দেশজুড়ে

জন্মস্থানেই হারিয়ে যাচ্ছে ভাষাসৈনিক কাজী গোলাম মাহবুবের স্মৃতি

ভাষা আন্দোলনের এক অবিস্মরণীয় নাম কাজী গোলাম মাহবুব। তিনি ছিলেন ১৯৫২ সালে গঠিত সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়ে জড়িয়ে পড়েন ভাষা আন্দোলনে। ৫২’র ভাষা আন্দোলনের সূচনা বিকাশ ও সফল পরিণতিতে যে সকল ভাষা সৈনিকের নাম ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল নক্ষত্রের ন্যায় প্রজ্জ্বলিত তাদের মধ্যে অন্যতম কাজী গোলাম মাহবুব। ভাষা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালনের কারণে তাকে জেল জুলুমসহ বহু কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের সঙ্গে তার নামটি তাই অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত।

Advertisement

বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহচর কাজী গোলাম মাহবুব ১৯৪৮ এর ৪ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য ছিলেন। ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত সদস্য ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রাদেশিক কেন্দ্রীয় কমিটির। ১৯৫৩ সালে বৃহত্তর বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তাছাড়া ১৯৬৬ এর ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ এর নির্বাচন এবং ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন।

ভাষা আন্দোলন এবং তদসংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ এবং সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে স্থাপিত হয় ভাষা আন্দোলন গবেষণা কেন্দ্র ও জাদুঘর। এটিই ভাষা আন্দোলন নিয়ে গড়ে ওঠা প্রথম জাদুঘর। ভাষাসৈনিক কাজী গোলাম মাহবুবের ব্যক্তিগত উদ্যোগে তারই বাস ভবনের ২টি ঘর নিয়ে ২০০৫ সালে যাত্রা শুরু করে জাদুঘরটি।

সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সামনে ভাষাসৈনিক চত্বর তৈরি করিয়েছেন কাজী গোলাম মাহবুব। তার অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ২০০২ সালে একুশে পদক, ১৯৯৩ সালে প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম স্বর্ণ পদক, ১৯৯৮ সালে জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক জোট পদক, ২০০০ সালে তমদ্দুন মজলিশের মাতৃভাষা পদক, ২০০২ সালে আওয়ামী লীগের ভাষাসৈনিক পদক পেয়েছেন। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন তার নামে ধানমণ্ডি ১০ নম্বর সড়কের নামকরণ করে ‘কাজী গোলাম মাহবুব সড়ক’।

Advertisement

তবে ভাষাসৈনিক কাজী গোলাম মাহবুবের জন্মস্থান বরিশালের গৌরনদীতে তার স্মৃতি মুছে ফেলার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

ভাষাসৈনিক কাজী গোলাম মাহবুব ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক ও গৌরনদী পৌর নাগরিক কমিটির সভাপতি জহুরুল ইসলাম জহির বলেন, ভাষাসৈনিক কাজী গোলাম মাহবুবের গ্রামের বাড়ি বরিশালের গৌরনদী উপজেলার গৌরনদীর লাখেরাজ কসবা এলাকায়। ১৯২৭ সালের ২৩ ডিসেম্বর ওই বাড়িতেই জন্মগ্রহণ করেন কাজী গোলাম মাহবুব। তার বাবার নাম কাজী আবদুল মজিদ এবং মায়ের নাম আছিয়া খাতুন। কাজী গোলাম মাহবুব গৌরনদীর টরকী বন্দর ভিক্টোরী মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ১৯৪২ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। ম্যাট্রিকুলেশন পাস করার পর কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। ১৯৪৬ সালে ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি (সহ-সভাপতি) নির্বাচিত হন। ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগের মাস্টার্স কোর্সে ভর্তি হন। ১৯৪৮ এর ৪ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের একজন প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য তিনি। ১৯৯৩-৯৪ সালে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন।

ভাষাসৈনিক কাজী গোলাম মাহবুব ২০০৬ সালের ১৯ মার্চ মৃত্যুবরণ করেন। ২০ মার্চ তার জন্মস্থান গৌরনদীর লাখেরাজ কসবা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।

জহুরুল ইসলাম অভিযোগ করেন, বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহচর কাজী গোলাম মাহবুব গৌরনদীতে উপেক্ষিত ও অবহেলিত। তার স্মৃতি রক্ষায় গৌরনদীতে সরকারিভাবে কোনো স্থাপনা বা প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয়নি। যদিও তার স্মৃতি রক্ষায় গৌরনদী উপজেলা সদরে উপজেলা পরিষদের প্রধান সড়কে ২০০২ সালে ‘ভাষাসৈনিক কাজী গোলাম মাহবুব তোরণ’ নির্মাণ করা হয়েছিল। পাশাপাশি গৌরনদী উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয় চত্বরকে ভাষাসৈনিক কাজী গোলাম মাহবুব চত্বর করা হয়। সেখানে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছিল। ২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসের উপজেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভায় গৌরনদী উপজেলা চত্বরকে ‘ভাষাসৈনিক কাজী গোলাম মাহবুব চত্বর’ করার জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়। গৌরনদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সিদ্ধান্তটি চিঠি দিয়ে বরিশাল জেলা প্রশাসককে জানান। বরিশাল জেলা প্রশাসক স্মারক নং জেপ্র/বরি/১-২/২০০৭/১৫০ তারিখ ২৯/৩/২০০৭ এক চিঠিতে বিষয়টি অনুমোদনের জন্য স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ে পাঠালে স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগ উপ-২ শাখা বিষয়টি গত ৮/৫/২০০৭ তারিখে অনুমোদন দেন (ম্মারক নং উপ-২/৬পি-২৩/২০০২/১৫২)। চিঠিতে মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব মো. মাহাবুব আলম স্বাক্ষর করেন।

