শুরু হয়েছে বইমেলা। প্যান্ডেমিকের মধ্যে দেরিতে হলেও বাংলা একাডেমি আর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মেলা বসায় দারুণ আহ্লাদিত লেখক, প্রকাশক আর ক্রেতা-পাঠকরা। প্রধানমন্ত্রী মেলার উদ্বোধনীতে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে আশ্বাস দিয়েছেন প্যান্ডেমিকের এখনকার নিম্নমুখী ধারা অব্যাহত থাকলে মেলার মেয়াদ মার্চে আরও ১৫ দিন বাড়িয়ে মাসের মেলা মাসব্যাপীই করার বন্দোবস্ত করবেন তিনি।
Advertisement
একুশের বইমেলা বাঙালি আর বাঙালিত্ব উদযাপনের বৃহত্তম উৎসব। আজকের স্বাধীন বাঙালি জাতি আর তার এই স্বাধীন বাসভূমির স্বপ্নযাত্রার শুরুটা একুশেই। নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ আর তার আগে দুই যুগের নানা রাজনৈতিক সংগ্রাম-আন্দোলন আর ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে বাঙালির চূড়ান্ত বিজয়ের ইতিহাস ঘাটতে বসলে প্রথম যে আইকনিক ঘটনাটি চিহ্নিত করতে হয় তা বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি।
এই বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে একুশে যাত্রা শুরু করে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি অবিস্মরণীয় বিজয়। বঙ্গবন্ধুর যোগ্য উত্তরসূরি, বঙ্গবন্ধু কন্যা বাঙালি আর বাঙালিয়ানার এই মূল এসেন্সটা ধারণ করেন বলেই একুশের বই মেলার প্রতি তার এত বেশি পক্ষপাতিত্ব।
একুশের পটভূমিতে একটি ভাষাকে কেন্দ্র করে অমন ঘটনাবহুল ক্যানভাসে বাংলাদেশ নামক যে জাতি রাষ্ট্রটির জন্ম, তা যে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ধর্মভিত্তিক পাকিস্তান নামক অকালকুস্মান্ড রাষ্ট্রটির চেয়ে শতগুণে বেশি সফল আর ডাইভারসিভাইড তবে তেমনটাই তো প্রত্যাশিত।
Advertisement
কদিন আগেই একুশের বইমেলা শুরুর ঠিক আগ দিয়ে বাঙালি বরণ করলো বসন্ত আর পাশাপাশি মেতে উঠেছিল ভ্যালেন্টাইনস ডে উদযাপনেও। আবহমান বাঙালি সংস্কৃতির অংশ এই বসন্তবরণ, আজ যা বাঙালির সত্তারও অংশ বটে। অন্যদিকে ভিনদেশি সংস্কৃতি থেকে আমদানি করা ভ্যালেন্টাইনস ডেও এখন বাঙালিরই উৎসব।
বাঙালি তার মজ্জাগত উদারতায় আলিঙ্গন করেছে ভিনদেশি এই উৎসবটিও। বাঙালি বর্ষপঞ্জির সাম্প্রতিক পরিবর্তনের সুবাদে এই দুটি উৎসবই যেহেতু এখন থেকে একই দিন, কাজেই উৎসবের উদযাপনটাও এখন অন্য মার্গের। এবার এই প্যান্ডেমিকের মধ্যেও এই দুই উৎসবকে কেন্দ্র করে বাঙালির প্রাণের উচ্ছ্বাসের যে উচ্ছ্বসিত বহিপ্রকাশ আমরা দেখেছি, তা থেকে এটা সহজেই অনুমেয় যে প্যান্ডেমিকটা কেটে গেলে ফেব্রুয়ারি দিনটি বাঙালিকে সামনে কি বিপুলভাবেই না আন্দোলিত করবে।
১৪ ফেব্রুয়ারি উদযাপিত হয়েছে পাকিস্তানেও। ঢাকায় যেমন, পাকিস্তানের বড় শহরগুলোতেও এই বিশেষ দিবসটির উদযাপন ছিল মূলত ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক। দিবসটি উদযাপনে পাকিস্তানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশেষ দিকনির্দেশনা জারি করেছে। ইসলামাবাদের কায়েদ-ই-আজম বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন প্রফেসর ডা. মোহাম্মদ আলী স্বাক্ষরিত ১৩ ফেব্রুয়ারির নোটিশে বলা হয়েছে, ছাত্রীদের এই দিন ক্যাম্পাসে কালো বোরকা পরে আসতে হবে। আর ছাত্রদের মাথায় থাকতে হবে সাদা টুপি।
