আলতাফ পারভেজ। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাস গবেষক। লিখছেন রাজনীতি ও ইতিহাসের নানা প্রসঙ্গ নিয়ে। সম্প্রতি হিজাব ঘিরে ভারতে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে সে বিষয়টি নিয়েই মুখোমুখি হয়েছেন জাগো নিউজের।
Advertisement
‘হিংসা একটা রাজনৈতিক পণ্য। ভারতে এই পণ্য কেবল সে দেশকেই পাল্টাচ্ছে না, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকেও পাল্টাচ্ছে। ধর্মীয় ও জাতিগত হিংসার রাজনীতিতে পুরো দক্ষিণ এশিয়া হেরে যাচ্ছে।’ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।
জাগো নিউজ: কর্ণাটকের হিজাব বিতর্ক গোটা ভারতে উত্তাপ ছড়িয়েছে। বিতর্ক গড়িয়েছে দেশটির সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত। ধর্মীয় এই বিতর্ককে রাজনৈতিক বলছেন অনেকে। যদি সে দিকটা আলোচনা করতেন...
আলতাফ পারভেজ: হিজাব বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক বিভেদবাদের একটা উপাদান হয়ে উঠেছে। এটা এখন আর ধর্মীয় বিষয় আকারে নেই। এমনকি পোশাকের স্বাধীনতার বিষয় আকারেও আছে সামান্যই। ভারতেও তাই হয়েছে। তবে (বিজেপিশাসিত) উত্তর প্রদেশে যে নির্বাচনের আগে আগে এই বিতর্ক ফেনিয়ে উঠেছে, সেটা লক্ষ্য করার মতো এবং বোঝার বিষয় সেটাই।
Advertisement
উত্তর প্রদেশ কেবল একটা রাজ্য নয়, একটা বিশাল দেশের মতো। এখানে মূল সামাজিক সংকট কর্মহীনতা, দারিদ্র্য, নাগরিক সুবিধার সংকট ও ফ্যাসিস্ট শাসন ব্যবস্থা। নির্বাচনে এসব ইস্যু হয়ে দাঁড়াতো। সেসব যেন আড়ালে থাকে সেজন্যই হিজাব বিতর্কে বাতাস দেওয়া হলো। বাতাসটা তারা কৌশলে যদিও উত্তর প্রদেশের বাইরে দিয়েছে, কিন্তু সেটা এখন মিডিয়ার কল্যাণে ভারতজুড়েই বিস্তার পেয়েছে।
বিজেপির এতে লাভ হলো। হিজাব নিয়ে আন্দোলন উত্তর প্রদেশে এবং ভারতজুড়ে হিন্দুভোট এক জায়গায় জড়ো করতে বিজেপির সুবিধা হবে।
হিজাব বিতর্কে সম্প্রতি উত্তপ্ত হয়েছে ভারত। সংখ্যালঘু মুসলিমরা পোশাকের স্বাধীনতাকে তাদের সাংবিধানিক অধিকার বলে উল্লেখ করছেন
আমি যে কোনো মানুষের পছন্দের অধিকার সমর্থন করি। খাবার কিংবা পোশাক সেটা যাই হোক। তবে সমাজ পর্যবেক্ষক হিসেবে এও দেখেছি—বিশ্বের যেখানে হিজাব নিয়ে যত তীব্র আন্দোলন হয়েছে সেখানে দক্ষিণপন্থি শক্তি রাজনৈতিকভাবে তুমুলভাবে লাভবান হয়েছে।
Advertisement
জাগো নিউজ: নির্বাচন ঘিরে ভারতে বারবার ধর্মীয় সংঘাত অনিবার্য করে তোলা হচ্ছে, আর এমনটি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আরও তীব্র হচ্ছে। হিজাবকাণ্ড সামনের নির্বাচনে কী প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন।
আলতাফ পারভেজ: এ প্রশ্নের কিছু উত্তর আগেই বলেছি। বিজেপি জাতীয়ভাবে প্রায় আট বছর এক নাগাড়ে ক্ষমতায়। রাজ্যগুলোর ক্ষেত্রেও তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ। ইতোমধ্যে তারা বিরোধী দলগুলোকে ছত্রখান করে দিতে পেরেছে। দেশটিতে জাতীয় বিরোধী দল বলতে সামান্যই অবশিষ্ট আছে। আঞ্চলিক কিছু দল বিজেপির বিরোধিতা করে নির্বাচন এলে। বিজেপির প্রধান সফলতা হলো তারা ভারতের জীবনধারা, সমাজকে ভেতর থেকে বদলে দিতে পারছে। কিন্তু নির্বাচনের জন্য তাদের হাতে আপাতত বাবরি মসজিদের মতো বড় ইস্যু নেই। অথচ হিন্দুভোট এক জায়গায় জড়ো করে রাখতে ধর্মীয় ইস্যুই দরকার কিংবা পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ যুদ্ধ উত্তেজনা। জাতীয় নির্বাচন এলে কী হবে জানি না, তবে আগামী এক বছর অনেক রাজ্যে নির্বাচন আছে। তার জন্য সামনে রাখা আছে হিজাব, আন্তঃধর্মীয় বিয়ে, ধর্মান্তকরণ ইত্যাদি বিষয়।
জাগো নিউজ: উন্নয়ন আর জনসমর্থনে মোদী সরকার আপাতত সফল, অন্তত অন্য দলগুলোর সঙ্গে বর্তমান অবস্থানগত তুলনামূলক বিশ্লেষণ করলে। এরপরও কেন সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে উসকে দিতে হচ্ছে?
