বিশেষ প্রতিবেদন

আঙ্কারার পাহাড়চূড়ায় বঙ্গবন্ধু পার্কে উড়ছে লাল-সবুজের পতাকা

সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় তিন হাজার ৭৭ ফুট উঁচু আবাসিক এলাকাটির নাম কেসিওরান। চারপাশ ঘেরা পাহাড়ে। মাঝে দৃষ্টিনন্দন পার্ক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল পার্ক। পার্কের প্রবেশপথে উড়ছে লাল-সবুজের পতাকা। পাশেই শ্বেতপাথরে খচিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি। সঙ্গে ইংরেজি আর তার্কিশ ভাষায় তার সংগ্রামী জীবনী।

Advertisement

তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় পার্কটির অবস্থান। দেশ থেকে হাজার মাইল দূরেও বঙ্গবন্ধুর নাম আর দেশের পতাকা শোভা পাচ্ছে স্বমহিমায়। দুই দেশের চুক্তির আওতায় পার্কটি স্থাপন করেছে আঙ্কারা সিটি করপোরেশন। পার্কটিতে দলবেঁধে ফুটবল, টেনিস, ভলিবল, বাস্কেটবল খেলছে কেসিওরানসহ এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে তুরস্কে বেড়াতে আসা শিশু-কিশোররা।

হাজার মাইল দূরের শিশু-কিশোরদের কাছে এখন প্রিয় হয়ে উঠেছে বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ, যা এখন আঙ্কারার সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে গত ১৩ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল পার্কের উদ্বোধন করা হয়। এখন পার্কটি রক্ষণাবেক্ষণ করছে আঙ্কারা সিটি করপোরেশন। ১০ বিঘা আয়তনের পার্কে ফুটবল, টেনিস, ভলিবল, বাস্কেটবল খেলার রয়েছে। আছে শিশুদের খেলাধুলার আরও নানান অনুষঙ্গ। এমন নান্দনিক মাঠে খেলার পাশাপাশি বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানতে পারছে তুরস্কের তরুণ প্রজন্ম।

Advertisement

শ্বেতপাথরে খোদাই করা বঙ্গবন্ধুর ছবি ও সংক্ষিপ্ত জীবনী

আঙ্কারায় বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্র জানায়, তুরস্কে অসংখ্য পার্ক-মাঠ রয়েছে। এর মধ্যে কেসিরাওয়ানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল পার্কটি আয়তনে সবচেয়ে বড়। চারপাশে পাহাড়ঘেরা পার্কটির সৌন্দর্য মনোমুগ্ধকর। পার্কটি তুরস্কের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, শিক্ষা, সংস্কৃতি, খেলাধুলা, কারিগরি, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ে পারস্পরিক সহযোগিতার মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে। এছাড়া ডিএনসিসি এবং আঙ্কারা সিটি করপোরেশন সিস্টার কনসার্ন হিসেবে কাজ করার সুযোগ তৈরি হয়েছে।

১৮ ফেব্রুয়ারি সরেজমিনে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল পার্কটি মূলত চার ভাগে ভাগ করা। এর মধ্যে পার্কের মাঝে চারপাশে লোহার তারের বেষ্টনী দিয়ে বড় একটি ফুটবল মাঠ। বল যাতে মাঠের বাইরে না যায়, সেজন্য ওপরেও জাল দিয়ে ঘেরা। বৃষ্টির মধ্যে মাঠে খেলাধুলা করার জন্য বসানো হয়েছে কৃত্রিম ঘাস।

পার্ক সংলগ্ন একটি ১৪ তলা বাড়িতে থাকে কলেজছাত্র মাহবুব সাহম। বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল পার্কে খেলাধুলার বিষয়ে জানতে চাইলে সে বলে, আগে পাহাড়ি এলাকা সমতলভূমি ছিল না। দু-একটি জায়গা ফাঁকা থাকলেও সেখানে ইট-পাথরের কনায় ভরা ছিল। এখন বঙ্গবন্ধু পার্ক মাঠে ফুটবল খেলতে পেরে আমরা খুবই আনন্দিত।

Advertisement

ফুটবল খেলার মাঠের দক্ষিণ পাশে ভলিবলের মাঠ। সেখানেও দলবেঁধে শিশু-কিশোরদের খেলাধুলা করতে দেখা গেছে। এছাড়া এই পার্কের উত্তর পাশে রয়েছে শিশুদের খেলাধুলার নানা রাইড। রাতে খেলার জন্য পার্কে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। পার্কটি সবুজায়ন করতে নতুন করে গাছ লাগানো হয়েছে।

