মতামত

ভাতের অভাব নেই, কাকের অভাব হবে কি?

দেশে এখন সবচেয়ে আলোচিত বিষয়- নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশন গঠনের তোড়জোড় চলছে মাসাধিক সময় ধরে। এতদিন নির্বাচন কমিশন গঠনের কোনো আইন ছিল না। এবার আইন হয়েছে। সেই আইন মোতাবেক গঠিত হয়েছে ছয় সদস্যের অনুসন্ধান বা সার্চ কমিটি। সেই কমিটি বিভিন্ন মহল থেকে নাম সংগ্রহ করে তার থেকে ১০ জনের নাম বাছাই করে রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দেবে। রাষ্ট্রপতি ৫ জনকে নিয়ে গঠন করবেন নির্বাচন কমিশন। এই নাম বাছাই প্রক্রিয়া শেষের দিকে।

Advertisement

অনুসন্ধান কমিটি ২৪ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ১০ জনের নাম চূড়ান্ত করে জমা দেবেন। এখন সবার আগ্রহ কাদের নিয়ে নি্র্বাচন কমিশন গঠন হয়, সেটা দেখার। তবে যাদের নিয়েই কমিশন গঠন হোক না কেন, তাতে বিতর্ক শেষ হবে না। নির্দলীয় নিরপেক্ষ ৫ জন মানুষ, যারা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবেন, খুঁজে বের করা আমাদের দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। আমাদের রাজনীতি বিভক্ত। আমাদের দেশে অসংখ্য রাজনৈতিক দল। কোনো প্রশ্নে একমত হতে না পারার জন্যই তো এত দল,এত দলাদলি। বিশেষ করে দেশের প্রধান বা বড় দুই দল– আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একমত হবে– এটা এক বড় কষ্টকল্পনার বিষয়।

নতুন যে নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে, সেই কমিশনের তত্ত্বাবধানেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আওয়ামী লীগ চাইবে পরের নির্বাচনেও জয়লাভ করে আবারও সরকার গঠন করতে। আর বিএনপি চাইছে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটিয়ে নিজেরা ক্ষমতায় যেতে। বিএনপি মনে করে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা তলানিতে ঠেকেছে। এখন সামান্য ধাক্কা দিলেই সরকারের পতন হবে। তাই তারা নির্বাচনের চেয়ে আন্দোলনের কথা বেশি বলছে। তবে বিএনপির পক্ষে দেশে বড় আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব নয় বলেই বেশিরভাগ রাজনৈতিক বিশ্লেষকের ধারণা।

একটি বিষয় সবার মনে রাখা দরকার যে, দেশের মানুষের মধ্যে আওয়ামী লীগ নিয়ে, আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রী-এমপিদের নিয়ে সমালোচনা-ক্ষোভ-হতাশা বাড়লেও শেখ হাসিনার প্রতি আস্থা কমেনি। আওয়ামী লীগ অজনপ্রিয় হলেও শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা কমেনি। বরং তার চেয়ে ভালো সরকার প্রধান আর কে হতে পারেন তার কোনো আলো মানুষের সামনে নেই।

Advertisement

বিএনপি ক্ষমতায় গেলে প্রধানমন্ত্রী কে হবেন তা পরিষ্কার নয়। তারেক রহমানকে প্রধানমন্ত্রী পদে দেখতে না চাওয়ার মতো মানুষ বিএনপিতেও কম নেই। তবে বিএনপি এবার সরকারবিরোধী বৃহত্তর ঐক্য গঠনের চেষ্টা করছে। ডান-বামের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে বিএনপি। বড় ঐক্য বড় আন্দোলন তৈরি করবে, নাকি বড় সঙ্কট তৈরি করবে, দেখার বিষয় সেটাই।

