ভাষাসৈনিক মোশাররফ হোসেন আখুঞ্জী। রাজশাহীর বাসিন্দা তিনি। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি ছিলেন ১৬ বছরের কিশোর। স্কুলছাত্র থাকা অবস্থায় ঝাঁপিয়ে পড়েন ভাষা সংগ্রামে। ভাষা আন্দোলনের সূত্র ধরেই যোগ দেন স্বাধীনতার যুদ্ধে। ৮৬ বছর বয়সে এসেও তাই স্মৃতি তার টগবগে। রাষ্ট্রের কাছে জীবন সাহাহ্নে এসে তার রয়েছে সামান্য কিছু দাবি-দাওয়া।
Advertisement
ভাষার মাসে জাগো নিউজের প্রতিবেদককে ভাষা আন্দোলনের গল্প শোনাতে গিয়ে টেনেছেন সেই উত্তাল সময়ের খেরোখাতা। কানে কম শুনলেও স্মৃতি এখনো তীক্ষ্ণ। শুরুতেই এই ভাষাসৈনিক বলেন, পাকিস্তান হওয়ার পর আমরা বলেছিলাম ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হে’। তারপর শুরু হয় উত্তাল সে সব দিনের গল্প।
ভারতবর্ষ ভাগ হওয়ার পর একটি সামন্তবাদী চক্র এদেশের শাসনভার হাতে নিয়ে সেই মধ্যযুগীয় শাসনব্যবস্থার মতো দেশ চালাচ্ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, সাধারণ মানুষের মধ্য থেকে কিছু বড়লোক গজিয়ে উঠছিল। আর নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছিল সাধারণ মানুষ। সেটার অবসান ঘটানোর জন্যই আমরা আন্দোলন করেছিলাম এবং দেশ স্বাধীন করেছিলাম।
মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।’ মূলত তিনি মুক্তির সংগ্রাম বলতে বুঝিয়েছিলেন অর্থনৈতিক মুক্তির কথা। তার নেতৃত্বে আমরা একটি স্বাধীন ভূখণ্ড পেয়েছি। একটি স্বাধীন মানচিত্র ও পতাকা পেয়েছি। কিন্তু এখনো অনেক মানুষের মাথার ওপর ছাদ নেই। আবার নতুন একটা বনেদি গোষ্ঠী গড়ে উঠছে। জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন একটা গোষ্ঠী। তারা স্বাধীন বাংলাদেশের সব সহায়-সম্পদ কুক্ষিগত করছে। এ অবস্থার অবসান ঘটুক। সত্যিকার অর্থে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যা চেয়েছিলেন তা বাস্তবায়ন হোক এটাই আমার কাম্য।
Advertisement
‘আমাদের রাষ্ট্র যন্ত্রটাই কিছুটা স্তিমিত হয়ে গেছে। সঠিক রাজনৈতিক চর্চাটাই হচ্ছে না। নানা ধরনের ধর্মীয় সংগঠন কিছু প্রকাশ্যে, কিছু গোপনে চলছে। রাজনৈতিক দল বলতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি- এই দুই জায়গায় আটকে আছে। দেশ যদি সঠিক গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক চর্চার মধ্যে ফিরে আসে তবে অবশ্যই এগুলো অপসারিত হবে।’
ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর পর অভিমানের স্বরে এ ভাষাসৈনিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা বললেন, অতীতকে মনে করি আর কষ্ট পাই। তাই প্রতি বছর একই কথার পুনরাবৃত্তি করতে চাই না। শুধু এতটুকু বলবো- ভালো যাচ্ছে না, যা চেয়েছিলাম, তা পাইনি।
ছাত্রাবস্থায়ই তিনি বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাই সমাজতান্ত্রিকতার বাণী উচ্চারণ করে অতীতের স্মৃতিচারণে বলেন, আমরা বলতাম- ‘কেউ খাবে তো কেউ খাবে না। তা হবে না, তা হবে না। কেউ থাকবে ১০ তলায় তো কেউ থাকবে গাছতলায়। তা হবে না, তা হবে না’।
বাংলা ভাষা রক্ষা ও উন্নয়নের বিষয়ে কিছুটা পরামর্শ দেন এই ভাষাসৈনিক। তিনি বলেন, সাইনবোর্ডগুলোতে ইংরেজির পাশাপাশি রাখতে হবে বাংলা। সাইনবোর্ডে বাংলা আগে প্রাধান্য দিতে হবে। আদালতে বাংলার যতটা সম্ভব প্রয়োগ করতে হবে। বাংলা ভাষার গবেষণায় রাষ্ট্রীয়ভাবে একটি কমিটি হওয়া উচিত। আমাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে অসাম্প্রদায়িক হতে হবে, যেটা আমরা হতে পারিনি। এতে নাগরিক হিসেবে বাঙালি হবেন, ধর্মীয় হিসেবে নয়। এতে বাঙালি জাতিসত্তার জাগরণ ঘটবে।
Advertisement
রাজশাহীতে ভাষা আন্দোলনের সূচনার বিষয়ে তিনি বলেন, ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা থেকে আগত আমাদের এক সহযোদ্ধা বড় ভাই জানান, ঢাকায় বাংলা ভাষা নিয়ে আন্দোলন শুরু হয়েছে। পাকিস্তানিরা বাঙালিদের ওপর অত্যাচার শুরু করেছে। এরপর আমরা রাজশাহী কলেজের নিউ হোস্টেলে রাত ১২টা পর্যন্ত আন্দোলনের আলাপ-আলোচনা করি। প্রায় তিন থেকে চারশ শিক্ষার্থী আমরা সে সময় জমায়েত হয়েছিলাম।
‘শহীদদের স্মরণে ওই রাতেই আমরা রাজশাহী কলেজের হোস্টেলের ডানদিকে ভাষা শহীদদের স্মরণে কাদামাটি দিয়ে একটি স্মৃতিস্তম্ভ বানাই এবং সেখানে লিখি- ‘ওরে ভয় নাই, ওরে ভয় নাই/নিঃশেষে প্রাণ, যে করিবে দান/ক্ষয় নাই, তার ক্ষয় নাই।’ ওই স্মৃতিস্তম্ভটি পরদিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আশ্রিত কিছু গুন্ডা ও পুলিশ তা গুঁড়িয়ে দেয়।
ভাষাসৈনিক আখুঞ্জীর দাবি, রাজশাহীতেই প্রথম ভাষাশহীদের স্মরণে শহীদ মিনার তৈরি করা হয়েছিল। অথচ রাজশাহীতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নেই। মনি চত্বরে রাজশাহী পলিটেকনিকের ওখানে একটি শহীদ মিনার তৈরির কথা থাকলেও তার বাস্তবায়ন আজও হয়নি। আমাদের দাবি সেটি দ্রুত স্থাপিত হোক।
তিনি বলেন, ওই সময় রাজশাহীতে ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গঠিত হয়েছিল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। ওই পরিষদের সভাপতি ছিলেন রাজশাহী মেডিকেল স্কুলের ছাত্র এস এম গফফার ও যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন রাজশাহী কলেজের জ্যেষ্ঠ শিক্ষার্থী চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোলাম আরিফ টিপু (বর্তমানে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর) ও নাটোরের হাবিবুর রহমান। এছাড়া ভাষা আন্দোলনে আরও যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার নাজমুল, মহসিন প্রামাণিক, নাট্যকার মমতাজ উদ্দিন আহমেদ, অ্যাডভোকেট আব্দুর রাজ্জাক, আতাউর রহমান, মনোয়ারা বেগম, আবুল হোসেন, সাইদ উদ্দিন আহমেদ প্রমুখ।
রাজশাহীতে অনেকেই ভাষা আন্দোলনের সময় ছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, তাদের সবাই মারা গেছেন। আমি ও গোলাম আরিফ টিপু ভাই বেঁচে আছি। তিনি বর্তমানে ঢাকায়। আমাদের মধ্যে অনেক ভাষাসৈনিকের পরিবার খুব কষ্টে দিন পার করছে। তাদের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে সরকারকে পাশে দাঁড়ানো উচিত বলে আমি মনে করি।
তরুণদের জন্য বাংলাভাষার মর্মার্থ পৌঁছানোর বার্তা হিসেবে তিনি বলেন, এক সময় স্থানীয়ভাবে মঞ্চনাটক, যাত্রা, সঙ্গীতানুষ্ঠান, চিত্র ও গল্প প্রতিযোগিতার আয়োজন হতো, হতো বইমেলা। কিন্তু এসব এখন আর চোখে পড়ে না। এখন সবাই রেডিও-টিভি নিয়ে ব্যস্ত। তাদের জন্য আমি বলবো- বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি জানতে হলে বাংলা বই পড়তে হবে, সাহিত্য ও সংস্কৃতি জানতে হবে এবং স্থানীয় পর্যায়ে বেশি বেশি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হবে।
রাজশাহীর ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠকও ছিলেন মোশাররফ হোসেন আখুঞ্জী। তিনি নগরীর লোকনাথ স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও রাজশাহী কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। পরে নীলফামারী ডিগ্রি কলেজে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করেন। শিক্ষিত হয়েও চাকরি না করে করেছেন ব্যবসা। নগরীর সাহেব বাজারে ‘এক নম্বর গদি ঘর’ নামে মুদি দোকানটি তার, যা রাজশাহী শহরে বেশ পরিচিত।
৫২’র এই ভাষাসৈনিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা এখন তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্বভার সঁপেছেন ছেলের ওপর। এখনো মাঝে মধ্যে যান নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে। সেখানে মেতে ওঠেন গল্পে। তবে এখন চোখে দেখেন কম। কানেও কম শোনেন। শারীরিক দিক থেকেও কিছুটা দুর্বল। তাই জীবন সাহাহ্নে রাজশাহীতে দেখে যেতে চান কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। দেখে যেতে চান বাংলা ভাষার প্রকৃত সম্মান।
এমআরআর/এএ/জেআইএম