পার্কের দক্ষিণ এবং পশ্চিম পাশে বড়দের বসার অনেকগুলো ঘর রয়েছে। সেখানে স্থানীয় নারী-পুরুষদের আড্ডা দিতে দেখা গেছে। তাদেরই একজন মালিনা জান্নাত। তিনি ১২ বছরের সন্তানকে নিয়ে এই পার্কে এসেছেন। তার ছেলে ফুটবল খেলায় মেতেছে। তিনি ছেলের জন্য অপেক্ষা করছেন।

তার্কিশ ভাষায় লেখা পার্কের নামফলক

তুরস্কের এক দোভাষীর সাহায্যে এই নারীর সঙ্গে কথা হয়। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানতে চাইলে মালিনা জান্নাত বলেন, পার্কটি উদ্বোধনের পর সবাই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে। স্থানীয়দের অনেকেই সকাল-বিকেল পার্কে বেড়াতে যায়।

যার নামে এই পার্ক তার সম্পর্কে তিনি কী জানেন, এমন প্রশ্ন করলে পার্কের প্রধান ফটকে শ্বেতপাথরে খচিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি এবং ইংরেজি আর তার্কিশ ভাষায় তার সংক্ষিপ্ত জীবনীর দিকে তাকান মালিনা জান্নাত। তিনি বলেন, আমরা জানি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাঙালি জাতির পিতা। যেমনটি তুরস্কের জাতির পিতা কামাল আতার্তুক। এমন মহান ব্যক্তির নামে আঙ্কারায় পার্ক স্থাপন করায় আমরা খুবই খুশি।

ওই শ্বেতপাথরে বঙ্গবন্ধুর সংক্ষিপ্ত পরিচয়ে বলা হয়েছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জাতির পিতা (১৭ মার্চ ১৯২০-১৫ আগস্ট ১৯৭৫)। তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি এবং স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি। তার অধীনে অবিসংবাদিত ও বিপ্লবী নেতৃত্বে বাংলাদেশ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা লাভ করে। ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অগ্রণী ভূমিকা ছিল। এখন তার বড় মেয়ে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী।

পার্কটি তত্ত্বাবধানের বিষয়ে জানতে চাইলে তুরস্কে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মাসয়ূদ মান্নান জাগো নিউজকে বলেন, পার্কটি উদ্বোধনের পরই শিশুদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে। কনকনে শীতের মধ্যেও প্রতিটি মাঠে নিয়মিত খেলাধুলা করছে শিশু-কিশোররা। হাঁটাহাঁটি করছেন আশপাশের বয়োজ্যেষ্ঠরা। এমন পার্ক পেয়ে খুশি স্থানীয়রা। এছাড়া যিনিই পার্কে যাচ্ছেন, তিনিই বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানতে পারছেন। এভাবে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের সুনাম ছড়িয়ে পড়ছে।

তিনি বলেন, গত ১৩ ডিসেম্বর পার্কটি উদ্বোধনের দিন আঙ্কারা সিটি মেয়র ও ডিএসসিসি মেয়রের সঙ্গে একটি বৈঠক হয়। এই বৈঠকে অদূর ভবিষ্যতে ডিএনসিসি এবং আঙ্কারা সিটি করপোরেশন সিস্টার সিটি চুক্তি সইয়ের জন্য প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ করার সিদ্ধান্ত হয়। এই দুই সিটি করপোরেশনের মধ্যে চুক্তি হলে পারস্পরিক অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর সুযোগ হবে।

পাহাড়ের পাথরে প্রাণ ফেরাবে সবুজ গাছ

পার্ক স্থাপনের বিষয়ে শনিবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) মুঠোফোনে আতিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ এক ও অভিন্ন। তার অবিনাশী চেতনা ও আদর্শ চিরকাল প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রবাহিত হবে। তিনি শুধু নিজের দেশের নেতাই ছিলেন না, তিনি ছিলেন তৃতীয় বিশ্বের গণমানুষের মহান নেতা। এই মহান নেতা সম্পর্কে বিশ্বের নানা প্রান্তের তরুণ প্রজন্মকে জানাতে আঙ্কারায় পার্কটি স্থাপন করা হয়েছে। একইভাবে তুরস্কের জাতির পিতা কামাল আতাতুর্কের নামে ঢাকার বনানী পার্কের নামকরণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী তা বাস্তবায়নের কাজ চলছে। শিগগির আঙ্কারার মেয়র ঢাকা সফর করবেন। তখন পার্কটি উদ্বোধন করা হবে।

মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, তুরস্কে অনেক মানুষ বেড়াতে আসে। এই পার্কে এসে, ভাস্কর্য দেখে পর্যটকরা জানতে পারবেন বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে। এছাড়া আমি মনে করি এতে দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব আরও গভীর হবে।

এমএমএ/এমএইচআর/জিকেএস