বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে প্রথম শহীদ হয়েছিলেন মানিকগঞ্জের রফিক উদ্দিন আহমেদ। তার স্মৃতি ধরে রাখার জন্য জন্মস্থান সিংগাইর উপজেলার পারিল গ্রামে (রফিক নগর) সরকারিভাবে গড়ে উঠেছে ‘ভাষা শহীদ রফিক উদ্দিন আহমদ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর।’ কিন্তু নামে জাদুঘর হলেও বই ছাড়া শহীদ রফিকের কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই এখানে। তাই হতাশ হয়ে ফিরে যান অনেক দর্শনার্থী।
Advertisement
রফিকের জন্মভিটার কয়েক গজ দূরে ভাষা শহীদ রফিক উদ্দিন আহমদ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরটি অবস্থিত। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে এটি নির্মিত হয়। ২০০৮ সালের ১৫ মে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।
এছাড়া জন্মভিটায় নির্মিত হয়েছে শহীদ মিনারসহ পরিবারের সদস্যদের একটি বাসগৃহ। গ্রামের নামকরণ করা হয়েছে ‘রফিক নগর’।
সরেজমিন ভাষা শহীদ রফিক উদ্দিন আহমদ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরে গিয়ে দেখা যায়, দৃষ্টিনন্দন একতলা পাকা ভবনের বারান্দার দেয়ালে শহীদ রফিকের একটি ছবি আর তার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস লেখা রয়েছে। ভেতরে সেলফে সাজানো মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন, গল্প-উপন্যাসসহ বিভিন্ন বই। শহীদ রফিক ও তার মা, ভাইয়ের ছবিসহ কয়েকজন বীর শহীদদের ছবি রয়েছে। আছে ভাষা আন্দোলন সময়কার দুর্লভ কিছু স্থিরচিত্রও। রক্ষণাবেক্ষণের জন্য লাইব্রোরিয়ান ও একজন প্রহরী আছেন।
Advertisement
কলেজছাত্র সফিকুল ইসলাম তার এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে ঘিওর উপজেলার বড়টিয়া গ্রাম থেকে এসেছেন রফিক স্মৃতি গ্রন্থাগার ও জাদুঘর দেখতে। জাদুঘরের সামনে থেকে দুই বন্ধু কয়েকটি ছবি তুলে ভেতরে প্রবেশ করলেন। ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন ছবি আর বই দেখলেন। মুক্তিযুদ্ধের কয়েকটি বই হাতে নিয়ে নাড়াচারা করলেন তারা। দেখলেন ভাষা আন্দোলন সময়কার বিভিন্ন ছবি।
২০ মিনিট পরই তারা বাইরে বের হয়ে আসলেন। এরপর জাদুঘরের দায়িত্বে নিয়োজিতদের কাছে জানতে চাইলেন দেখার আর কিছু আছে কি না? ভেতরে শহীদ রফিকের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে কিছুই দেখেননি তারা।
তখন এই প্রতিবেদকের সামনে লাইব্রেরিয়ান ফরহাদ তাদের বললেন, সামনেই রফিকের জন্মভিটা। সেখানে একটি শহীদ মিনার আছে, দেখে আসতে পারেন।
কলেজ পড়ুয়া জেসমিন সুলতানা জানান, সময় পেলেই তিনি এখানে বেড়াতে আসেন। এটা শুধু নামেই জাদুঘর। ভাষা শহীদ রফিকের স্মৃতিচিহ্ন কিছুই নেই এখানে। কিছু বই থাকলেই কি জাদুঘর বলা যায়? প্রশ্ন করেন তিনি।
Advertisement
তিনি বলেন, শুনেছি পরিবারের সদস্যদের কাছে শহীদ রফিকের ব্যবহার্য জিনিসপত্র আছে। এগুলো জাদুঘরে রাখার দাবি জানান তিনি।
ভাষা শহীদ রফিক জাদুঘর ও গ্রন্থাগারের লাইব্রেরিয়ান ফরহাদ হোসেন খান জানান, আগে প্রতিদিন দুই থেকে আড়াইশ দর্শনার্থী আসতো জাদুঘরে। এখন করোনার কারণে কিছুটা কমেছে।
তিনি বলেন, শুধু নামকরণের মধ্যেই ‘ব্রাকেট বন্দি’ আছে রফিক স্মৃতি জাদুঘর। জাদুঘরে ১০ হাজার বই থাকলেও নেই রফিকের কোনো স্মৃতিচিহ্ন। ভাষাশহীদ রফিকের ওপর রচিত বই আছে মাত্র দুটি। বাকিগুলো গল্প উপন্যাস। শহীদ রফিকের কয়েকটি ছবি আর ভাষা আন্দোলন সময়কার কিছু খণ্ডচিত্র ছাড়া কিছু নেই।
শহীদ রফিককে জানতে আসা দর্শনার্থীরা রফিকের ব্যবহার্য জিনিসপত্রের খোঁজ নেন। কিন্তু না পেয়ে বই নাড়াচারা করে চলে যান। অনেকে আসেন শুধু পত্রিকা পড়তে। ব্যবহার্য জিনিসপত্র সংরক্ষণের পাশাপাশি স্মৃতি জাদুঘরের সামনে শহীদ রফিকের একটি ভাস্কর্য ও সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য ফুলের বাগান নির্মাণের দাবি জানান ফরহাদ।
ভাষাশহীদ রফিক উদ্দিন আহমদের ছোট ভাই খোরশেদ আলম জানান, রফিকের স্মৃতিচিহ্ন বলতে যা বোঝায় তা খুব একটা নেই। একটি পাঞ্জাবি, লুঙ্গী, টেবিল, চেয়ার ও কাপড়ের ওপর রফিকের নিজ হাতে নকশা করা একটি টেবিল ক্লথ আছে। জাদুঘরে সংরক্ষণের অভাবে তা দেওয়া হয়নি।
তিনি আরও বলেন, ভাষাশহীদ রফিক পরিবারের সদস্য হিসেবে তিনি সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে যতোগুলো ক্রেস্ট ও সম্মাননা পেয়েছেন তা জাদুঘরে দেবেন যদি তা সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা হয়।
