মতামত

শুধু ব্যবসা নয় পাঠকও সৃষ্টি করুক বইমেলা

এ পর্যন্ত সারা পৃথিবীতে যতগুলো বইমেলা আয়োজিত হয়েছে তার মধ্যে আকারে সবচেয়ে বড় হলো ফ্রাঙ্কফ্রুট বইমেলা। এটা জার্মানিতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। যেখানে বিশ্বের ৭৭টি দেশের ৬,১৬৯টি প্রকাশক প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করেছিল। সেটা ছিল ১০-১৪ অক্টোবর, ২০১৭। কিন্তু ফ্রাঙ্কফ্রুট বইমেলা মাত্র পাঁচদিন স্থায়ী হয়।

Advertisement

বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত একুশে বইমেলাও অনেক বড়। মেলার আকার বেড়েছে। তবুও আকারে অনেক দেশের বইমেলার চেয়ে একুশে মেলা এখনও ছোট। কিন্তু সময়ের বিচারে আমাদের একুশে মেলাকে পৃথিবীর কোনো দেশের বইমেলা আজ পর্যন্ত আমাদের ছোট করতে পারেনি। মাতৃভাষার ওপর লেখা বই নিয়ে মাসব্যাপী বা এত দীর্ঘ সময়ব্যাপী ঘটা বইমেলা পৃথিবীর আর কোনো দেশে হতে দেখা যায় না! এই দীর্ঘমেয়াদি বইমেলা আমাদের একান্ত অর্জন। এই বইমেলা আমাদের সবার গৌরবের বিষয়!

বাংলাদেশে ঢাকায় অনুষ্ঠিত একুশে বইমেলা দীর্ঘদিনব্যাপী জনপ্রিয়তার মধ্যে চলতে থাকার কারণ নানামুখী। আমাদের ভাষা আন্দোলনের মাস ফেব্রুয়ারি শুরু হয় বইমেলার উদ্বোধনী দিয়ে। বাংলা ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন, তাদের অমূল্য ত্যাগ-তিতিক্ষার স্মরণ ও বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসার চিরন্তন বহিঃপ্রকাশ ঘটে একুশে বইমেলার মাধ্যমে। বাঙালির বইয়ের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও বই পড়ার প্রতি আগ্রহ এবং ভালোবাসা থেকে ফি বছর দিন গুনতে থাকে— কবে শুরু হবে একুশে বইমেলা। বইমেলায় সবাই শুধু একদিন ঢুঁ মেরেই ক্ষান্ত দেন না বরং এই এক মাসের মধ্যে একই ব্যক্তি বহুবার মেলায় যান। বইমেলায় যাওয়া নেশায় পরিণত হয়।

বইমেলায় সবাই শুধু নিজের জন্য বই কেনেন না। কেউ তাকিয়ে তাকিয়ে সাজানো বই দেখেন, কেউ বক্তৃতা শোনেন, লেখক কুঞ্জে আড্ডা দেন, রক্ত দেন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করেন, পাঠক-দর্শকদের সাথে মতবিনিময় করেন, কেউ আবার বই কিনে প্রিয়জনদের উপহার দেন।

Advertisement

বইমেলায় সব বয়সী মানুষের চাহিদা উপযোগী বই কিনতে পাওয়া যায়। এছাড়া বইমেলা সবার অজান্তেই মানুষের মহা মিলনমেলায় পরিণত হয়। আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, শিক্ষার্থী সবাই একত্রে ভিড় জমান বইমেলায়। কচিকাঁচারা বায়না ধরে, মেলা থেকে তাকে কি কি বই কিনে উপহার দিতে হবে সেটা নিয়ে। এতে বইমেলার পারিবারিক ও সামাজিক মূল্য বহুগুণে বেড়েই চলছে।

বইকেনা হলো সবচেয়ে ভালো কেনাকাটা। এজন্য রাখা বাজেট বরাদ্দ সবচেয়ে দামি বাজেট। কারণ, গুণীজন বলে গেছেন, বই কিনে কেউ কখনও দেউলিয়া হয় না! তাই তো স্বল্প আয়ের দেশের মানুষ হয়েও আমরা একুশে বইমেলায় প্রায় প্রতিদিন যাই, ভিড় করি, বইয়ের দোকানে তাকিয়ে দেখি, বই কিনি, নিজে পড়ি বা কিনে অন্যকে উপহার দিই। আজ পর্যন্ত সব সমাজেই বই উপহার দেওয়াটাই সবচেয়ে উত্তম উপহার হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।

বই যে কোনো রুচিশীল মানুষের গৃহের সবচেয়ে দামি আসবাব হিসেবে বিবেচিত। অনেকে বই পড়তে পছন্দ না করলেও দামি বই কিনে ঘরের শেলফে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখতে পছন্দ করেন। কারণ বই থাকাটা তার কাছে মর্যাদা ও রুচিবোধের পরিচায়ক।

