বৃদ্ধ বাবা-মা যখন বয়সের ভারে নুয়ে পড়ে, তখন তারা হয়ে পড়ে সব থেকে অসহায়। নির্যাতন-নিপীড়নের কোনো কমতি থাকে না। ছেলে-মেয়ে সবই থাকে, থাকে না ভালোবাসা। আপন মানুষগুলোর ভালোবাসা কিংবা যত্ন থেকে বঞ্চিত হয়ে অবজ্ঞা অবহেলায় কারও স্থান হয় বৃদ্ধাশ্রমে আবার কারও রাস্তায়।
Advertisement
এমন ঘটনা আমাদের সমাজে অহরহ। বৃদ্ধ বাবা-মায়ের এই বেদনাদায়ক চিত্র মুছে দিতে এক যুগান্তকারী, মানবিক উদ্যোগ নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অবহেলিত বয়স্কদের জন্য এ পদক্ষেপ শেখ হাসিনাকে স্মরণ করবে চিরদিন।
উন্নত বিশ্বের কাতারে উঠতে আরেকটি বড় ধাপ সামাজিক সুরক্ষায় এবার ষাটোর্ধ্ব সবার জন্য পেনশন ব্যবস্থার যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই সঙ্গে বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করারও নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। গত বৃহস্পতিবার গণভবনে অর্থ বিভাগের এক অনুষ্ঠানে এ নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বর্তমানে দেশে শুধু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পেনশন পেলেও বেসরকারি চাকরিজীবীসহ সবাইকে পেনশনের আওতায় আনার প্রতিশ্রুতি ছিল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে। এজন্য দেশের ষাটোর্ধ্ব সব নাগরিককে পেনশন সুবিধার আওতায় আনতে পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।উন্নত দেশগুলোতে একটি নির্দিষ্ট বয়সের পর সব নাগরিককে সুরক্ষা দিতেই সরকার বিশেষ পেনশন সুবিধা দিয়ে থাকে; এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কয়েকটি রাজ্যেও সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু আছে। বাংলাদেশে সরকারি চাকরিজীবীরা অবসরে যাওয়ার পর আমৃত্যু তারা আর্থিক সুবিধা পান প্রতি মাসে।
Advertisement
সেই চাকরিজীবী মারা গেলে তার স্ত্রী এবং প্রতিবন্ধী সন্তান থাকলে তাকেও আমৃত্যু পেনশন দেওয়া হয়। তবে বেসরকারি খাতে কোথাও কোথাও ভবিষ্যৎ তহবিল (প্রভিডেন্ড ফান্ড) এবং সুবিধা থাকলেও পেনশনের বিষয়টি নেই। ফলে চাকরি শেষে ব্যাপক অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হন বিপুলসংখ্যক মানুষ। পেনশন কেবল সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চান না প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
৬০ বছরের বেশি বেসরকারি চাকরিজীবী ও সাধারণদেরও পেনশনের আওতায় আনতে বেশ কয়েক বছর আগে যে পরিকল্পনা করা হয়েছিল, সেটি এগিয়ে নিতে চান তিনি। এজন্য ষাটোর্ধ্ব জনগণের জন্য সর্বজনীন পেনশন স্কিম প্রণয়ন এবং কর্তৃপক্ষ স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছেন। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ও অর্থনৈতিক সক্ষমতার আলোকে বিভিন্ন নির্দেশনার পাশাপাশি জরুরিভিত্তিতে আইন করার উদ্যোগ নিতে অর্থ বিভাগকে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। ষাটোর্ধ্ব নাগরিকদের জন্য পেনশন ছাড়াও তাদের চিকিৎসার দায়িত্ব নেওয়ার পরিকল্পনার কথাও ঘোষণা হয়েছে। প্রবীণদের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসার একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর মানবিক ঘোষণায় সমাজের অবহেলিত বৃদ্ধ মানুষেরা অনেক খুশি। কেননা আমাদের দেশে হাজার হাজার বৃদ্ধ মা-বাবা আছেন যারা একটি নির্দিষ্ট বয়সের পর কর্মহীন হয়ে পড়লে সন্তানের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। আয় রোজগার না থাকায় অবহেলা অবজ্ঞার পাত্র হয়ে পড়েন সন্তানের কাছে। সেই মুহূর্তে কারও ঠাঁই হয় বৃদ্ধাশ্রমে আবার কারও ফুটপাতে। সমাজের এটাই করুণ বাস্তবতা। নীতিনৈতিকতা, বাবা-মায়ের প্রতি দায়িত্বশীলতা ভুলে সবাই যেন স্বার্থপরতার পরিচয় দিচ্ছে।
মানুষের নৈতিকতা এত নিচে নেমে গেছে যে, যে মা-বাবা সারাজীবন নিজে খেয়ে না খেয়ে সন্তানকে খাওয়ান। নিজেদের কথা চিন্তা না করে সন্তানের ভালোর জন্য জীবনটা কাটিয়ে দেন কোনোমতে। সেই সন্তান বড় হয়ে বাবা-মাকে চেনে না। বৃদ্ধ, আয় রোজগারহীন বাবা-মা তখন হয়ে ওঠে অতি ভারী বোঝা।
Advertisement
বাবা-মায়ের সেবা যত্ন তো দূরের কথা দু’বেলা সাদা ভাতও জোটে না তাদের কপালে। বাব-মায়ের যদি সম্পত্তি থাকে তবে অনেক সন্তান সেই সম্পদের বড় অংশের ভাগিদার হওয়ার আশায় বাবা-মাকে সেবা করে। যদি তারা চাকরির পেনশনের টাকা পায় তবে তাদের কপালে মেলে নানা রকম লোক দেখানো ভালোবাসা।
যদি বাবা-মা নিতান্তই গরিব এবং আয় রোজগারহীন হয় তবে তার দুঃখের শেষ নেই। বৃদ্ধ বয়সে না পারে কোনো কাজ করতে না পারে সইতে। বাধ্য হয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তায় ঠাঁই করে নেয়। আবার কেউ বেছে নেয় আত্মহত্যার পথ। বৃদ্ধ বাবা-মার প্রতি এমন আচার-আচরণ মেনে নেওয়া যায় না। টাকা-পয়সাই যেন সব একশ্রেণির মানুষের কাছে। যেখানে পরাজিত ভালোবাসা। কর্তব্য, দায়িত্ববোধ, ভালোবাসা যেন তুচ্ছ মাত্র।
বর্তমান সময়ে পত্রিকার পাতা খুললেই দেখা যায় যে বৃদ্ধ বাবা-মাকে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন ছেলের বউ। কোটিপতি অমুক এখন ভিখারি। বিশাল ব্যবসায়ীর ফুটপাতে বাস। বাবাকে ফেলে রেখে গেলেন সন্তান। এমন খবর যেন আমাদের আর দেখতে না হয়। যে বৃদ্ধ বাবা-মায়ের কিছুই থাকবে না তার থাকবে পেনশনের টাকা। কারও কাছে ভিক্ষা করে নয়, সরকারের দেওয়া পেনশনের টাকা দিয়ে সে চলবে। বৃদ্ধের দায়িত্ব নেবে সরকার।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই সময় উপযোগী উদ্যোগ সফল হোক। দেশের মানুষের মুখে যে হাসি ফুটেছে এই ষাটোর্ধ্ব পেনশন পাওয়ার কথা শুনে তা দ্রুত বাস্তবায়ন হোক। তাহলে বৃদ্ধ বয়সে কর্মহীন বাবা-মা কারও ওপর বোঝা হবে না। নিজেদের পেনশনের টাকায় দু’মুঠো খেয়েপরে শান্তিতে শেষ যাত্রা করবে। সমাজের ঘটে যাওয়া এরকম নির্মম ঘটনার জন্ম যেন আর কোথাও না হয়।
লেখক: শিক্ষার্থী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, সাধারণ সম্পাদক বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা।imranhossain64.bd@gmail.com
এইচআর/ফারুক/এমএস