রাজনীতি একটি দেশের মূল চালিকা শক্তি। দেশের সব মানুষ রাজনীতি করেন না, অধিকাংশ মানুষই রাজনৈতিক দলের বাইরে থাকেন। আবার যাঁরা রাজনীতি করেন, রাজনীতি সচেতন তাঁরা সবাই একটি রাজনৈতিক দলের সদস্য হন না। মানুষ নানা মত ও নানা পথে বিভক্ত। আর এই ভিন্নতার মধ্যেও একসঙ্গে চলার ঐক্যসূত্র যে রাজনীতি সেই রাজনীতিই মূলত জনকল্যাণমুখী, বেশি মানুষ তেমন রাজনীতির ওপরই ভরসা রাখেন।

ইতিহাসের দীর্ঘ পথে না হেঁটে সংক্ষেপে বলার কথা এটাই যে, একটি গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পাকিস্তান ছিল অগণতান্ত্রিক, সাম্প্রদায়িক ও বৈষম্যমূলক রাষ্ট্র। এসবের বিরুদ্ধে লড়েই যেহেতু বাংলাদেশের অভ্যুদয়, সেহেতু বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও বৈষম্যবিরোধী হবে- এটাই ছিল সাধারণ জনপ্রত্যাশা।

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে শুরুটা সেরকমই হয়েছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে ছন্দপতন হলো। তারপর আবার লড়াই, সংগ্রাম। এক পর্যায়ে হত্যা কিংবা বন্দুকের নল দেখিয়ে ক্ষমতা দখলের ধারা বদল হলেও রাজনীতির ভেতর ঢুকে গেছে কতগুলো খারাপ প্রবণতা। এক সময় বলা হতো ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে বড় দেশ। কিন্তু এখন দেশের চেয়ে দল বড়, আবার ক্ষেত্রবিশেষে দলের চেয়েও বড় হয়ে ওঠেন ব্যক্তি। এক সময় রাজনৈতিক নেতারা নীতির প্রতি নমনীয় থেকে কৌশলের ক্ষেত্রে নমনীয়তা দেখাতেন। এখন কৌশলে নমনীয় না হলেও নীতির প্রশ্নে নমনীয়তা দেখান অনেককেই।

Advertisement

এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় থেকে দেশে বিভিন্ন দলের সমন্বয়ে জোট গড়ে আন্দোলন ও নির্বাচনের যে রাজনীতি শুরু হয়েছে তা এখনো অব্যাহত আছে। তবে এই ধারা আর কত ফল দেবে সে প্রশ্নও উঠছে।। নীতি-আদর্শের ভিত্তিতে জোট গঠন না হলে শুধু ক্ষমতা লক্ষ্যের ঐক্য এক সময় নড়বড়ে হয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক।

২০০৯ ও ২০১৪ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠনের সময় আওয়ামী লীগ জোট সঙ্গীদের ‘মূল্যায়ন’ করলেও অর্থাৎ মন্ত্রীত্বের ভাগ দিলেও ২০১৮ সালে মন্ত্রিসভায় জোটের অংশীদারিত্ব নেই। আনুষ্ঠানিকভাবে জোট ভেঙে দেওয়া না হলেও জোটের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নৈকট্য কমেছে। জাতীয় পার্টি একসময় মন্ত্রিসভায়ও ছিল আবার সংসদে বিরোধী দলের দায়িত্বও পালন করেছে। এখন জাতীয় পার্টি মন্ত্রিসভায় না থাকলেও সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করছে। জোটের রাজনীতি নিয়ে জোটসঙ্গীদের মধ্যে ক্ষোভ-অসন্তোষের বিষয়টি আর গোপন থাকছে না।

এরশাদের তৈরি জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু গত ২৭ নভেম্বর জাতীয় সংসদের এক বক্তৃতায় বলেছেন, ‘সরকারের কথা বলতে গিয়ে এমন অবস্থা হয়েছে, জনগণ এখন আমাদের আওয়ামী লীগের দালাল বলে। আমরা এখন দালালি নামটা মুছতে চাই। তারপরও যদি আপনাদের মন না ভরে, তাহলে তো কিছু করার নেই’।

