, বিচার হবে না, এটা কোনো স্বাভাবিক পরিবেশ নয়।

সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের কোনোটার বিচারই শুরু হয় না, কোনোটা চার্জশিটে আবদ্ধ, কোনোটা আবার তথ্য-প্রমাণের অভাবে লাল ফিতার দৌরাত্ম্যে আটকে যায়। ফলে বিচার না হওয়ায় একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটেই চলছে। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতেও হত্যাকাণ্ডের শিকার হন নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে দৈনিক বাংলাদেশ সমাচার পত্রিকার জেলা প্রতিনিধি সাংবাদিক বোরহান উদ্দিন মুজাক্কির। এসব ঘটনায় জড়িতদের বিচারের দীর্ঘসূত্রতায় হত্যাকাণ্ড যেমন বন্ধ হচ্ছে না, তেমনি বাড়ছে বিচারের প্রতি মানুষের অনাস্থা। এক দশকেও সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যার তদন্ত শেষ না হওয়ায় সাংবাদিকদের মনে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এছাড়া সাংবাদিকদের অস্বাভাবিক মৃত্যুতে অনেক ক্ষেত্রে তৈরি হয় নানা রহস্য। সম্প্রতি হাতিরঝিলে সাংবাদিক হাবীবুর রহমানের মৃত্যুও নানা মহল থেকে তদন্তের দাবি উঠছে। সড়কে প্রাণহানি নাকি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড তা খুঁজে বের করার দাবি উঠেছে সংবাদকর্মীদের মধ্যে থেকে।

‘বিচারে দীর্ঘসূত্রতায় এই ধরনের ঘটনা ঘটছে’মাঠের সাংবাদিকদের এমন পরিস্থিতির বিষয়ে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম হাসিব জাগো নিউজকে বলেন, সাংবাদিকতাটাই একটা ঝুঁকিপূর্ণ পেশা। তাই মাঠে বিশেষ করে রিপোর্টাররাই যেহেতু সামনে থেকে সংবাদ সংগ্রহের বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করেন সেহেতু তাদের ঝুঁকিটাই বেশি থাকে। তদের ঝুঁকি নিয়েই কাজ করতে হয়। ফলে হামলা, নির্যাতন, লাঞ্ছনা, হত্যাসহ নানা ধরনের হুমকির শিকার হন তারা। এসব থেকে সুরক্ষার জন্য আইনগত সহায়তাটাই বেশি দরকার। বিচারে দীর্ঘসূত্রতা থাকায় এই ধরনের ঘটনা ঘটছে। প্রতিটি ঘটনা অনুযায়ী দৃষ্টান্তমূলক বিচার হলে এবং বিচারটা দ্রুত হলে সাংবাদিক হত্যা কিংবা তাদের ওপর হামলা-মামলা ও হুমকি এসব অনেকটাই কমে আসবে।

সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবিতে রাজপথে আন্দোলন হয়, কিন্তু বিচার আটকে যায় দীর্ঘসূত্রতায়

‘ভয়ভীতি ঢুকলে সাংবাদিকরা সাংবাদিকতা ঠিকভাবে করতে পারবেন না’

সাংবাদিক হত্যা মামলার তদন্ত ও বিচারের বিষয়ে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) প্রেসিডেন্ট ও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ জাগো নিউজকে বলেন, সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত এখনো শেষ হয়নি এটা দুঃখজনক। এটা আমাদের ব্যর্থতা, তদন্ত যারা করছেন তাদের ব্যর্থতা। একটি হত্যাকাণ্ডের ক্লু-ই পাওয়া যাবে না এটা হতে পারে না। নিশ্চয়ই কোনো ক্লু তো আছেই। এ রহস্য এখনো উন্মোচন হয়নি, নিশ্চয়ই এর পেছনে কারণ আছে যার কারণে তদন্তটা সামনে এগুচ্ছে না।

সাংবাদিক হত্যা মামলার বিচার না হওয়া ও স্থবির হয়ে যাওয়ার বিষয়ে মনজিল মোরসেদ বলেন, মামলার আসামিপক্ষের লোকজন বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে সময় নেন বা ডিলে (দেরি) করেন যাতে বিচারটা না হয়। এক্ষেত্রে সরকারপক্ষের আইনজীবী যারা থাকেন তারা এসব হত্যাকাণ্ডের বিচারের জন্য উদ্যোগ বা ভূমিকা যদি নেন তাহলে বিচারগুলো আরও দ্রুত পাওয়া সম্ভব। মেজর (অব.) সিনহা হত্যা, বিশ্বজিৎ হত্যার বিচারে আমরা সেটি দেখেছি। এটি নির্ভর করে সরকারের উদ্যোগ নেওয়া অথবা সরকারের পক্ষে যে আইনজীবীরা আছেন তাদের ওপর। কারণ সাংবাদিকদের হত্যাগুলোর অনেক রহস্য থাকে। এই হত্যাগুলো তো ব্যক্তিগত কারণে হয় না, এই হত্যাগুলো রিপোর্টিংয়ের কারণে হয়। সমাজে তার ভূমিকা বা অবস্থানের কারণে, প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে তার ভূমিকা বা রিপোর্টের কারণেই হত্যাগুলো হয়। এগুলো যদি রোধ করা বা বিচার করা না যায়, তবে এসব রিপোর্ট বা সাংবাদিকতা যারা করেন তাদের মনের মধ্যে তো ভয়ভীতি ঢুকবেই। আর এই ভয়ভীতি ঢুকলে তারা সাংবাদিকতা ঠিকভাবে করতে পারবেন না। সাংবাদিকতা ঠিকভাবে করতে না পারলে রাষ্ট্রই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক মো. মফিজুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, সাংবাদিকরা যত ভয়ভীতিহীন ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করতে পারবেন ততই তারা সাংবাদিকতা পেশাকে সমৃদ্ধ করবেন। কিন্তু সাংবাদিক হত্যা বা এসব ঘটনায় এক ধরনের অনীহাই তৈরি হচ্ছে মেধাবী শিক্ষার্থী কিংবা মানুষের মধ্যে, যার ফলে প্রভাব পড়ে গুণগত সাংবাদিকতার ওপর। সাংবাদিক হত্যা কিংবা যে কোনো হত্যাকাণ্ডের বিচারই দ্রুত হওয়া উচিত। কেন সেই হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয় সেগুলো অনুসন্ধান করে দেখা দরকার এবং সেই রাস্তাগুলো বন্ধ হওয়া উচিত। অনেকে বলে বিচারহীনতার সংস্কৃতি এসব কর্মকাণ্ডকে উদ্বুদ্ধ করে। সেটা যেমন একটা দিক, আবার যেসব কারণে এগুলো ঘটে সেগুলোও বের করা উচিত।

আরএসএম/এমআরআর/এইচএ/এমএস