সম্প্রতি পূর্ব ইউক্রেনের দোনেৎস্ক এবং লুহানস্ককে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এমনকি ওই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সেনা মোতায়েনের ঘোষণাও দিয়েছেন তিনি। এরপরেই রাশিয়ার ওপর একের পর নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলো। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের ক্ষেত্রে দ্রুত পদক্ষেপ নিচ্ছে তারা।
Advertisement
সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়া রাশিয়ার ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণা দিয়েছে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন বলেছেন, তার দেশও রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে যাচ্ছে। ব্যাংক, পরিবহন, গ্যাস, তেল এবং টেলিযোগাযোগ বিষয়ের ওপর থাকবে এই নিষেধাজ্ঞা।
এর আগে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে জাপান সরকার। দেশটির প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা বলেন, রাশিয়া ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত হেনেছে। টোকিও পরিস্থিতির ওপর বিবেচনা করে আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারে বলেও হুঁশিয়ারি দেন তিনি। গত মঙ্গলবার (২২ ফেব্রুয়ারি) সবার আগে নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা আসে যুক্তরাজ্যের তরফ থেকে।
রাশিয়ার তিনটি ব্যাংক এবং তিনজন ধনকুবেরের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। এরপর যুক্তরাষ্ট্রও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ইউক্রেন ইস্যুতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রথম দফায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলো যুক্তরাষ্ট্র। প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেছেন, ইউক্রেনে যদি হামলা চালানো হয় তবে আরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে। নিষেধাজ্ঞা আসছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকেও। রাশিয়ার সঙ্গে গ্যাস পাইপলাইনের কাজ বন্ধ করে দিয়েছে জার্মানিও। এছাড়া কানাডার পক্ষ থেকেও নিষেধাজ্ঞা আসছে।
Advertisement
রাশিয়া যদি ইউক্রেনে আরও বেশি সেনা মোতায়েন করে আরও বেশি নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দেওয়া হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। এখন প্রশ্ন উঠেছে যে, এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বের উপর রাশিয়ার আক্রমণের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা এবং ইউক্রেন সীমান্তে আরও সৈন্য মোতায়েন করা থেকে পুতিনকে ঠেকাতে পারবে কিনা।
ইউক্রেন সীমান্তে রাশিয়ার প্রায় এক লাখ সেনা মোতায়েনের ঘটনাকে কেন্দ্র করেই মূলত দুদেশের মধ্যে উত্তেজনা শুরু হয় এবং পশ্চিমা দেশগুলো এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। যদিও শুরু থেকেই রাশিয়া বলে আসছে যে, ইউক্রেনে হামলা চালানোর কোনো পরিকল্পনাই তাদের নেই।
গত সোমবার (২১ ফেব্রুয়ারি) টেলিভিশনে দেওয়া এক ভাষণে পূর্ব ইউক্রেনের দোনেৎস্ক এবং লুহানস্ককে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেন পুতিন। সে সময় তিনি এই দুই অঞ্চলকে ‘পিপলস রিপাবলিকস অব দোনেৎস্ক এবং লুহানস্ক বলে উল্লেখ করেন। দীর্ঘ এক বক্তব্যে পুতিন ইউক্রেন সম্পর্কে বলেন, তারা যুক্তরাষ্ট্রের কলোনি যেটা ‘পুতুল সরকারের’ মাধ্যমে চলছে।
তিনি বলেন, ইউক্রেন কোন দিনই প্রকৃত রাষ্ট্র ছিল না এবং আধুনিক ইউক্রেন রাশিয়ার দ্বারা সৃষ্টি হয়েছে। ইউক্রেনকে ন্যাটোর সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ধারণাকে তিনি রীতিমত আক্রমণাত্মক ভাবে বলেন ‘এটা সরাসরি রাশিয়ার নিরাপত্তার জন্য হুমকি’। তার অভিযোগ, ন্যাটো রাশিয়ার নিরাপত্তার বিষয়টি আমলে নেয়নি।
Advertisement
ভাষণ শেষ করার সময় পুতিন বলেন, রুশপন্থী বিদ্রোহীদের দখলে থাকা অন্যান্য অঞ্চলকেও স্বীকৃতি দেবে রাশিয়া। অপরদিকে পশ্চিমা দেশগুলো প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে, রাশিয়া যদি ইউক্রেনে হামলা চালায় তবে তার জবাবে কঠোর নিষেধাজ্ঞা অপেক্ষা করছে। তারা এক্ষেত্রে রাশিয়াকে কিছুটা সময় দিয়েছে। অর্থাৎ কঠোর নিষেধাজ্ঞা এখনই কার্যকর হচ্ছে না।
মঙ্গলবার (২২ ফেব্রুয়ারি) প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেন, রাশিয়া যদি ইউক্রেনে আক্রমণ চালায় তবে তাদের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ শুরু হবে। ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্ররা ও অংশীদাররা যে পদক্ষেপ নিয়েছিল তার চেয়েও বেশি কিছু আসতে যাচ্ছে বলে হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
ইউক্রেনের সীমান্তবর্তী দেশগুলোর প্রতিরক্ষা শক্তিশালী করতে সহায়তার জন্য বাল্টিক অঞ্চল এবং পোল্যান্ডে সেনা মোতায়েন করেছেন। অপরদিকে ২০১৪ সালে রাশিয়া যখন প্রথমবার ইউক্রেনে প্রবেশ করে, তখন প্রেসিডেন্ট পুতিন সমর্থিত বিদ্রোহীরা ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের বেশ বড় একটি এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। এরপর থেকেই তারা ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াই করে আসছে।
যুদ্ধ বন্ধে আন্তর্জাতিক মিনস্ক শান্তি চুক্তি হয়েছিল, কিন্তু তাতেও লড়াই থামেনি। ইউক্রেনের দুই অঞ্চলকে রাশিয়ার স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টিকে হামলার প্রস্তুতি হিসেবেই দেখছেন পশ্চিমা। তাদের আশঙ্কা, রাশিয়া পুরো ইউক্রেনের ওপর হামলা করার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। খবর পাওয়া যাচ্ছে, বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোয় ট্যাঙ্ক মোতায়েন হচ্ছে এবং ইউক্রেন সীমান্তের ১৫ থেকে ৩০ কিলোমিটারের মধ্যে রাশিয়ার সৈন্যরা অবস্থান নিয়েছে।
ভ্লাদিমির পুতিন হয়তো শুধুমাত্র পূর্ব ইউক্রেনের শান্তি চুক্তি ভেঙ্গে দিয়ে সেখানেই থেমে যেতে পারেন। তারা দাবি করেছে, ইউক্রেনে রাশিয়া কোন হামলা করবে না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো মনে করে, রাশিয়া আরও সামনে এগিয়ে যেতে পারে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, আমাদের বিশ্বাস, তারা ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ লক্ষ্য করে এগোচ্ছে, যেখানে দুই কোটি ৮০ লাখ মানুষ বসবাস করে। এই সংকটের কূটনৈতিক সমাধানের সম্ভাবনাও বেশ ক্ষীণ হয়ে আসছে। ইউক্রেনে ন্যাটোর সৈন্য পাঠানোর কোনো পরিকল্পনা না থাকলেও তারা পরামর্শক, অস্ত্র এবং অন্যান্য সরঞ্জাম দিয়ে সহায়তা করবে বলে জানিয়েছে। এছাড়া রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ একাধিক দেশ ইতোমধ্যেই যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে তারপর আরও বড় ধরণের নিষেধাজ্ঞার প্রস্তুতিও রাখা হয়েছে।
রাশিয়ার অর্থনীতির ওপর এসব নিষেধাজ্ঞা দেশটিকে অর্থনৈতিকভাবে সংকটে ফেলতে পারে। বিশেষ করে রাশিয়ার ব্যাংকিং সিস্টেমের ওপর নিষেধাজ্ঞার ফলে দেশটির আন্তর্জাতিক লেনদেনে বিপর্যয় তৈরি হবে। তবে সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় অর্থনীতির ওপরেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। সে কারণে দুপক্ষকেই এ নিয়ে ভাবতে হবে। পুতিনের মনে কী চলছে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। ইউক্রেনে হামলা চালিয়ে বিভিন্ন দেশের নিষেধাজ্ঞার চাপ মাথায় নেবেন নাকি শান্তিপূর্ণ ভাবে ওই অঞ্চল থেকে সেনা সরিয়ে নেবেন সেটাই এখন দেখার অপেক্ষা।
সূত্র: দ্য ইকেনোমিস্ট
টিটিএন/এএসএম