এ বিষয়ে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট গোলাম মহিউদ্দীন বলেন, শহীদ রফিক উদ্দিনের ব্যবহৃত জিনিসপত্র জাদুঘরে দেওয়ার জন্য পরিবারের কাছে দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছি। যদি তার ব্যবহৃত কোনো জিনিসপত্র পরিবার থেকে দেওয়া হয় তাহলে তা যথাযথ মর্যাদায় জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হবে। সেইসঙ্গে যদি কেউ জমি দান করেন তাহলে রফিকনগরে ভাষাশহীদ রফিক কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হবে বলে জানান মহিউদ্দীন। ভাষাশহীদ রফিক উদ্দিন আহমদের পরিচয়
ড. সৈকত আসগরের ‘ভাষা আন্দোলন ও শহীদ রফিক’ এবং বাংলা একাডেমির ‘চরিতাভিধান’ থেকে জানা যায়, শিক্ষা জ্ঞান আর বিপ্লবের অগ্নিমন্ত্রে উদ্দীপ্ত পারিল গ্রামে ১৯২৬ সালের ৩০ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ রফিক উদ্দিন আহমদ। প্রেস ব্যবসায়ী আব্দুল লতিফ ও রাফিজা খাতুনের ৫ ছেলে ২ মেয়ের মধ্যে প্রথম সন্তান রফিক উদ্দিন আহমদ। রফিক উদ্দিন আহমদ ছাড়াও এই দম্পতির অন্য সন্তানরা হলেন, আব্দুর রশিদ, আব্দুল খালেক, আব্দুস সালাম, খোরশেদ আলম, আলেয়া বেগম ও জাহানারা বেগম।
বাল্যকাল থেকেই রফিক ছিলেন চঞ্চল প্রাণোচ্ছ্বল। সুঁই-সুতায় নকশা আঁকায় হাত পাকা ছিল বেশ। রফিকের দুরন্তপনার মুখ্য বিষয়ে ছিল গাছে চড়া। আর গাছে চড়তে গিয়েই একবার তার পা ভাঙে। চিকিৎসার জন্য সেসময় তাকে কলকাতা পর্যন্ত পাঠানো হয়েছিল। চঞ্চল রফিকের ভবিষ্যৎ ভেবে তার বাবা তাকে কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউটে ভর্তি করিয়ে দেন। কিন্তু সেখানে তার মন টেকেনি। কয়েক বছর পর ফিরে আসেন দেশে। ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয় স্থানীয় সিংগাইরের বায়রা হাইস্কুলে। এ স্কুল থেকেই ম্যাট্রিক পাস করেন তিনি। এর পর কলেজ জীবন। ভর্তি হন মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজের বাণিজ্য বিভাগে। প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষ পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। তারপর লেখাপড়া বন্ধ।
তবে লেখাপড়া ছেড়ে থাকা তার সম্ভব হয়নি। আবারও ভর্তি হন ঢাকার জগন্নাথ কলেজে। ১৯৫১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র-জনতা রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে যখন মিছিল বরে করে সেই মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন রফিক উদ্দিন আহমেদ। তাদের মিছিলে নির্বিচারে গুলি চালায় পুলিশ। ঘটনাস্থলেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন রফিক উদ্দিন। পরে তাকে ঢাকার আজিমপুর কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
ভাষা শহীদ রফিকের বাড়ির বর্তমান অবস্থা
৩৮ শতাংশ বাড়িটিতে বর্তমানে বাসবাস করেছেন রফিক উদ্দিনের তৃতীয় ভাই বীরমুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত আব্দুল খালেকের ছেলে শাহজালাল মিয়া বাবু। বাবু এখানে তার স্ত্রী বিথি আক্তার ও তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলে রাফিকে নিয়ে থাকেন। এক সময় জরাজীর্ণ বাড়িটিতে ২০০০ সালে প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্রের পক্ষ থেকে একটি পাঠাগার নির্মাণ করে দেওয়া হয়। এরপর ২০১৬ সালে জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে দুই রুমের একটি বাসস্থান ও বাড়িতে একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়।
শহীদ মিনারে প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদদের ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান প্রশাসনের কর্মকর্তাসহ সর্বস্তরের মানুষ।
ভাষাশহীদ রফিকের নামে মানিকগঞ্জে যা আছে ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ রফিকের নামে মানিকগঞ্জে উল্লেখ করার মতো তেমন কিছুই নেই। তবে মানিকগঞ্জ শহরের প্রধান সড়কের নামকরণ করা হয়েছে ভাষা শহীদ রফিক সড়ক নামে। কিছুদিন আগে শহরের খালপাড় মোড়কে রফিক চত্বর নামকরণ করা হয়। এছাড়া মানিকগঞ্জ-সিংগাইর-ঢাকা সড়কের ধল্লা এলাকায় নির্মিত সেতুকে ১৯৯৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘ভাষাশহীদ রফিক সেতু’ নামকরণ করেন। তবে শহীদ রফিকের প্রতি শ্রদ্ধাসরূপ দীর্ঘদিন ধরে এই সেতুর টোল মওকুফের দাবি জানিয়ে আসছেন স্থানীয়া।
এফএ/এএসএম