দেশজুড়ে

দীর্ঘ হচ্ছে বৌদ্ধ বিহারে মূর্তি চুরির তালিকা

কক্সবাজার জেলায় বৌদ্ধ বিহারের মূর্তি চুরির ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে। গত এক বছরে জেলার ছয়টি বিহার থেকে ছোট-বড় শতাধিক বৌদ্ধমূর্তি চুরি হয়েছে। এসব ঘটনায় করা হয়েছে তাৎক্ষণিক মামলাও। কিন্তু প্রশাসনের আন্তরিকতার অভাবে এসব ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেখা না যাওয়ায় মূর্তি চুরির ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। ফলে বৌদ্ধ বিহারগুলোতে চরম চুরি আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।রোববার কক্সবাজার শহরের বিজিবি ক্যাম্প পূর্ব বড়ুয়াপাড়ার ধর্মাংকুর বৌদ্ধ বিহার পরিদর্শনে এসে রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের সহকারী পরিচালক প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু এ আতঙ্কের কথা জানান। এ সময় কক্সবাজারের পুলিশ সুপার শ্যামল কুমার নাথও উপস্থিত ছিলেন।রোববার ভোরে শহরের বিজিবি ক্যাম্প এলাকায় অবস্থিত ধর্মাংকুর বৌদ্ধবিহারে দুর্ধর্ষ চুরির ঘটনা ঘটে। এ সময় প্রায় দুই ডজন ছোট ও মাঝারি বৌদ্ধমূর্তি চুরি করে হয়। পাশাপাশি কিছু মূর্তি ভাঙচুরও করে তারা।সদর উপজেলা পরিষেদের উত্তরপাশের ধর্মাংকুর বৌদ্ধবিহারের বিহারাধ্যক্ষ সৌগত প্রিয় ভিক্ষু বলেন, ভোর ৫টার দিকে ঘুম থেকে উঠে দেখি মূর্তিগুলো এলোমেলো। এর কিছুক্ষণ পরই তিনজন শিশু রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া একটি বৌদ্ধমূর্তি এনে দেয়। পরে মূর্তিগুলো গুনে দেখা যায় বেশকিছু মূর্তি চুরি গেছে। চুরি হওয়া মূর্তিগুলোর মধ্যে রয়েছে ৮ ইঞ্চি সাইজের পিতলের আটটি এবং এর থেকে ছোট সাইজের ১৫টি। এসব মূর্তিগুলো থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল।তিনি আরো বলেন, বিহারটি নির্মাণাধীন হওয়ায় চারদিকে টিন বাউন্ডারি দিয়ে ঘেরাও করা আছে। গভীর রাতে টিন ছিদ্র করে চুরের দল চুরি সংঘঠিত করেছে। এ ঘটনায় যা ক্ষতি হয়েছে তা সহজে পূরণ করার মত নয়।বিহারের প্রতিবেশি ঈদগাঁওর পল্লী চিকিৎসক পিপলু বড়ুয়া টিপু বলেন, রাতে একটি প্রাইভেটকার ও কয়েকটি মোটরসাইকেল এলাকায় আসার আওয়াজ শোনা যায়। আমরা ধারণা করেছিলাম কারো বাড়িতে হয়তো মেহমান এসেছে। কিন্তু সকালে উঠে চুরির খবর পেয়ে সবাই হতবাক হয়ে যাই।তিনি আরো জানান, বৌদ্ধ বিহার ছাড়াও বেশ কয়েকটি দোকানে এবং বাসাবাড়িতেও চুরির ঘটনা ঘটেছে বলে ক্ষতিগ্রস্তরা জানিয়েছেন। এটি রহস্যজনক বলে দাবি করেছেন তিনিসহ এলাকার অন্যরা।কক্সবাজার পৌরসভার ৬নং ওয়ার্ড (স্থানীয়) কাউন্সিলর ওমর ছিদ্দিক লালু চুরির বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, খবর পেয়ে বিহারটি পরিদর্শন করা হয়েছে। বিহার কর্তৃপক্ষের দাবি গভীর রাতে মন্দিরের ভেতরে ঢুকে দুর্বৃত্তরা ডজন থানেক ছোট বৌদ্ধ মূতি চুরি করে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে জানতে পেরেছি স্থানীয় পেঁতা সওদাগর পাড়া জামে মসজিদ ও সিকদার পাড়া জামে মসজিদেও চুরির ঘটনা ঘটেছে।