‘হায়া দিবসে’র ব্যত্যয় করলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে তিন হাজার রুপি ফাইনের কথা বলা আছে নোটিশটিতে। একই তারিখে একই ধরনের আরেকটি নোটিশে স্বাক্ষর করেছেন লাহোরের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ রৌফ নেওয়াজ। সেখানেও ছাত্রছাত্রীদের একই রকম ড্রেসকোড বেঁধে দেয়া হয়েছে। তবে এই নোটিশটি আরও এক ডিগ্রি সরেশ। বলা হয়েছে ছাত্রছাত্রীরা পরস্পরের একশ মিটারের মধ্যে আসতে পারবে না! এসবের অন্যথা হলে জরিমানা গুনতে হবে ১০ হজার রুপি, পাশাপাশি বাধ্যতামূলকভাবে চার মাসের জন্য যেতে হবে তবলিগ জামাতে।
Advertisement
রাওয়ালপিন্ডির ইসলামিক ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল লেফটেনেন্ট জেনারেল (অব.) আজহার রশীদ স্বাক্ষরিত নোটিশটির তারিখ ১১ ফেব্রুয়ারি। তবে বক্তব্যগুলো মোটামুটি কাছাকাছি। ছাত্রীদের জন্য কালো বোরকার পরিবর্তে হিজাব বাধ্যতামূলক করা হয়েছে এই ক্যাম্পাসে আর ছাত্রছাত্রীদের মধ্যকার পারস্পরিক দূরত্বটা একশ মিটার থেকে কমিয়ে নামিয়ে আনা হয়েছে দুই মিটারে। শাস্তি দেওয়ার বেলায় পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো অতটা কঠোর নন এই মেডিকেল কলেজটির কর্তৃপক্ষ। অর্থদণ্ডটা নামিয়ে আনা হয়েছে ১০ হাজার থেকে পাঁচ হাজার রুপিতে।
আমার এই লেখাটা পড়ে কারও যদি ধারণা জন্মায় যে এগুলো মনগড়া, তবে আমি তাকে খুব একটা দোষ দেব না। আজকের এই ডিজিটাল যুগেও যে ঘর থেকে মাত্র এক হাজার মাইলের মধ্যে অমন আইয়্যামে জাহেলিয়াতের শাসন চলছে তা বিশ্বাস না হওয়াটা তো যুক্তিসঙ্গত। আমারও প্রথমে বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয়নি। কিন্তু বাস্তবতাটা এই যে, এই প্রতিটি চিঠির কপি আমার হাতে আছে। কাজেই কষ্ট হলেও গিলতে হয়েছে বাস্তবতাটা।
এই লেখাটা যখন লিখছি তখনই হোয়াটসঅ্যাপে মাওলা ব্রাদার্সের স্বত্বাধিকারী মাহমুদ ভাইয়ের মেসেজ। এবারের বইমেলায়ও মাওলা ব্রাদার্স যথারীতি আমার আরেকটি বই প্রকাশ করতে যাচ্ছে। কোভিড-১৯ শিরোনামে আমার গত বছর খানেকের কোভিড বিষয়ক কলামগুলোর সংকলন এই বইটি।
মাহমুদ ভাইয়ের টেক্সটে বইয়ের প্রচ্ছদটি দেখেই প্রাণে লাগলো নাচন আর হৃদয়ে দিল দোলা। মেলায় পাতা উল্টিয়ে নিজের নতুন বইয়ের ঘ্রাণটুকু বুক ভরে নেওয়ার যে কি অদ্ভুত আনন্দ তা ভাষায় বোঝানো কঠিন। আর আমার মতো আরও হাজারো নাম না জানা থেকে শুরু করে নামি-দামি লেখক আর তাদের হাতেগোনা থেকে শুরু করে অগুনতি পাঠক এই অসম্ভব অনুভূতিটি আবারো উপভোগ করার সুযোগ পাবেন কারণ আজ থেকে সত্তর বছর আগে একুশ এসেছিল, যার পথ বেয়ে আজ থেকে ৫০টি বছর আগে আমাদের পূর্বসূরিরা আমাদের এমন অদ্ভুত সুন্দর একটি স্বাধীন স্বদেশ উপহার দিয়ে গিয়েছিলেন।
নয়তো আমাদের সূর্য-সুকন্যাদেরও হয়তো মাথায় টুপি চাপিয়ে বোরকাপরা সহপাঠীদের থেকে দুই থেকে একশ মিটার দূরত্ব বজায় রেখে ১৪ তারিখ বসন্তবরণ আর ভ্যালেন্টাইনস ডে-র যুগপৎ উদযাপন শিকায় তুলে, হায়-হায় করে ‘হায়া দিবস’ পালন করতে হতো। বাঙালি আর বাঙালিয়ানার যে মুন্সিয়ানা আর পাশাপাশি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থার যে অন্তঃসারশুশূন্যতা বোঝার জন্য এর চেয়ে ভালো উপলক্ষ বোধকরি আর কিছু হতে পারে না। ধন্যবাদ একুশ!
লেখক: ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম