মতামত

ভাষাচর্চার বিকাশের দিকচিহ্ন

একুশ শতকের তৃতীয়ার্ধে এসেও যে বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়, তা হচ্ছে বাংলাভাষার বিচিত্র ও ঐশ্বর্যময় বিভিন্ন দিগন্ত এখনও আমাদের ভাষাচর্চাকারীদের দৃষ্টিতে দূরবর্তী রয়ে গেছে। সত্য যে, ভাষার জন্য রক্তদানকারী জাতি ভাষাতত্ত্ব এবং ভাষাবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য মৌলিক চিন্তা-ভাবনার প্রতিফলন ঘটাতে পারেনি।

Advertisement

ভাষাবিজ্ঞান উল্লেখযোগ্য চর্চা চার দশক ধরে হলেও প্রাগ্রসর পরিস্থিতি দৃশ্যমান হয়নি। যদিও বাস্তবতা হচ্ছে, জটিল বিষয়ের প্রকাশে বাংলাভাষা ধীরে ধীরে স্বাচ্ছন্দ্য অর্জন করেছে। বাংলাভাষার সামনে যে পাহাড় প্রমাণ প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, তা দূর যে করা খুব কঠিন তা এই প্রযুক্তির উৎকর্ষতার যুগে মনে করার কোনো কারণ নেই। যদিও ভাষা শুধু তার লিপি ও বাক্বিন্যাস এবং তার ব্যবহারে অস্তিত্ববান হয়ে থাকতে পারে না। তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে সংস্কৃতি তথা শিল্পকলা, পোশাক পরিচ্ছদ, খাবার দাবার ইত্যাদি।

বাংলাভাষা চড়াই-উতরাই পাড়ি দিচ্ছে প্রতি মুহূর্তেই। এই ভাষার বর্ণমালায় আছে জটিলতা, নেই কোনো প্রামাণ্য ব্যাকরণ। সাধারণ মান্য এবং মান্য শিক্ষার্থী অভিধান নেই। বানানে চলে অরাজকতা। প্রযুক্তির কারণে রোমান হরফে বাংলা লেখা চলছে। তদুপরি নেই বাংলাভাষার কোনো আর্থিক মূল্য। একুশ শতকের বাঙালি প্রজন্ম ইংরেজি ভাষার প্রতি যতোটা আগ্রহী, বাংলার প্রতি ততো অনাগ্রহী। তারপরও বাংলাভাষার দুর্দিন আসছে এমনটা মনে হয় না। তথ্যপ্রযুক্তি তথা কম্পিউটারে বাংলাভাষার ব্যবহারকে সম্প্রসারিত করা গেলে ভাষাচর্চার বিকাশ ঘটবে বৈকি।

বাংলাভাষাকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে বিশ্লেষণ, গবেষণা ও ব্যবহারে প্রযুক্তিগত সহায়তা ক্রমশ কার্যকর হচ্ছে। ভাষাতাত্ত্বিক বিষয়গুলো বিশ্লেষণ, বানান সমস্যা, বাক্যগঠন প্রক্রিয়া, যথাযথ শব্দপ্রয়োগ-ইত্যকার বিষয়ে কম্পিউটার প্রযুক্তি সহায়ক হয়ে ওঠছে। অবশ্য কোনো ভাষাকে বিজ্ঞানসম্মত বিচার-বিশ্লেষণ ও প্রাত্যহিক কাজকর্মে ব্যবহার করতে গেলে প্রথমেই দরকার সেই ভাষার বহুমাত্রিক ব্যবহারের বিস্তৃত বিশ্বাসযোগ্য নমুনা।

Advertisement

প্রযুক্তির সহায়তায় নিত্য-ব্যবহৃত লিখিত বাংলাভাষার বিস্তৃত নমুনা ও প্রমাণ জীবনের নানাক্ষেত্র থেকে সংগ্রহ বা তুলে এনে কম্পিউটারে জড়ো করা সম্ভব। এতে আধুনিক বাংলাভাষার গবেষণা, বিশ্লেষণ কিংবা প্রয়োগের জন্য আর পরোক্ষ প্রমাণ কিংবা পড়ে-পাওয়া তথ্যের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার প্রয়োজন হবে না।

বাংলাভাষার স্বরূপ, চরিত্র ও ব্যবহার বোঝার জন্য ভাষা নমুনা বা ভাষাংশ বিভিন্ন গাণিতিক নিয়ম ও পদ্ধতি অনুসারে বিশ্লেষণ করা সম্ভব এবং প্রাপ্ত তথ্য, প্রমাণ ও উদাহরণ ব্যবহার করে প্রায়োগিক ভাষাবিজ্ঞান ও ভাষাপ্রযুক্তির বিভিন্ন কাজ করা যায়। যাতে সমৃদ্ধ হতে পারে সাধারণ ভাষাজ্ঞান। উন্মুক্ত হতে পারে বাংলাভাষা গবেষণার নতুন দিগন্ত এবং উপকৃত হবে সমগ্র ভাষাগোষ্ঠী। ভাষাচর্চার প্রচলিত ঘেরাটোপ থেকে বাংলাভাষাকে বের করে এনে এর শরীরে নয়া প্রাণ সঞ্চার সম্ভব। কারণ বাংলাভাষা দুর্বল কোনো ভাষা নয়। এর শক্তিমত্ততা যথেষ্ট।

দু’শ বছর আগে বাংলাভাষার ব্যাকরণ রচয়িতা ও বহুভাষাবিদ উইলিয়াম কেরি অভিমত জানিয়েছিলেন বাংলাভাষা সম্পর্কে, ‘এই ভাষা প্রায় গ্রেট ব্রিটেনের তুল্য এক বৃহৎ ভূ-ভাগে প্রচলিত এবং যথোচিত অনুশীলন হইলে স্বতঃসিদ্ধ সৌন্দর্য ও সুস্পষ্টরূপে ভাব ব্যঞ্জনায় ইহা জগতের কোন ভাষা অপেক্ষা নিকৃষ্ট হইবে না।’ জার্মান ভাষাবিদ এফ এইচ ইসক্রাইন বিশশতকের মাঝামাঝি বলেছিলেন, ‘বাংলাভাষা ইহার মধুরাক্ষরা শব্দ সমৃদ্ধিতে ইতালিয়ান ভাষার সমকক্ষ তৎসহ জটিল বিষয়সমূহ প্রকাশ করার পক্ষে জার্মান ভাষার ন্যায় শক্তি বহন করে।’

জেডি এন্ডারসন আই সি এস, ছিলেন যিনি ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাভাষার সাবেক অধ্যাপক, মূল্যায়ন করেছেন এভাবে, ‘আমার ধ্রুব বিশ্বাস যে, মনের ভাবের পূর্ণ অভিব্যক্তি করিবার উপযোগী এবং অমর কথার বাহনস্বরূপ যে সকল শ্রেষ্ঠভাষা জগতে বিদ্যমান বাংলাভাষা তাহার অন্যতম।’

Advertisement

বাংলাভাষা একটি জীবন্ত ভাষা। কোনো স্বাভাবিক ভাষা বেঁচে থাকার প্রথম ও প্রধান হলো তার শব্দভান্ডারের ক্রমিক বিস্তার। চলমান জীবনের নানাক্ষেত্র থেকে যদি নতুন শব্দ ভাষার শব্দভান্ডারে ক্রমাগত জড়ো হতে থাকে, তবে সে ভাষা জীবন্ত, যা প্রাণস্পন্দনে স্পন্দিত। এই শব্দ আসে নানা পথে, নানা ভাবে, নানা কারণে, নানা উদ্দেশ্যে।

ভাষা ব্যবহারকারীরা তাদের জীবনযাপনের নতুন নতুন প্রয়োজন মেটাতে তৈরি করে কিংবা ধার করে নতুন শব্দ। কখনো বা পুরোনো শব্দগুলোকে নতুন অর্থে ও নতুন আঙ্গিকে ব্যবহার করে। এসবই হচ্ছে ভাষার বেঁচে থাকা ও অগ্রগতি এবং বিস্তার ও উন্নতির লক্ষণ। বাংলাভাষারও সে অর্থে শব্দভান্ডার ক্রমশ স্ফীত হচ্ছে। নতুন নতুন শব্দ আসছে ভাষায়।

ভাষার উৎপত্তি ও বিকাশ নিয়ে নানা গবেষণা রয়েছে। অবশ্য ভাষাচর্চার ইতিহাস কয়েক বছরের পুরোনো। সেই গ্রিক, রোমান দার্শনিক-ভাষাবিদরা ভাষা নিয়ে নানাভাবনার কথা বলেছেন। প্রাচীন ভারতে পাণিনিসহ অন্য পন্ডিতরাও ভাষা নিয়ে চর্চা করেছেন। নানা মিশ্রণ ঘটেছে ভাষায় নানাভাবে, নানা কারণে। তবে উনিশ শতকেই প্রথম সত্যিকারের বিজ্ঞানসম্মত ভাষাচর্চার সূত্রপাত হয়েছে। আর ভাষাবিজ্ঞান বিদ্যার প্রথম উদ্ভব এই উনিশ শতকেই।

আবার এই শতাব্দীতেই ঘটেছে তুলনামূলক ও ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্বের উদ্ভব, বিকাশ এবং চর্চা। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর ভাষাগুলো সম্পর্কে অনুসন্ধান এই শতাব্দীর ভাষাচিন্তার প্রধান বৈশিষ্ট্য। অন্য ভাষাবংশ সম্পর্কে অনুসন্ধান ও ক্রমান্বয়ে এ সময় হতে থাকে। ভাষাচর্চায় নতুন দিকও উদ্ঘাটিত হতে থাকে। এসময়ের ভাষাবিদ রাস্ক, গ্রিহ, ফ্রানৎসবপ এবং ফান হুমবোল্ট উদ্ভাবন করেন ভাষার বিভাগ বা স্তর।

বিশ্বের ভাষাগুলোকে বিশ্লেষাত্মক, সংশ্লেষাত্মক ও সবিভক্তিক এই তিন ভাগে ভাগ করা হয়। হুমবোল্টের ভাষা চিন্তার একটা বড় দিক এই যে, তিনি মানুষের অন্তর্নিহিত ভাষা দক্ষতার বিষয়টির ওপর জোর দিয়েছিলেন। এই একটি জায়গায় নোয়াম আব্রাহাম চমস্কি গভীর ভাবে ঋণী হুমবোল্টের কাছে। একই সময়ে কার্ল ব্রুগমানের মতো নব্যব্যাকরণপন্থি ভাষাতাত্ত্বিকরা ধ্বনি পরিবর্তনের বিষয়টির দিকেও বিশেষ দৃষ্টি দিতে শুরু করেন এই সময়ে। ভাষাবিজ্ঞানের বেশ অগ্রগতি হয় বিশ শতকের গোড়ার দিকে। ফরাসিভাষী সুইস ভাষাবিজ্ঞানী ফার্দিনান্ত দ্য সসু্যঁরের ল্যাঙ্গু ও পারল বিষয়ক আলোচনায় সূত্রপাত ঘটে সংগঠনবাদী ভাষাবিজ্ঞানের। এই সময়ই প্রতিষ্ঠিত হয় এককালিক ভাষাতত্ত্বের প্রাধান্য। পাশাপাশি দৃশ্যমান হয় বর্ণনাত্মক ভাষাবিজ্ঞানের। তাত্ত্বিক বিশ্লেষণও অনুসন্ধানে ভাষাবিজ্ঞানের নতুন নতুন দিক উন্মোচন করেন এই সময়ের খ্যাতনামা ভাষাবিজ্ঞানী সাপির, লেনার্ড ব্রুমফিল্ড, ফার্থ প্রমুখ। এদের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ও অনুসন্ধানে ভাষাবিজ্ঞানের নতুন নতুন দিক উন্মোচিত হয়। এই সময়ে ভাষাচর্চার অন্যতম প্রধান পীঠস্থান হয়ে ওঠে প্রাগস্কুল।

তবে যে বিষয় বা ঘটনাটি বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ভাষাবিজ্ঞানের চর্চাকে ভিন্ন পথে চালিত করে এবং বলতে গেলে একটা বিপ্লব ঘটিয়ে দেয় ভাষাবিজ্ঞানে। তাহলো নোয়াম চমস্কির ‘সংবর্তনী সঞ্জননী ব্যাকরণ’ বা ‘ট্রান্সফরমেশনাল জেনারেটিভ গ্রামার’। ১৯৫৭ সালে ‘ সিনট্যাকটিক স্ট্রাকচারস’এর প্রকাশে এই নতুন তত্ত্বটির সূচনা হয়। পরে ১৯৬৫ তে ‘আসপেক্টস অব দ্য থিয়োরি অব সিনটেক্স’-এ চমস্কি তার তত্ত্বে কিছু পরিবর্তন , পরিমার্জনা ও সংযোজন করেন। চমস্কির তত্ত্বে ভাষার অধোগঠনও অধিগঠন, পদসজ্জাবিধি এবং রূপান্তর ও সঞ্জনন সবিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। চমস্কি বলেন, মানুষ মাত্রেই একটা ভাষাবোধ বা ভাষাসামার্থ্য নিয়ে জন্মায়, যাকে তিনি দক্ষতা বা কমপিটেনস বলেছেন। সেই দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে ভাষাকে নতুন নতুন উপায়ে ব্যবহার করা হয়, যা তার তত্ত্বে ‘পারফরমেন্স’ নামে পরিচিত।

চমস্কি দু’ধরনের ভাষার কথা বলেছেন; একটা ‘ভেতরের ভাষা’ আর একটা মানুষের ‘বাইরের ভাষা’। প্রত্যেক মানুষই সসীম শব্দ দিয়ে অসীম বাক্য বানাতে পারে। এই অসীম বাক্য বানানোর ক্ষমতা মানুষের ‘সহজাত’। সহজাত এই সৃজন ক্ষমতার ছক বা গণনাভিত্তিক কার্যক্রম থাকে মানুষের মস্তিষ্কে। মানুষের মস্তিষ্কে অসীম বাক্য তৈরী করার জৈব যন্ত্রকে চমস্কি বলেছেন, ‘ ল্যাঙ্গুয়েজ একুইজিশন ডিভাইস’।

এটা মানুষের জৈবিক ব্যাপার। জীববিজ্ঞানে ভাষার জৈবিক অ্যালগরিদ্ম্ থাকে বলেই একজন মানবশিশু একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর, এমন সব বাক্য বানাতে পারে, যা সে আগে কখনো বলেনি এবং এমন জটিলবাক্য সব বুঝতে পারে- যা সে আগে কখনো শোনেনি। ভেতরের ভাষা অভেদে রয়। অসমান বাইরের ভাষায়। বাইরের এই ভাষার দিক হলো, জগতে ভাষার বিপুল বৈচিত্র্য। এই ভাষা অবাধ। আর জ্ঞান হচ্ছে মানুষের সহজাত। বিশ্বজনীন ব্যাকরণে সীমিত সংখ্যক প্রাথমিক ভাষিক উপাত্ত দিয়ে বিষয়ী যে অসীম কথা বলে ও বোঝে তাও তার সহজাত ক্ষমতা। ভাষার সবচেয়ে বড় গুণ; তা হলো সৃজনধর্মিতা। সৃজনশীলতাকে যুক্ত করলে মানবভাষা পৃথিবীর প্রাণীজগতের মধ্যে একমাত্র বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, যা অন্য প্রাণীর থেকে মানুষকে আলাদা করে দেয়।

ভাষা নিয়ে চমস্কি যে ভাবে ভেবেছেন তার পরিধি নেহায়েৎ ছোট নয়। ভাষিক জ্ঞান বিষয়ী কিভাবে আয়ত্ত করে বা সেই জ্ঞানের সঙ্গে বিষয়ীর সম্বন্ধ কি তাই চমস্কীয় ভাষাবিজ্ঞানের প্রাথমিক আধিতব্য। ভাষাজ্ঞান সে ভাষার নিয়মাবলির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। চমস্কি ভাষা গবেষণার জগতের জন্য কতগুলো ধারণা তুলে ধরেছেন। তার মতে, আমাদের ভাষাজ্ঞানের একটি বৃহদংশ জিনগতভাবে নির্দেশিত, ‘আইডিয়াল’ বা আদর্শ বক্তার বিষয়টি শ্রোতার ধারণা।

মানবমস্তিষ্কে ভাষার জন্য পৃথক ‘মডিউল’র অস্তিত্ব রয়েছে। ভাষা একধরনের ‘মেন্টাল অরগান’ যা স্বয়ংক্রিয় এবং মস্তিষ্কের অন্যান্য অংশের থেকে পৃথক এবং ভাষাসহজাত। বাক্যতত্ত্ব বিষয়ে চমস্কির তত্ত্ব ও তথ্য বেশ গুরুত্ববহ। বলেছেন তিনি, ‘ভাষার শব্দভান্ডার থেকে চয়িত শব্দগুলো সুসংবদ্ধ গাণিতিক নিয়মানুযায়ী সজ্জিত। শব্দ জোটগুলোর গঠন সে কারণেই গাণিতিক ভাবে নির্ণীত।”

ভাষায় ভাষায় নানান বৈচিত্র্য। আবার সেই সব ভাষাগুলোরও নানান ঐতিহাসিক স্তর। তার মধ্যেই অযুত বৈচিত্র্য। আর এর কারণ ভাষাগুলোর বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের জন্য। ‘ডেরিভেশনের’ ভেতরে পার্থক্যের কারণে নয়। চমস্কির বিশ্বজনীন ব্যাকরণের সূত্রগুলো মানুষের ভাষা শেখার কাজে লাগে। বলা যায় এগুলোই বিশ্বজনীন ব্যাকরণের প্রাথমিক সূত্র। যখনই সম্ভব হয় তখনই ওই সূত্রগুলো আমাদের বাক্য উৎপাদন কার্যক্রমে প্রযুক্ত হয়। মানবশিশু কীভাবে ভাষার প্রাথমিক নিয়মকানুনগুলো নিয়ে জন্মায় তা উপলব্ধির একমাত্র উপায় বিশ্বজনীন ব্যাকরণের নির্বিশেষ সূত্র জানা। পরিণত মানুষের বাক্যের নির্গত রূপগুলোও এই সূত্রগুলো দিয়ে বোঝা যায়। বোঝা যায় কীভাবে ‘ডেরিভেশন’ হয়। শব্দভান্ডার থেকে উপাদানগুলোকে বাক্যের নানান বৈচিত্র্য ও বৈশিষ্ট্য খতিয়ে দেখার কাজে লাগানো যায়।

ভাষার নতুন সংজ্ঞা আরোপ করেছিলেন নোয়াম আব্রাহাম চমস্কি। বলেছেন, ভাষা হচ্ছে ‘ মনের দর্পণ বা আয়না’। উল্লেখ করেছেন তিনি, পৃথিবীতে একটিই মাত্র ভাষা এবং ভাষাতত্ত্ব দর্শন- মনস্তত্বের আলোচনা ক্ষেত্রের অঙ্গ। মানববিজ্ঞানের একটি বিশেষ শাখায় চমস্কি একটি নতুন আদিকল্পের জন্ম দিয়েছিলেন পঞ্চাশের দশকে। এর পরবর্তীকালে ভাষাতত্ত্বে তার প্রস্তাবিত মডেলটিকে তার লেখা বিভিন্ন গ্রন্থে বহুবার পরিমার্জনা করেছেন নিজেই। চমস্কির ভাষাজিজ্ঞাসা অনেকটাই টেকনিক্যাল ভাষায় আলোচিত।

মূলত প্রকৃতিবিজ্ঞান; জীববিজ্ঞান এবং শারীরবৃত্তিয় উপাদানের ক্রিয়াকলাপের ওপর নির্ধারিত অথবা ভাষার অন্তর্নিহিত গঠনবিচারে আবদ্ধ। চমস্কির মতে, মানুষের ভাষিক এবং অন্যান্য আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে এক জটিল শারীরবৃত্তিয় মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়া। তাকে নেহাতই বাইরে থেকে প্রযুক্ত কোনো নির্দিষ্ট উদ্দীপকের শর্তাধীন ক্রিয়া হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায় না। প্রথাগত ভাষাতত্ত্বের গঠনবাদী মাঠনির্ভর বিশ্লেষণের বিশ্বে ভাষাতাত্ত্বিকের কাজ ছিল কেবল তথ্য সংগ্রহ। চমস্কি তার ভিত্তিকেই চ্যালেঞ্জ জানান। তার প্রথম গ্রন্থ ‘লজিক্যাল স্ট্রাকচার অব লিঙ্গুইস্টিক থিওরী’ তে তিনি উল্লেখ করেন যে, বর্ণনামূলক ভাষা তত্ত্বের পরিবর্তে সৃজনশীল ব্যবহারই ভাষাতত্ত্বের কেন্দ্রবিন্দু। জন্ম হলো ‘জেনারেটিভ গ্রামার’ বা ‘সঞ্জননী ব্যাকরণ বা রূপান্তরমূলক উপোদনী তত্ত্ব’।