এ ব্যাপারে ধর্মাংকুর বৌদ্ধবিহার ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি এবং বৌদ্ধনেতা স্বপন বড়ুয়া বলেন, বৌদ্ধবিহারে চুরির ঘটনা খুবই নেক্কারজনক। এর ফলে বৌদ্ধধর্মালম্বীদের চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। আর যেসব মূর্তি চুরি হয়ে যাচ্ছে সেগুলো পুনরায় সংগ্রহ করা অনেক বেশি দুরূহ ব্যাপার। অনেক সময় বিভিন্ন দেশেও এসব মূর্তি মিলে না। তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, চুরির ঘটনায় জড়িতদের খোঁজে বের করতে প্রশাসনের সুদৃষ্টি কামনা করেন। এ মূর্তি চুরির ঘটনায় থানায় মামলা করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।জানতে চাইলে রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের সহকারী পরিচালক প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু বলেন, একের পর এক বৌদ্ধবিহারে চুরির ঘটনা খুবই উদ্বেগজনক। ২০১৫ সালের ২৩ জুন থেকে এ পর্যন্ত ছয়টি মন্দিরের চুরির ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে রামুতে দুইটি, সদরে দুইটি, মহেশখালীতে একটি ও উখিয়ায় একটি। এতে প্রায় শতাধিক মূর্তি চুরি হয়েছে। প্রত্যেক চুরির ঘটনায় মামলাও হয়েছে। কিন্তু দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় একের পর এক চুরির ঘটনা বেড়ে চলেছে। যা অন্যান্য মন্দিরগুলোকেও আতঙ্কিত করে তুলছে।তিনি আরো জানান, মন্দিরের চুরির ঘটনাগুলোকে হালকাভাবে নেয়ার জন্য চুরির মামলা নেয় পুলিশ। এছাড়া মূর্তি চুরির ঘটনায় পুলিশের চরম আন্তরিকতার ঘাটতি রয়েছে। যার ফলে মূর্তি চুরির অপরাধীরাও বেপরোয়া হয়ে উঠছে। ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রামুতে বৌদ্ধ বিহারগুলোতে যে সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছিল তার ক্ষত কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করছে বৌদ্ধরা। কিন্তু একের পর মূর্তি চুরির কারণে তা পর্যায়ক্রমে অসম্ভব হয়ে উঠছে। তাই বিহার থেকে মূর্তি চুরির ঘটনাগুলোকে হালকাভাবে না নিয়ে অপরাধীদের ধরে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানান। এটি সম্ভব হলে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না বলে দাবি তার।কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার শ্যামল কুমার নাথ বলেন, রোববারের ঘটনাটি প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে- একটি সংঘবদ্ধ চুরির ঘটনা। কারণ একই রাতে এক কিলোমিটারের মধ্যে একটি মন্দির, দুইটি মসজিদ ছাড়াও সাতটি দোকান এবং তিনটি বাড়িতে চুরির ঘটনা ঘটেছে। যে কোনো মূল্যে এই সংঘবদ্ধ অপরাধীদের আটক এবং চুরি হওয়া বৌদ্ধ মূর্তিগুলো উদ্ধারের চেষ্ঠা চলছে।তিনি আরো বলেন, এর আগেও মহেশখালীতে যে বৌদ্ধমূর্তি চুরি হয়েছিল সেগুলো জোর প্রচেষ্টায় উদ্ধার করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িতরা ছিঁচকে অপরাধী। ভবিষ্যতে যাতে মন্দির থেকে মূর্তি চুরির ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেজন্য কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।সায়ীদ আলমগীর/এআরএ/বিএ

Advertisement