একুশ মানেই অচলায়তন ভেঙে তারুণ্যের জেগে ওঠা। একুশ মানে ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষুর বিপরীতে অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই। একুশ এলেই হৃদয়ের গভীরতম প্রদেশে অনুরণিত হতে থাকে শেকল ভাঙার গান। আমাদের হৃদয়ের ভাষা মুখের ভাষা প্রকাশের ভাষা হলো বাংলা। বাংলা আমার মায়ের ভাষা। আমার দেশ ও মাটির ভাষা। বাংলায় কথা বলে আমরা মনে তৃপ্তি পাই। সুখ বিলাসের বারিধারায় সিক্ত হই। আত্মতৃপ্তি ও গর্বে মনটা দোলে উঠে। এই ভাষার সাথে আমাদের সম্পর্ক নাড়ির। খুব নিবিড়।
Advertisement
রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের এ বাংলা ভাষা। পৃথিবীর ইতিহাসের পাতা ওল্টালে যে ভাষা রক্ষায় মানুষের রক্ত কালো পিচঢালা কংক্রিটের পথকে রক্তিম করে ইতিহাসের পাতা রক্তাক্ত করে বিশ্ব দরবারকে থমকে দিয়েছে সে আমাদের গর্বিত বাংলা ভাষা। পৃথিবীর অধ্যায়ে একমাত্র বাঙালি জাতি মায়ের ভাষার জন্য তাজা খুন ঢেলে দিয়েছে। বুলেটের সামনে উন্মুক্ত করে দিয়েছে বুক। দানব বুলেটকে দেখিয়েছে বৃদ্ধাঙ্গুল। মরণকে মেনে নিয়েছে হাসিমুখে। আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে শ্লোগান তুলেছে মায়ের ভাষা রক্ষার। দৃঢ় শপথে বলিয়ান হয়ে মুষ্টিবদ্ধ হাতে রাজপথে নেমেছে জীবন মরণ বাজি রেখে।
ভাষা আন্দোলন শুধু একটি ‘একুশ’ কিংবা একটি ‘ফেব্রুয়ারি’ বা একটি ‘বায়ান্ন’ উদযাপনের জন্য অর্জিত হয়নি। সবার মুখের ভাষা বাংলা হবে, সর্বস্তরে বাংলা চালু হবে, রাষ্ট্রভাষা বাংলা হবে এসব দাবি, প্রত্যাশা ও স্বপ্ন নিয়েই ভাষা আন্দোলনের সূর্যোদয় হয়েছিল। বাংলাদেশ সৃষ্টির মূলে রয়েছে বাংলা ভাষা অর্থাৎ ভাষা আন্দোলন। কাজেই বাংলা কেবল আমাদের মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম নয়, তা আমাদের জীবনচর্চার সঙ্গেও মিশে আছে। বাংলাকে বাদ দিয়ে আমাদের নিজস্বতার বিকাশ ঘটানো সম্ভব নয়।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরও বাংলা আমাদের রাষ্ট্রীয় কিংবা সমাজ জীবনের প্রধান ভাষা হয়ে উঠতে পারেনি। বাংলাদেশের অভিজাত শ্রেণি থেকে শুরু করে শ্রমজীবি সম্প্রদায় শুদ্ধ বাংলা নয়, বরং ভুল ইংরেজিতে কথা বলতে পারলেও এক ধরনের গৌরব বোধ করেন। গণমাধ্যমে চলছে ইংরেজি ও বাংলার অদ্ভুত এক মিশেল। আমাদের সাহিত্য, বিশেষত কবিতা ও উপন্যাস, বাংলা ভাষাকে যতটা বিকশিত করেছে তা যদি তরুণ-প্রজন্ম গ্রহণ করতো তাহলে হয়তো সংস্কৃতিগতভাবে আমাদেরকে এই বনসাই জীবনযাপন করতে হতো না।
Advertisement
ঔপনিবেশিকতার ঘোর কাটতে আমাদের হয়তো আরও কয়েক দশক সময় লাগবে। তবু হঠাৎ, খানিকটা নিভৃতে, নিজের অজান্তেই প্রশ্ন জাগে- এই ঘোর কাটবে তো?
কেননা দেখা যায়, আমাদের দেশে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে কলেজ ভার্সিটি থেকে বের হওয়ার পরও আমরা প্রমিত উচ্চারণে কথা বলতে বা শুদ্ধ বানানে লেখায় পারদর্শী হতে পারি না। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞপ্তিতে বানানের ভুল থাকে দেদার। এমনকি আমাদের দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কলকারখানা, সংস্থা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির নাম কিংবা তাদের পণ্যের প্রচার-প্রসারের জন্য বিভিন্ন বিজ্ঞাপন প্রচারের ক্ষেত্রেও ভাষার মান বজায় রাখে না। এতে আমরা দ্বিধায় পড়ে যাই শুদ্ধ বানান নির্বাচন নিয়ে। একেক স্থানে একেক বানান দেখে আমরা বিভ্রান্ত হই।
ভাষার মাসেও ভাষা-সচেতনতা নিয়ে তাই প্রশ্ন থেকেই যায়। তবে শুধু ভাষার মাসেই নয়, ভাষার এমন বিকৃত কিংবা অশুদ্ধ ব্যবহার নিয়ে বছরব্যাপী সোচ্চার হওয়া উচিত। ভাষার এমন বিকৃত কিংবা অশুদ্ধ ব্যবহার হতো না, যদি আমরা নিয়মিত বাংলা ভাষার চর্চা করতাম এবং মায়ের ভাষা হিসেবে যথাযথ সম্মান ও গুরুত্ব দিতাম। ভাষার নিয়মিত চর্চা ও যথাযথ গুরুত্বের অভাবে আমরা এখন ‘খণ্ডকালীন’ তথা বহুলাংশে ‘আনুষ্ঠানিক’ বাঙালি হয়ে গেছি। আমাদের বাঙালিপনা ও বাংলাপনা সবই যেন আনুষ্ঠানিক চর্চায় রূপ নিয়েছে। তাই ফেব্রুয়ারি মাস এলেই কেবল আমাদের ভাষার দরদ যেন উথলে ওঠে।
রক্তে অর্জিত ভাষার সারাবছরব্যাপী শুদ্ধ ভাষা চর্চা হোক। অভিযান পরিচালনা হোক বানানের শুদ্ধতা রক্ষা ও চর্চার। নিষিদ্ধ করা হোক ভুল বানান ও ভিন্ন ভাষার ব্যবহার। প্রয়োজনে সরকারিভাবে নিযুক্ত করা হোক পর্যবেক্ষক বা প্রতিনিধি দল। বন্ধ করা হোক অশুদ্ধ বানানের সব আয়োজন।
Advertisement
লেখক : শিক্ষার্থী। rodelasumi1996@gmail.com
এইচআর/জেআইএম