এতে একদিকে গড়ে তোলা হয়েছে মানবমন অনুসন্ধানে ভাষাভিত্তিক গবেষণার নতুন পথ। আর এরই পরিপ্রেক্ষিতে দেখা দিল অভিজ্ঞতাবাদী ধারায় মনস্তত্ত্বের সংকট। তিনি গাণিতিক বিশ্লেষণের সাহায্যে তত্ত্ব নির্মাণকে গুরুত্ব দিলেন ভাষা তত্ত্বের গবেষণায়। আর বাক্যতত্ত্ব গুরুত্ব পেল ভাষা তত্ত্বের গবেষণাক্ষেত্রে।

চমস্কি মূলতঃমানুষের মস্তিষ্কের ভাষিক স্থান, যাকে ‘ল্যাঙ্গুয়েজ একুইজিশন ডিভাইস’ বলে বর্ণনা করেছেন এবং তার ভাষিক চেতনা বা প্রবৃত্তি, যাকে তিনি ‘সহজাত’ বলে বর্ণনা করেছেন। ভাষার আহরণ, ভাষার শিক্ষণ এবং তার প্রয়োগের ক্ষেত্রে চমস্কি মানুষের মস্তিষ্কসঞ্জাত ক্রিয়ার সঙ্গে তার ভাষিক ও অন্যান্য অভিজ্ঞতার মেলবন্ধ ঘটিয়ে ভাষা নামের ‘ইউনিক’ প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের চরিত্র বিশ্লেষণ করেছেন।

সন্দেহ নেই যে, চমস্কির ভাষাতত্ত্ব ভাষাচর্চায় নবযুগ সূচিত করেছে। তবে তার মানে এই নয় যে, আগেকার সব তত্ত্ব, সব আলোচনা বাতিল হয়ে গেছে। বরং দেখা যায় চমস্কির তত্ত্বের ব্যাপক প্রভাব সত্ত্বেও একদিকে তুলনামূলক ও ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্ব এবং অন্যদিকে বর্ণনাপন্থি ভাষাবিজ্ঞানের চর্চা অব্যাহত থাকে। অবশ্য সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছে চমস্কিকেও।

ভাষাতাত্ত্বিকরা বলেছেনও, মানবভাষা সংক্রান্ত চমস্কির তত্ত্ব দ্রুত বিলীয়মান হবে। তবে বাস্তবে তা হয়নি। চমস্কি প্রস্তাব রেখেছিলেন, মানুষের মাথার ভেতরে এই যে ভাষার বিমূর্ত আকার তা নিশ্চয়ই বিমূর্ত ও সংক্ষিপ্ত সূত্রের সাহায্যে বলা যাবে। এই বিমূর্ত ভাষিক আকারের প্রাধান্য ব্যাখ্যা খুঁজতে গিয়ে লিখলেন ‘মিনিমালিস্ট প্রোগ্রাম’।