Advertisement

জহুরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, তবে দুঃখজনক হলো ২০১৫ সালে স্থানীয় একটি মহলের ষড়যন্ত্রে তোরণটি ভেঙে ফেলা হয়। শুধু তাই নয়, ওই বছর স্থানীয় প্রশাসন কাজী গোলাম মাহবুব চত্বরকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করেন এবং ওই চত্বরে ভাষাসৈনিক কাজী গোলাম মাহবুব ফাউন্ডেশন কর্তৃক নির্মিত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। এরপর সরকারি গৌরনদী কলেজ শহীদ মিনারকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ঘোষণা করে সেখানে শহীদ দিবস পালন এবং ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হচ্ছে।

তিনি বলেন, ভাষা আন্দোলনের সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক কাজী গোলাম মাহবুবের স্মৃতি রক্ষায় বরিশালের গৌরনদী উপজেলা সদরে নির্মিত তোরণ অপসারণের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে তখন ১০ জন ভাষাসৈনিক নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান। এক বিবৃতিতে তারা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে তোরণটি পুনর্নির্মাণের দাবিও জানিয়েছিলেন।

জহুরুল ইসলাম বলেন, ২০১৫ সালে ভাষাসৈনিক কাজী গোলাম মাহবুব তোরণটি ভেঙে ফেলা, চত্বর ও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার পরিত্যক্ত ঘোষণা করার প্রতিবাদে স্মারকলিপিসহ কর্মসূচি গ্রহণ করা হলে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ মাসুদ হাসান পাটোয়ারী জানিয়েছিলেন উন্নয়ন কাজের নির্মাণ সামগ্রী আনা নেওয়ার সুবিধার্থে তোরণটি ভেঙে ফেলা হয়েছে, পরবর্তীতে তোরণটি পুনর্নির্মাণ করে দেওয়া হবে। এরপর ৬ বছর পেরিয়ে গেলেও এ পর্যন্ত তোরণ আর নির্মাণ করা হয়নি।

ভাষাসৈনিক কাজী গোলাম মাহবুবের স্ত্রী ও ভাষাসৈনিক কাজী গোলাম মাহবুব ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান কাজী পিয়ারী মাহবুব বলেন, কাজী গোলাম মাহবুব ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ভাষা আন্দোলনে পিকেটিং করতে গিয়ে আহত এবং গ্রেফতার হন। ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের প্রাদেশিক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের দাবি আদায়ে ধর্মঘটে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। এ কারণে তিনি ২ মাস কারাগারে ছিলেন। ১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি গঠিত সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক নির্বাচিত করা হয় কাজী গোলাম মাহবুবকে। ভাষা আন্দোলনের কারণে কাজী গোলাম মাহবুবের নামে হুলিয়া জারি করা হয়। পরে জননিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার হলে এক বছর কারাগারে ছিলেন তিনি। ১৯৫৩ সালে বৃহত্তর বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ এর ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ এর নির্বাচন এবং ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন কাজী গোলাম মাহবুব। কাজী গোলাম মাহবুব জীবনভর দেশ ও মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন। ভাষার জন্য সংগ্রাম করতে গিয়ে জেল জুলুমসহ বহু কষ্ট সহ্য করেছেন। ভাষা আন্দোলনে ভূমিকা ছাড়াও অন্যান্য ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছেন। অথচ তার জন্মস্থান গৌরনদীতে স্মৃতিময় স্থানগুলো সংরক্ষণ করেনি কোনো সরকারই। উল্টো গৌরনদীতে একটি মহলের ষড়যন্ত্রে তার স্মৃতি মুছে ফেলা হয়েছে।

কাজী পিয়ারী মাহবুব বলেন, ভাষাসৈনিকরা বুঝতে পেরেছিলেন উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে বাঙালি জাতিস্বত্ত্বা, জাতির চিহ্ন মুছে যাবে। সেটা বুঝতে পেরে কাজী গোলাম মাহবুবরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন জেল-জুলুম আর হুমকি উপেক্ষা করে। ভাষাসৈনিকরা ইতিহাসের অংশ। কিন্তু গৌরনদীতে কাজী গোলাম মাহবুবের স্মৃতি সংরক্ষণে কোনো পদক্ষেপই নেয়া হয়নি। এটা রাষ্ট্র ও সরকারের চরম ব্যর্থতা। ভাষা আন্দোলন আমাদের গৌরবের ইতিহাস হলেও রাষ্ট্রের এ দায়িত্বহীনতা অত্যন্ত দুঃখের এবং অগৌরবের। গৌরবের ইতিহাসে অগৌরব-অমর্যাদা থাকতে পারে না। সরকারের কাছে আমার আহ্বান শুধু কাজী গোলাম মাহবুব নয়, প্রত্যেক ভাষাসৈনিকের স্মৃতি রক্ষা ও সংরক্ষণে যেন তারা ব্যবস্থা নেন।

গৌরনদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বিপিন চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ২০১৫ সালের তোরণ অপসারণ ঘটনা সম্পর্কে আমার কিছু জানা নেই। গৌরনদীতে যোগ দিয়েছি ২০২১ সালে। তবে আমি বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানবো। পাশাপাশি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।

তিনি বলেন, ভাষাসৈনিকেরা জাতির গর্বিত সন্তান। তাদের ইতিহাস, স্মৃতি সংরক্ষণ আমাদের কর্তব্য এবং গৌরবের। তাই বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে উদ্যোগ নেওয়া হবে।

এফএ/জেআইএম