‘দালালি’ নাম মোছার জন্য আগামী নির্বাচনে যদি আওয়ামী লীগের সঙ্গে কোনো ধরনের আসন সমঝোতা না হয় তাহলে জাতীয় পার্টি কি খুব ভালো ফল করবে? গণ-আন্দোলনের মুখে এরশাদের পতনের পরও রংপুরসহ দেশের কিছু এলাকায় জাতীয় পার্টির যে জনপ্রিয়তা ছিল, এত বছর পর তা আর নেই। এককভাবে নির্বাচন করে জাপা কয়টি আসনে জিততে পারবে তা নিয়ে ভবিষ্যৎদ্বাণী করার মতো রাজনৈতিক জ্যোতিষী দেশে আছে বলে মনে হয় না।

১৪-দলের অন্যতম শরিক দল ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের মুখেও সম্প্রতি আক্ষেপের কথা শোনা গিয়েছে। ১৫ ডিসেম্বর এক সভায় মেনন বলেছেন, ‘জনগণ আমাদের ক্ষমতার উচ্ছিষ্টভোগী বলে। ১৪- দলকে সেভাবে গড়ে তুলতে পারিনি। আওয়ামী লীগ আমাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে ঐক্যের কথা বলেছে। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের স্বার্থে আমরা ঐক্য করেছিলাম। কিন্তু সেই ঐক্যের প্রতিফলন আমরা পাইনি’।

ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য জোটের প্রযোজন থাকলেও ক্ষমতায় যাওয়ার পর জোট নিয়ে আর তেমন আগ্রহ থাকে না। তারপরও রাশেদ খান মেনন মন্ত্রী হয়েছেন। এখনো সংসদ সদস্য আছেন। এগুলো তো ঐক্যের সুফল। আওয়ামী লীগ দয়া না করলে কি এসব হতো? রাজনীতিটা এখন আসলে পাওয়ারই জায়গা হয়ে উঠেছে। পাওয়ার সুযোগ ও সম্ভাবনা না থাকলে আর দল কেন, জোট কেন, রাজনীতি কেন?

রাজনীতির কারণেই তো কতজন নেতা হয়েছেন, ক্ষমতার স্বাদও পেয়েছেন। মানুষ দালাল কিংবা উচ্ছিষ্টভোগী বললেই ক্ষতি কি? ভোগ করতে তো সমস্যা হয়নি, হচ্ছে না। তবে ক্ষমতা তো কারোর জন্যই চিরস্থায়ী নয়। তাই দালাল হওয়া কিংবা উচ্ছিষ্টভোগী হওয়াও চিরকালের বিষয় হতে পারে না।

আগামী নির্বাচনের এখনো দেরি আছে। কেমন হবে আগামী নির্বাচন তা এখনই বলা মুশকিল। জোট থাকবে, নাকি একক শক্তিতে মাঠে নামবে আওয়ামী লীগ তা-ও পরিষ্কার নয়। আওয়ামী লীগ ঐক্য নিয়ে খুব চিন্তিত বলেও মনে হয় না। রাজনীতি এখন পুরোপুরি আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে। কেউ জোট থেকে বেরিয়ে গেলে আওয়ামী লীগ অথৈ পানিতে ভাসবে, তা নয়।

আওয়ামী লীগ মনে করে ভাত ছিটালে কাকের অভাব হয় না। দেশে যেমন রাজনৈতিক ‘কাউয়া' বা কাকের অভাব নেই, তেমনি আওয়ামী লীগেরও ভাতের অভাব নেই। আগামী নির্বাচনের আগে পুরনো দালাল ও উচ্ছিষ্ট ভোগীদের কেউ সরে গেলেও নতুন দালাল ও উচ্ছিষ্ট ভোগীর অভাব হবে বলে মনে হয় না।

লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক। সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা।

এইচআর/জেআইএম