শিক্ষায়তনসূত্রে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারকে ঘিরে অনেক স্মৃতি আছে, অনেক গল্প আছে। শহীদ মিনারকে দেখেছি দিনের উদীয়মান সূর্যের আলোয় আবার দেখেছি একুশের প্রথম প্রহরে। প্রতিবারের দেখায় মেলে নিত্য-নতুন অনুভব। কখনো অধিকার আদায়ের মিছিল নিয়ে, কখনো প্রতিবাদী সমাবেশে আমাদের গন্তব্য ছিল শহীদ মিনার।
Advertisement
একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য দলবেঁধে বসে থাকতাম জগন্নাথ হলের কোনায় ফুটপাথে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও রাষ্ট্রের অন্যান্য সাংবিধানিক ব্যক্তিবর্গের শ্রদ্ধা নিবেদন পর্ব শেষ হলেই আমরা ছুটে যাবো শহীদ বেদিতে। সে-অপেক্ষার অনুভূতি ব্যতিক্রম।
চারিদিকে শান্তির সুবাতাস। আমরা গ্রহণ করতাম বিশুদ্ধ দেশপ্রেমের সঞ্জীবনী। মনে হতো এভাবে অপেক্ষা করা যায় অনন্তকাল, এমন সময়ের সাক্ষী হই শত-সহস্রবার। ফুলে ফুলে ঢেকে যাওয়া শহীদ মিনারের একটা রূপ আছে, একটা রূপকও আছে। মনে হয় যেন, সব বাঙালির ভালোবাসা আজ এক হয়ে লক্ষ-কোটি পুষ্পরূপে পরম যত্নে আগলে রেখেছে আমাদের স্মৃতির মিনার।
তবে চাকরিসূত্রে এখন যখন প্রতিদিন রিকশায় চড়ে পলাশীর মোড়, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, জগন্নাথ হল পেরিয়ে শহীদ মিনারের সামনে দিয়ে দোয়েল চত্বর হয়ে বাংলা একাডেমি আসি, তখন শহীদ মিনার আমার প্রতিদিনকার দেশপ্রেমের উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে।
Advertisement
শহীদ মিনারের ঠিক অপর পাশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকা। সেখানকার নিরাপত্তা দেয়ালে একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষ্যে নানা রঙের বর্ণে একুশের কথা লেখা হয়। সে দেয়ালিকাগুলোকে আমি প্রতিদিন দেখি, প্রতিদিন পড়ি।
পুরো বছর জুড়েই লেখাগুলো থাকে। যত দিন যায় রোদ-বৃষ্টি-ধুলায় লেখাগুলো একটু একটু করে বিবর্ণ হয় পরের ফেব্রুয়ারির অপেক্ষায়। তবুও কথাগুলোর উদ্দীপক-শক্তি মোটেও ম্রিয়মাণ হয় না। লেখাগুলো আদর্শ ছড়ায়, দেশ ও ভাষা প্রেম জাগায়।
তবে শহীদ মিনারের কিছু চাপা কান্না আছে হয়তো। খুব সন্তর্পণে থাকলে মনের কানে শোনা যায় সে কান্না। আমাদের শহীদ মিনার কাঁদে। শব্দহীন কান্না! কেননা সারাক্ষণ, সারাদিন, সারাবছর সে থাকে খুব অযত্নে, অবহেলায়। সেখানে বসবাস ছিন্নমূল ভবঘুরেদের, সেখানে রাজত্ব করে মাদকসেবী-মাদককারবারীরা। ঝালমুড়িওয়ালা, বাদামওয়ালা, আচারওয়ালা, ডাববিক্রেতা সকলেই বিকিকিনির পসরা বসায় তার বুকের ওপর।
মানুষ সেগুলো খায় আর ছুঁড়ে ফেলে ঠোঙা, বাদামের খোসাসহ আরও কত কী! জুতা পায়ে মানুষের নির্বিকার চলাচল। বাইসাইকেল নিয়ে উঠতি বয়সিদের নানা রকম স্ট্যান্ট। সন্ধে হলেই ছিনতাইকারী ও ইভটিজারদের আনাগোনা। এসব কিছু থামানোর কেউ নেই, নিষেধ করার কেউ নেই, শিষ্টাচারের কথা তো দূরেই থাক। আমার মন বলে, বাঙালির খুব আপন এই ঠিকানা, জাতিসত্তার ধারকক্ষেত্র শহীদ মিনার কষ্টে আছে।
Advertisement
শহীদ মিনার নিয়ে আমার কিছু ভাবনা আছে, স্বপ্ন আছে। আমি প্রত্যাশা করি, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার হবে আমাদের সতত শুদ্ধ বাঙালিয়ানা চর্চার পাদপীঠ। সেখানে একটি গ্রন্থাগার থাকবে। ভাষার বিবর্তন, ভাষা আন্দোলন তথা ভাষার উন্নয়ন ইতিহাস ও ভবিষ্যৎ অনুধাবন এবং গবেষণার জন্য গ্রন্থাগারটি হবে একক ও সমৃদ্ধ। সেখানে প্রমিত বাংলার নিত্য-নিয়ত চর্চা হবে। সে-চর্চা ছড়িয়ে পড়বে সারা বাংলার প্রতিটি স্মৃতির মিনারে। ভাষা ও ভাষাশহীদদের প্রতি বাস্তবিক ও প্রকৃত শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসার একটি সংস্কৃতি গড়ে উঠবে এ প্রাঙ্গণ থেকে। একটি সুভ্যিনির শপও হতে পারে সেখানে। দেশ-বিদেশের দর্শনার্থীরা সেখান থেকে সংগ্রহ করতে পারবে আমাদের জাতিরাষ্ট্র সৃষ্টির স্মারকসমূহ।
শহীদ মিনারে একটি আন্তর্জাতিক মানের ‘সেন্টার ফর লিঙ্গুইস্টিক এক্সিলেন্স’ প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। যেটির লক্ষ্য হবে সারা পৃথিবীতে ভাষার মান ও অস্তিত্ব রক্ষায় একটি আন্তঃপ্রাতিষ্ঠানিক সহকর্ম-সেতু তৈরি করা। পৃথিবীতে যেসব ভাষা আজ বিপন্নতার ঝুঁকিতে আছে, সেসকল ভাষার সুরক্ষায় ‘সেন্টার ফর লিঙ্গুইস্টিক এক্সিলেন্স’ কাজ করতে পারে। এসব উদ্যোগের আরেকটি পরোক্ষ প্রাপ্তির সম্ভাবনা আছে। তা হলো, জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে বাংলাকে অন্তর্ভুক্তির দাবি ও পথ আরও সুগম হবে। তাছাড়া এই প্রতিষ্ঠানের সার্বিক তত্ত্বাবধানে সারা দেশে শহীদ মিনারকেন্দ্রিক শিশুদের জন্য বাংলা ভাষার শুদ্ধ চর্চা ও ছড়া-কবিতার পাঠ-উদ্যান গড়ে তোলা যেতে পারে। বাঙালি হিসেবে আমি চাই, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সুষ্ঠু ও প্রায়োগিক ব্যবস্থাপনা। সেখানে স্থায়ী জনবল থাকুক। চারিদিকে দৃষ্টিনন্দন ও শৈল্পিক নিরাপত্তা বেষ্টনী থাকুক। নিরাপত্তায় থাকুক চৌকশ নিরাপত্তা বাহিনী। সার্বক্ষণিক চলুক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম। অত্যাধুনিক শব্দযন্ত্রে অনির্বাণ মৃদুসুরে বাজতে থাকুক দেশোত্মবোক গান ও কবিতা। এখান থেকে ভাষাচর্চা, সংস্কৃতি ও শহীদ মিনার-শিষ্টাচার ছড়িয়ে পড়ুক সারাদেশের প্রতিটি শহীদ মিনারে।
শহীদ মিনারকে ধারণ করার মতো মানস গড়ে উঠুক আমাদের মনন ও চৈতন্যে। জুতা পায়ে শহীদ মিনারে ওঠার যে নেতিবাচক অভ্যাস সুদীর্ঘকাল ধরে চলছে, তাতে পরিবর্তন আসুক। প্রয়োজনে দর্শনার্থীরা নির্দিষ্ট ও সুরক্ষিত স্থানে জুতা রেখে প্রাঙ্গণে প্রবেশ করুক। শুধু মূল-বেদি নয়, শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে আমাদের জুতা পরে প্রবেশ করা উচিত নয়। কারণ, একজন মানুষ যখন খালি পায়ে শহীদ মিনারের মাটি ও বেদির উপরে হাঁটবে সে শেকড়ের সন্ধান পাবে, বাঙালিত্বের উৎসের সাথে তার সংযোগ তৈরি হবে, তার মধ্যে দেশ ও ভাষা প্রেম জাগ্রত হবে।
দেশের প্রতিটি শহীদ মিনার সুরক্ষিত থাকুক যত্ন ও শ্রদ্ধায়। নিয়মিত সংস্কার হোক প্রতিটি শহীদ মিনারের অবকাঠামো। প্রশাসনেরসুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় আন্তরিক নজরদারি থাকুক। সোজাসাপ্টা কথায়, আমি প্রতিদিন আমার শহীদ মিনারকে চকচকে ঝকঝকে দেখতে চাই। আমার প্রাণের আকুতি, শহীদ মিনার যেন বিবর্ণ না হয়, তার পলেস্তারা যেন খসে না পড়ে কখনো। ভালোবাসি বাংলা, ভালোবাসি শহীদ মিনার। আমার প্রাণের শহীদ মিনার।
লেখক : কর্মকর্তা, বাংলা একাডেমি।
এইচআর/এএসএম