মতামত

একুশে ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে বঙ্গবন্ধু

২১ ফেব্রুয়ারি বাঙালির ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায় আর এর সাথে বঙ্গবন্ধুর নাম নিবিড়ভাবে জড়িত। জাতির পিতা ১৯৪৮, ১৯৫২, ১৯৫৬, ১৯৬২, ১৯৬৯ এর আন্দোলনের দিনগুলোতে, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নে, ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘে মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করার মাধ্যমে ভাষার মর্যাদা সমুন্নত করেছিলেন।

Advertisement

১৯৭১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করার এক অমিত ভাষণ দিয়েছিলেন, যা ছিল প্রত্যক্ষভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য বাঙালি জাতিকে প্রস্তুত করার রণকৌশল। এ যেন ৭ মার্চ ও ২৬ মার্চের জন্য জাতিকে পূর্ব প্রস্তুতিমূলক সবুজ সংকেত দিয়েছিলেন সমরনায়ক। পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা এ ভাষণ নিয়ে বিশেষ রিপোর্টে এ উল্লেখ করেছিল যে, এ ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের নাম উচ্চারণ করে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে ডাক দিয়েছিলেন, আর যুদ্ধে শহীদ নয় গাজী হওয়ার আত্মবিশ্বাস দিয়েছিলেন। শহীদ দিবসের প্রতিশোধে বাঙালিদের কাপুরুষ নয় সাহসী হতে ইন্দন দিয়েছিলেন, রক্ত দিয়ে হলেও দাবি আদায়ে রুখে দাঁড়াতে বলেছিলেন।

১৯৭১ সালের একুশের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে এক শোভাযাত্রা করে সভাস্থলে পৌঁছালেন। তিনি বলেন, বাঙালিরা বহু রক্ত দিয়েছে, ১৯৫২ সাল থেকে যে রক্ত দেওয়া শুরু হয়েছিল, তা কবে শেষ হবে জানা নেই। তাই শহীদ দিবসে তিনি শপথ নিতে বলেন, ‘যে পর্যন্ত সাত কোটি মানুষ তাদের অধিকার আদায় করতে না পারবে, সে পর্যন্ত বাংলার মা-বোন, ভাইয়েরা শহীদ হবে না, গাজী হবে।’

তিনি বলেন, যে ষড়যন্ত্রকারীরা ১৯৫২ সালে গুলি করে বাঙালিদের শহীদ করেছিল তারা তাদের কাজ শেষ করেনি, ষড়যন্ত্র চলছে, ভবিষ্যতে চলবে। কিন্তু বাংলাদেশের চেহারা তারা দেখেনি। তিনি উপস্থিত জনতাকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আপনারা আমার মনের অবস্থা বুঝতে পারেন, ভাষা আন্দোলন ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ থেকে শুরু হয়। ১৯৫২ সালে বাঙালি ভাইয়েরা রক্ত দিয়ে প্রমাণ করেছে বাংলা ভাষাকে আমরা অমর্যাদা করতে দেব না, রক্তের বিনিময়ে হলেও বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করেছি।’

Advertisement

তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘যারা বাঙালিকে দমাতে চায়, যারা বাংলার সংস্কৃতি, বাংলার মানুষকে লুট করতে চায়, কলোনি করতে চায়, নিজেদের বাজার করতে চায়, এতো বড় বিজয়ের পরও যারা ষড়যন্ত্র করতে চায়, তাদের জেনে রাখা উচিত ১৯৫২ সালের বাঙালি আর ১৯৭১ সালের বাঙালির মধ্যে পার্থক্য আছে।’

বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের দুঃশাসনের কথা তুলে ধরে বলেন, ‘১৯৫২ সালে এ পবিত্র দিনে বাংলার ভাইবোনরা রক্ত দিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে গেছে, দরকার হলে আমরা বাংলার মানুষ রক্ত দিতে জানি। বাঙালি ১৯৫২ সালে শহীদ হয়েছে, ’৫৪ সালের অত্যাচার, ’৫৮ সালের অত্যাচার, ’৬২ সালের শহীদ, ৭ জুনের শহীদ, ’৬৯ এর গণআন্দোলনে শহীদ হয়েছে, নাম না জানা অচেনা ভাইবোনরা রক্ত দিয়েছে। কিন্তু আজ বাংলার মানুষ শুধু গুলি খেয়ে শহীদ হচ্ছে না, না খেয়ে শহীদ হচ্ছে। কাপড় পায় না, পেটে খাবার নেই, পাকিস্তানিরা সব শোষণ করে নিয়ে যাচ্ছে, বাংলার মানুষকে বাজারে তুলেছে, বাংলার সম্পদ লুট করেছে, বাংলার মানুষকে পথের ভিখারি করেছে।’

আঞ্চলিক রাজনীতির ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা কারও ওপর বেইনসাফ করতে চাই না, পাঞ্জাব তার অধিকার পাক, সিন্ধু তার অধিকার পাক, পাঠান তার অধিকার পাক, বেলুচ তার অধিকার পাক, আমরাও বাঙালি আমরা আমাদের স্বাধিকার চাই, এখানে কোনো আপস নাই।’ তাই তিনি সবাইকে অনুরোধ করে বলেন, বাংলার ঘরে ঘরে যেতে, প্রস্তুত হয়ে যেতে, বাংলাদেশের ভাইয়েরা আর শহীদ নয় গাজী হয়ে মায়ের কোলে ফিরে যেতে হবে, শহীদ নয় গাজী।

