জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার আতারপাড়া সরকারি পুকুরপাড়ের আবাসন প্রকল্পের বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম ও তার স্ত্রী ওশনারা। রফিকুল পেশায় একজন দিনমজুর। তার স্ত্রী ওশনারা কয়েকটি বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করেন।
Advertisement
সরকারি আবাসন প্রকল্পের বসতবাড়িতে ভালোই দিন কাটছিল তাদের। এরই মধ্যে তাদের ঘর আলো করে জন্ম নেয় মেয়ে আম্বিয়া খাতুন ও ছেলে রুস্তম আলী। জন্মের পর থেকে দুই সন্তানই সুস্থ হয়ে বড় হতে থাকে। মেয়ে আম্বিয়ার বিয়েও দেওয়া হয়।
এর কিছুদিন পরই রফিকুল-ওশনারা দম্পতির কাছ থেকে বিদায় নিতে থাকে সুদিন। মেয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। একই সময় ছেলেও ধীরে ধীরে হারাতে থাকে মানসিক ভারসাম্য।
মেয়েটি স্বামী পরিত্যক্তা হয়ে ফিরে আসে বাবার বাড়ি। মানসিক প্রতিবন্ধী মেয়ে কখন কোথায় কী করে বসে এই ভাবনায় তার পায়ে পরিয়ে দেওয়া হয় লোহার শিকল। ছেলেটির চিকিৎসা চলে তাবিজ-কবজে। হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে তাকেও মাঝে মধ্যে পরানো হয় লোহার শিকল। এভাবে ১৩ বছর ধরে শিকলবন্দি জীবনযাপন করছে দুই ভাইবোন।
Advertisement
তাদের মৃত্যুর পর মানসিক প্রতিবন্ধী সন্তান দুটির ভবিষ্যৎ কী হবে তা ভেবে দুশ্চিন্তায় দিন পার করছেন রফিকুল ইসলাম-রওশন আরা দম্পতি।
প্রথমদিকে ধারদেনা আর এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে সন্তানদের চিকিৎসা করানোর চেষ্টা করেন রফিকুল ইসলাম। তবে কোনো লাভ হয়নি। বরং দিন দিন সন্তান দুটির অবস্থার অবনতি ঘটে। ফলে বাধ্য হয়েই ১৩ বছর ধরে দুই ভাইবোনকে শিকলবন্দি করে রাখা হয়।
ওই দম্পতির আরেক মেয়ে আদুরি আক্তার (১৬)। সংসারে অভাবের কারণে সে কয়েক মাস ধরে ঢাকায় একটি পোশাক কারখানায় কাজ নিয়েছে। সেখান থেকে বেতন যা পায় তা পরিবারের জন্য খরচ করছে আদুরি।
আশ্রয়ণ প্রকল্পে গিয়ে দেখা যায়, শিকলবন্দি বড় মেয়ে আম্বিয়া বেগম (২৫) এবং মেজো ছেলে রোস্তম আলীর (২১) চার পায়ে শিকল পরানো। তারা ঘরের বারান্দায় পায়ে শিকলপরা অবস্থায় বসে আছেন। মা ওশনারা রান্না করছেন।
Advertisement
তিনি জানান, কিছুক্ষণ আগে অন্যের বাড়ি থেকে পান্তাভাতের পানি (ভাতান) আর ভাতের মাড় (স্থানীয় ভাষায় ফ্যান) এনে তাদের খাইয়েছেন। এর সঙ্গে ছিল সিদ্ধ আলুর ছালসহ শিল-পাটায় বাটা ভর্তা।
বাবা রফিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে জানান, বর্তমানে কাজকর্ম না থাকায় পরিবার-পরিজন নিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছেন। তার দুই ছেলেমেয়ে যেন আগের মতো স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন সেই প্রার্থনা করেন। এজন্য বিত্তবানদের সহযোগিতা কামনা করেন অসহায় এ বাবা।
মা ওশনারা জাগো নিউজকে বলেন, ‘১৩ বছর আগে প্রথমে মেয়ে আম্বিয়া মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। চিকিৎসার এক বছরের মাথায় কিছুটা পরিবর্তন দেখা দিলে তাকে বিয়ে দিই। স্বামীর সংসারে গেলে ভালো হতে পারে এমন ধারণা থেকে বিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু বিয়ের ছয় মাস না যেতেই মেয়েকে ছেড়ে দেয় জামাই। ওই অবস্থায় আবারও চিকিৎসা করাতে মেয়েকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে নেওয়া হয়।’
‘টাকার অভাবে সেখানে চিকিৎসা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর কবিরাজি চিকিৎসা করাতে থাকি। এরই মধ্যে মেজো ছেলে রোস্তম আলীরও একই লক্ষণ দেখা যায়। তাকেও কবিরাজি চিকিৎসা করাতে থাকি। কিন্তু আজ পর্যন্ত তাদের মধ্যে কোনো পরিবর্তন হয়নি। বাড়িতে ছেড়ে দিয়ে রাখলে দুজনেই অন্য সবাইকে মারধর করে। টাকার অভাবে ভালো চিকিৎসা করাতে না পেরে তাদের পায়ে শিকল পরিয়ে রেখেছি।’ স্থানীয় মাত্রাই ইউপি চেয়ারম্যান আ ন ম শওকত হাবিব তালুকদার লজিক বলেন, পরিষদ থেকে সরকারিভাবে যতটুকু সম্ভব তা অনুদান হিসেবে ওই পরিবারকে দেওয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে কালাই উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা সাদিকুর রহমান মণ্ডল (অতিরিক্ত দায়িত্ব) বলেন, ‘নতুন যোগদান করেছি। ব্যাপারটি শুনলাম। শিকলবন্দি ওই দুই প্রতিবন্ধীকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।’
কালাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) টুকটুক তালুকদার জাগো নিউজকে বলেন, ওই পরিবারকে উপজেলা প্রশাসন থেকে অর্থ ও ত্রাণ সহযোগিতা প্রদান করা হয়েছে। চিকিৎসার জন্যও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
রাশেদুজ্জামান/এসআর/এএসএম