শরীর ভাষাবিজ্ঞান (বায়োলিঙ্গুইস্টিকস) প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের বাইরে যাবে না’ চিহ্নের অসীম সম্ভাবনা তৈরী করা এই শরীর ভাষাবিজ্ঞানের কাজ। শরীরভাষাবিজ্ঞানকে ভাষাবিজ্ঞানের পুরনো ছাঁদে আটকে না রেখে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের এমন এক ঘরে পা রাখে, যেখান থেকে ভাষিক বৃত্তের মৌলিক নীতিগুলো বুঝে নিতে সুবিধে হয় । চমস্কি বলেছেন, “বুদ্ধিবাদীরা ভাষাকে সেই ভাবেই দেখেন, যে ভাবে শরীরবিদরা দেখেন শরীরের কোন তন্ত্রকে।” ভাষাদর্শনে স্বাভাবিক ভাষা বা সাধারণ ভাষা বলতে বোঝায় এমন একটি ভাষা - যা ‘ফর্মাল ’ ভাষার চেয়ে আলাদা। সাধারণভাষা নৈমিত্তিক প্রয়োজনে ব্যবহৃত যে ভাষা বলা হয় , লেখা হয়, চিহ্নায়িত হয়, তাই ‘ স্বাভাবিক ভাষা’।

চমস্কির সঞ্জননী ধ্বনি তত্ত্বের মূল লক্ষ্য হলো, একটি ভাষা ব্যবহার করতে গিয়ে তার ধ্বনি কখন কোন্ প্রতিবেশে কীভাবে বদলে যায় তা লক্ষ্য করা। প্রথাগত ধ্বনিত তত্ত্বের লক্ষ্যে এটা ছিল, কিন্তু প্রধান ছিল না। সঞ্জননী ধ্বনিতত্ত্ব ভাষার উচ্চারণের পরিবর্তনগুলো দেখে। এই তত্ত্বে কোন ধ্বনির কোন প্রতিবেশে কী উচ্চারণ হবে সেটাই প্রধানভাবে দেখানো হয়। ধ্বনিগুলোর বদল, এমনকি শব্দেও বাক্যে বল (স্ট্রেস) বা তান (পিচ) ইত্যাদি অধিধ্বনির বদল। একক ধ্বনিকে সাধারণভাবে ‘সেগমেন্ট’ বা ধ্বনি বলা হয়। বল বা তানকে সাধারণত বলা হয় অধিধ্বনি বা ‘সুপারাসেগমেন্ট’ কথা বলার সময় দু’য়েরই নিয়মবদ্ধ পরিবর্তন হয়।

অবশ্য কোন পরিবর্তনই অকারণে হয় না। সাদৃশ্যের কারণে, কখনো বা ভিন্ন ভাষা থেকে শব্দ ঋণের ভিন্নতার কথা বাদ দিলে, এগুলোতে নিয়মের চেয়ে নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটে বেশি। তাই ভাষায় নিত্যনৈমত্তিক ব্যবহারে যে নিয়ম গড়ে ওঠে সেগুলোর দিকেই সঞ্জননী ধ্বনিতত্ত্ব প্রথমে দৃষ্টি দেয়। ভাষাবিজ্ঞানে যাকে রূপধ্বনিতত্ত্ব বলে তার সঙ্গে সঞ্জননী ধ্বনি তত্ত্বের এলাকাগত সাযুজ্য আছে। যদিও রূপধ্বনি তত্ত্বের তত্ত্ব ভূমিকা এতা শক্তিশালী নয়। কোনো ভাষার সঞ্জননী ধ্বনিতত্ত্বে ভাষার ব্যবহারিক বা চালু উচ্চারণের নিয়মগুলো তালিকাবদ্ধ করতে হয়। নিয়মতালিকাই সঞ্জননী ধ্বনিতত্ত্বের প্রধান ও কেন্দ্রীয় অংশ। কিন্তু তা একমাত্র অংশ নয়। এই তত্ত্বে সাধারণভাবে ধরে নেওয়া হয়, একটা পরিবর্তন একটা ধাপে ঘটে। অবশ্যই একই প্রতিবেশে থাকলেই একই ধ্বনি নানা জায়গায় একসঙ্গে পরিবর্তিত হতে পারে। কিন্তু সেও আসলে একটি পরিবর্তন। পরিবর্তন ঘটছে ধ্বনিতে। তার ফলে ওই ধ্বনিবাহী শব্দটির চেহারাও পরিবর্তিত হচ্ছে। তবে কোন চেহারা থেকে পরিবর্তনটা শুরু, সেটাই হচ্ছে পরিবর্তনের মূল রূপ বা ভিত্তি।

লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও মহাপরিচালক প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)।

এইচআর/ফারুক/জেআইএম