তিনি ’৫২ এর শহীদদের কথা স্মরণ করে আবেগাপ্লুত হয়ে বলেন, ‘আমাদের ভাইদের কথা ভুলতে পারি না, যাদের মা আজও কাঁদে, যাদের বাবা আজও কাঁদে, যাদের ছেলেমেয়ে চিৎকার করে বাবাকে খুঁজে বেড়ায়। সে শহীদের আত্মা বাংলার ঘরে ঘরে, বাংলার দুয়ারে দুয়ারে আঘাত করে বলছে, বাঙালি তুমি কাপুরুষ হইও না, বাঙালি তুমি জানের জন্য ভয় করো না, সংগ্রাম করে এগিয়ে যাও।” তাই তিনি শহীদ দিবসে সবাইকে নিয়ে শপথ নেন, ‘সবাই রক্ত দিবে, দাবি ছাড়বে না, দাবি আদায় করে ছাড়বে।’

Advertisement

বঙ্গবন্ধু সবাইকে সতর্ক করে বলেন, ‘সামনের দিন আরও কঠিন হবে, ষড়যন্ত্রকারীরা থামে নাই, তারা কাজ চালিয়ে যাচ্ছে, আমরা সবার ভ্রাতৃত্ব কামনা করি, কিন্তু তার অর্থ এই নয় কেউ সাত কোটি মানুষকে গোলাম করে রাখবে, তার অর্থ এই নয় বাংলাদেশকে বাজার বা কলোনি করে রাখবে।’

তিনি ’৬৯ এর গণআন্দোলনের স্মৃতিচারণ করে বলেন, যে রক্ত দিয়ে বাংলার মানুষ একদিন আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে তাকে মুক্ত করে এনেছে, তিনি শহীদ দিবসে ওয়াদা করে গেলেন নিজ রক্ত দিয়ে হলেও ’৬৯ এর রক্তের প্রতিদান দেবেন। তিনি আরও বলেন, ‘মানুষ পয়দা হয় মৃত্যুর জন্য, বেঁচে আছি এটা একটা অ্যাক্সিডেন্ট, আজ ঘুরছি কাল মরে যেতে পারি। যারা দেশের জন্য শহীদ হয়েছেন তারা পথ দেখিয়ে গেছেন, এখন যারা শহীদ হবেন তারাও পথ দেখিয়ে যাবেন, ভবিষ্যৎ বংশধর বুক উঁচু করে দাঁড়িয়ে বলতে পারবে, আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমার স্বাধিকার আছে, আমার অধিকার আছে।’

একপর্যায়ে বঙ্গবন্ধু তার রণকৌশল ব্যক্ত করলেন, ‘শহীদ দিবসে আপনাদের কাছে অনুরোধ আপনারা ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলেন। আমরা সবার প্রতি সহানুভূতিশীল, কিন্তু কেউ যদি অন্যায়ভাবে আমাদের ওপর শক্তি ব্যবহার করতে চায়, নিশ্চয় এদেশের মানুষ তা সহ্য করবে না।’

একুশের শহীদের কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘যতোদিন পর্যন্ত বাংলা থাকবে, বাংলার মাটি থাকবে, বাংলার আকাশ থাকবে, ততোদিন পর্যন্ত একুশের শহীদের কথা কেউ ভুলতে পারব না। কারণ ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে এই ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায় না এই বাংলার মাটি ছাড়া।’

ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি রোমন্থনে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘সে আন্দোলনে আমিও জড়িত ছিলাম, ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ আমি গ্রেফতার হয়ে জেলে যাই। ১৯৫২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি জেলের মধ্যে আমি অনশন ধর্মঘট করি, আর একুশে ফেব্রুয়ারি স্নাতক আন্দোলনের পরামর্শ দিতে থাকি। ২৭ ফেব্রুয়ারি আমাকে স্টেচারে করে জেল থেকে বের করে দেওয়া হয়, যদি আমি মরে যাই জেলের বাইরে যেন মরি, এই আন্দোলনের সাথে আমি জড়িত ছিলাম, আজও জড়িত আছি, জানি না কতদিন থাকতে পারব তবে প্রস্তুত আছি।’

সবশেষে তিনি উপস্থিত জনতাকে দাবি আদায়ের কথা তুলে ধরে বলেন, ‘আপনাদের কাছে এটুকু বলব এই বাংলার মানুষ যেন আর অপমানিত না হয়। যারা শহীদ হয়েছেন তাদের রক্তের সাথে যেন কেউ বেঈমানী না করে। মনে রাখবেন, আপনারা নিশ্চয় জানেন এবং বিশ্বাস করেন শহীদের রক্ত কখনো বৃথা যায় নাই, আর যাবেও না ইনশাল্লাহ। তাই আপনাদের কাছে বিদায় নিচ্ছি এই রাত্রবেলা, না জানি আবার কবে দেখা হয়, আপনারা প্রস্তুত হয়ে যান, আমরা যখন রক্ত দিতে শিখেছি, বাঙালি তার দাবি আদায় করবেই।’

উপস্থিত জনতাকে দাবি আদায়ে সোচ্চার করতে বঙ্গবন্ধু নিজেই স্লোগান ধরলেন,‘শহীদ স্মৃতি অমর হোক, জয় বাংলা।’

লেখক : সদস্য, অর্থ ও পরিকল্পনা বিষয়ক উপকমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।

এইচআর/ফারুক/জেআইএম