আলতাফ পারভেজ: উন্নয়নে বিজেপি সফল—কথাটা বিভ্রান্তিকর। বিজেপির আমলে ভারতে বিলিওনিয়ার বেড়েছে। ধনীদের সম্পদ অবিশ্বাস্য গতি পেয়েছে সেটা সত্য। কিন্তু সমাজের নিচুতলায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়নি। বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকে, সামাজিক নিরাপত্তার অন্যান্য সূচকে তারা কি বিশেষ এগোতে পেরেছে? বরং বলা যায়, বিজেপির আমলে দুটি ভারত তৈরি হয়েছে। একটা ভারত বড় বড় করপোরেটদের, অপর ভারত বাকি জনসংখ্যার।
জাগো নিউজ: আপনি ভারতের বহুত্ববাদে বিশ্বাস রেখে আলোচনা করেছিলেন আগের সাক্ষাৎকারগুলোয়। এখনো কি সেই বিশ্বাসে ভরসা রাখেন?
আলতাফ পারভেজ: ভারতের ভবিষ্যৎ বহুত্ববাদে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎও তাই। এর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু এজন্য যে রাজনৈতিক কৌশল নেওয়া দরকার তাতে ভারতের বিজেপিবিরোধী শক্তি ব্যর্থ হয়েছে। বহুত্ববাদের জন্য ভারতের প্রেক্ষাপটে প্রধানত দরকার সমাজের অর্থনৈতিকভাবে বঞ্চিতদের সঙ্গে দলিত, মুসলমান ও খ্রিস্টানের ঐক্য। কিন্তু এসব সম্প্রদায় বিজেপির সাজানো ছকে, বিজেপির তৈরি ইস্যুতে রাজনীতি করে। ফলে এরা যৌথভাবে নির্বাচনী ফল ঘরে তুলতে পারে না।
উত্তর প্রদেশের আগামী নির্বাচন ঘিরে পরিকল্পিতভাবে হিজাব বিতর্ক তৈরি করা হয়েছে বলে অভিযোগ ছড়িয়েছে। ছবিতে বিজেপির দুই কান্ডারি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ
জাগো নিউজ: এমন হিংসায় আসলে হারছে কারা? শুধুই মুসলমান, না কি অন্যরাও?
আলতাফ পারভেজ: হিংসা একটা রাজনৈতিক পণ্য। ভারতে এই পণ্য কেবল সে দেশকেই পাল্টাচ্ছে না, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকেও পাল্টাচ্ছে। আমি বলবো, ধর্মীয় ও জাতিগত হিংসার রাজনীতিতে পুরো দক্ষিণ এশিয়া হেরে যাচ্ছে। কোথাও সেটা পূর্ণতা পেয়েছে—কোথাও সেটা আসন্ন, অপেক্ষা করুন।
জাগো নিউজ: ভারতের মিডিয়ার ভূমিকা নিয়ে কী বলা যায় এই রাজনীতির আগ্রাসনে?
আলতাফ পারভেজ: সেখানে সাংবাদিকতার দুটি ধারা। একটা ধারা বড় ও প্রভাবশালী—বিজেপির জন্য, বিজেপির হয়ে কাজ করছে তারা। আরেকটি ধারা—যারা দুর্বল ও ছোট—তারা চেষ্টা করছে সত্যটা তুলে ধরার। কিন্তু যে কোনো সমাজে রাজনীতি থাকে চালকের আসনে। রাজনীতি না পাল্টালে মিডিয়া সাহসী ভূমিকা রাখতে পারে না।
জাগো নিউজ: হিংসার বিরুদ্ধে ভারতের নাগরিক সমাজ সোচ্চার থাকেন সাধারণত। এখনো কথা বলছেন কেউ কেউ। কিন্তু তাতে ঐক্য সৃষ্টি হচ্ছে না...
আলতাফ পারভেজ: নাগরিক সমাজের কণ্ঠকে ক্ষীণ করে দিচ্ছে ধর্মবাদী বয়ান। বিজেপির তরফ থেকে তো আছেই—আবার অন্য ধর্মের ভেতর থেকেও একটা ধারা নাগরিকদের ধর্মীয় আদলেই মেরুকরণ চান। ফলে আগে যেটা বলেছি, বিজেপিবিরোধী শিবির একটা একক প্লাটফর্মে আসতে পারছে না। সহজে বোধহয় পারবেও না।
জাগো নিউজ: ভারতের ঘটনা নিয়ে পাকিস্তান প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে বাংলাদেশের মানুষের একটি অংশও। ধর্ম-রাজনীতি আসলে দক্ষিণ এশিয়ার জন্য কী বার্তা দিচ্ছে?
আলতাফ পারভেজ: ভারতের রাজনৈতিক পরিবর্তনে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া হিপোক্রেটিক (ভণ্ডামি) মনে হয়। এই দুই দেশ কি অন্তর থেকে বহুত্ববাদে আছে? তারা কি বিশ্বাস করে সব ধর্ম ও জাতি সমান মর্যাদার সঙ্গে মিলে মিশে থাকা দরকার? অপরের বিশ্বাসকে তারা কি শ্রদ্ধা করে? পাকিস্তানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের কী অবস্থা? বালুচ ও পশতুদের কী অবস্থা? বাংলাদেশের সমাজ জীবনে তৃণমূলে কী ধরনের পরিবর্তন ঘটছে—আমরা সে সম্পর্কে কতটা খোঁজ-খবর রাখছি নির্মোহভাবে?
এএসএস/এএ/এইচএ/জীকেএস