একুশে বইমেলাকে উপলক্ষ করে একজন লেখক মনোযোগ দিয়ে নিয়মিত বই লেখেন, অনেক প্রুফ সংশোধনীর পর প্রকাশক যত্ন করে প্রকাশনার দায়িত্ব পালন করেন। লেখকের অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, দক্ষতা, মননশীলতা ও লেখনীর সৌকর্য শেষে প্রচ্ছদকারীর নকশা পেরিয়ে ছাপানো হয় কাঙ্ক্ষিত বই। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাস এলেই শুরু হয় আমাদের প্রাণের বইমেলা, যা একুশে বইমেলা নামে পরিচিত। আজ এই বইমেলা পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘদিনব্যাপী ঘটা মহা বই উৎসব।

Advertisement

বর্তমানে নোটকেন্দ্রিক পড়াশোনা ও এমসিকিউ পরীক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের কল্পনাশক্তি জাগায় না। বই পড়া মানুষের কল্পনাশক্তি শানিত করে এবং মানুষ ভবিষৎ নিয়ে বেশি চিন্তা করে সুপথে চলতে পারে। প্রযুক্তি বিকাশের এযুগে মানুষ পড়তে ভুলে যাচ্ছে— শুধু মনিটরে একনজর দেখেই ক্ষান্ত দেয়। অধুনা— টিভি, কম্পিউটার, বিলবোর্ড, সেলফোন, ট্যাব, আইপ্যাড, ক্লাসরুমের পাওয়ার পয়েন্টের ঢাউস স্ক্রিন সব জায়গায় শুধু দেখার সুবিধা তৈরি করে দেয়া হয়েছে।

বর্তমান যুগ শুধু চেয়ে চেয়ে দেখার যুগ। প্রতিদিন প্রতিটি মুহূর্তে এত বেশি দেখার জিনিস আমাদের সামনে ভেসে ওঠে যে আমরা সবসময় দেখার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে বইমেলা আমাদের জন্য প্রতি বছর দেখার একঘেয়েমি থেকে মনোযোগ দিয়ে পড়ার জন্য বিরাট সুযোগ এনে দেয়, যা আমাদের কল্পনাজগৎকে প্রসারিত করে ভবিষ্যতে ভালোভাবে বেঁচে থাকতে শেখায়।

বইমেলার ফলে ছাপানো বই বেড়েছে। কিন্তু প্রতি বছর পাঠকরা বলেন, বইগুলোর মান বাড়েনি। বইগুলোর অন্তর্নিহিত বিষয়বস্তু কী? ছাপার কাগজ কেমন? শেষ দিকে এসে বইমেলায় নোটবই ও বিদেশী নকল এবং ফটোকপি করা বই ভরে সয়লাব হয়ে যায়। দেশের প্রকাশকদের কল্যাণে এদিকটায় কঠোরভাবে নজর দেয়া উচিত। অন্যদিকে একুশে বইমেলা উপলক্ষে শুধু ব্যবসা নয়, পাঠক সংখ্যা বৃদ্ধি করা চাই। প্রকাশকদের কল্যাণে তাদের নিজেদের বইয়ের পাঠক সংখ্যা বৃদ্ধির প্রকল্প হাতে নেওয়া জরুরি।

কাগজের বইয়ের প্রয়োজন সব সময় থাকবে। যতই ডিজিটাল সামগ্রীর শিক্ষা উপকরণ চালু করা হোক না কেন কাগজে ছাপার অক্ষরের কোনো বিকল্প নেই। কারণ দিনের বেলায় কাগজের বই পড়তে আলাদা এনার্জি বা জ্বালানির দরকার হয় না। পৃথিবীতে কোনো দিন জ্বালানির অভাব হলেও মানুষ কাগজে ছাপানো এনালগ বই পড়বে।

আজকাল সব জায়গা থেকে আসল বাংলা হারিয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশে ১১টি শিক্ষাব্যবস্থা একসঙ্গে চলে। ফলে কোনোটাই ভালোভাবে চলে না। তাই তো মাস্টার্স পাস করেও অনেকে শুদ্ধভাবে মাতৃভাষায় কথা বলতে পারে না। শুদ্ধ ইংরেজি বা অন্য কোনো বিদেশি ভাষার কথা বাদই দিলাম। আমলা বা মন্ত্রীগোছের কেউ কেউ এবং কে বলে অ্যাবং, বেগমকে বলে ব্যাগম।

টেলিভিশন তথা অনেক গণমাধ্যমে বিকৃত বাংলা বলা হয়। অনেকে ভালোভাবে বাংলা উচ্চারণ করতে না পেরে তা ঢাকতে গিয়ে ভুল ইংরেজি দিয়ে ধাপ্পা দিয়ে বিকৃত ও উদ্ভটভাবে বাংলা কথা বলার চেষ্টা করেন। টেলিভিশন কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে দ্রুত সচতেন হওয়া বেশ জরুরি।

আসলে যারা মাতৃভাষা ভালোভাবে জানেন ও বলতে পারেন তারা সহজেই যে কোনো বিদেশি ভাষায়ও কথা বলা শিখে ফেলতে পারেন। যার মাতৃভাষায় দুর্বলতা ও ভুল আছে তিনি বিদেশি ভাষায়ও লিখতে পড়তে গিয়ে ভুল করবেন— এটাই স্বাভাবিক। তাই প্রতিটি মানুষের ভাষার ভিত্তি হওয়া উচিত তার মাতৃভাষা।

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন fakrul@ru.ac.bd

এইচআর/ফারুক/জিকেএস