সাহিত্য

সাব-অল্টার্ন তত্ত্ব : উদ্ভব, বিকাশ ও প্রভাব

এসএম তানভীর আহমদ

Advertisement

গবেষণা সবময়ই অত্যন্ত জটিল ও সময় সাপেক্ষ কাজ। যে কাজটি অত্যন্ত সুনিপুণভাবে অধ্যাপক ড. মিল্টন বিশ্বাস সাব-অল্টার্ন তত্ত্ব : উদ্ভব, বিকাশ ও প্রভাব, শীর্ষষক গবেষণায় তুলে ধরেছেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, অধ্যাপক মিল্টন বিশ্বাস কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক, কবি।‘জীবনানন্দ দাশ ও বুদ্ধদেব বসুর কাব্যচিন্তা’ শীর্ষক থিসিসের জন্য এমফিল এবং ‘তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটগল্পে নিম্নবর্গের মানুষ’ রচনার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।

২০০০ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপনার পর এখন ঢাকায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং দেশের অন্যতম লেখক। তিনি বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরামের সাধারণ সম্পাদক এবং ‘শ্যালোম ফাউন্ডেশন’ নামে একটি মানবাধিকার সংগঠনের চেয়ারম্যান ও বাংলা একাডেমির জীবন সদস্য।

ড. মিল্টন বিশ্বাস তাঁর গবেষণার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে লিখেন যে, তাঁর গবেষণার মৌলিক উদ্দেশ্য হলো বাংলা ভাষায় নিম্নবর্গীয় চৈতন্যের চিন্তাধারাগুলোকে একত্র করে তা পাঠকের নিকট তুলে ধরা। কারণ বাংলা ভাষায় এই তত্ত্বের সামগ্রিক তাত্ত্বিক দিকগুলো নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। অতপর ১৯৮২ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত গষেণামূলক গ্রন্থ, প্রবন্ধ ও নিবন্ধসমূহের সাহিত্যিক নিরীক্ষণ করেছেন। এর পাশাপাশি তিনি এ কথাও উল্লেখ করেন যে, সাব-অল্টার্ন গোষ্ঠীর চিন্তাধারার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ সাহিত্যকেও তিনি তাঁর গবেষণার সাথে সংযুক্ত করেছেন।

Advertisement

গবেষণার তাত্ত্বিক কাঠামো তৈরি করার জন্য আন্তঃবিষয়মূলক গবেষণা পদ্ধতিকে তিনি গ্রহণ করেছেন। কারণ নিম্নবর্গীয় চৈতন্যের গবেষণার দিকে দেখলে অনুধাবন করা যায় যে, তারা জ্ঞানকাণ্ডের নানা শাখার সমন্বয়বাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তাঁদের গবেষণা কর্মকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। এর ফলে সেখানে ইতিহাস, সাহিত্য, দর্শন- সহ নানা বিষয়ের চিন্তাধারার প্রবাহ লক্ষ করা যায়। এ প্রসঙ্গে গবেষক রণজিৎ গুহের উদাহরণকে সামনে তুলে ধরেছেন।

গবেষণার উৎস হিসেবে গবেষক প্রকাশিত ও অ-প্রকাশিত উভয় ধরনের উৎসকেই ব্যবহার করেছেন। গবেষক একদিকে যেমন তার লেখায় সাব-অল্টার্ন লেখকদের প্রকাশিত প্রবন্ধ থেকে শুরু করে গবেষণামূলক গ্রন্থ ব্যবহার করেছেন; অন্যদিকে, অপ্রকাশিত লেখাসমূহ, সাক্ষাৎকারও গ্রহণ করেছেন। পুরো গবেষণাকে গবেষক অধ্যাপক বিশ্বাস মোট আটটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত করে আলোচনা করেছেন।

প্রথম অধ্যায়ে তিনি গবেষণার একটি সামগ্রিক দিক তুলে ধরেছেন। যার মধ্য দিয়ে তিনি গবেষণার একটি কাঠামো দাঁড় করান। সেখানে তিনি তাঁর গবেষণার উদ্দেশ্য, সাহিত্যিক পর্যালোচনা, গবেষণার কালপর্ব, গবেষণা পদ্ধতি, উৎস ও অধ্যায়সমূহের সাযুজ্য ও সমন্বয় করে একটি সামগ্রিক দিক উপস্থাপন করেছেন। দ্বিতীয় অধ্যায়ে সাব-অল্টার্ন বা নিম্নবর্গীয় ধারণার সংজ্ঞায়ন করতে গিযে এর উৎসকে অনুসন্ধান করতে চেয়েছেন। তৃতীয় অধ্যায়ের শিরোনাম দিয়েছেন- গ্রামশির দৃষ্টিতে নিম্নবর্গ ও নিম্নবর্গ চিহ্নিতকরণ সূত্র। যার আলোকে তিনি ইতালীয় দার্শনিক আন্তোনিও গ্রামশির দৃষ্টিতে উক্ত শ্রেণিকে সংজ্ঞায়িত করেছেন।

চতুর্থ অধ্যায়ে নিম্নবর্গীয় ইতিহাস চর্চার পটভূমি ও এই তত্ত্বকে নিয়ে গড়ে ওঠা নানা ধরনের তর্ক-বিতর্ককে সামনে নিয়ে এসেছেন। পঞ্চম অধ্যায়ে নিম্নবর্গীয় চৈতন্য কীভাবে সমাজ-রাষ্ট্র-পরিবেশ ও প্রতিবেশ প্রভাবিত করেছে সে সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। ষষ্ঠ অধ্যায়ে নিম্নবর্গীয় চৈতন্যে ধর্ম বিষয়ে আলোচনা করেছেন। সপ্তম অধ্যায়ে জাতি-ভেদের নিরিখে নিম্নবর্গীয় চৈতন্যকে ব্যাখ্যা করেছেন। এই অধ্যায় অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ আমরা যদি সুপ্রাচীন কাল থেকে ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসের দিকে তাকাই তাহলে দেখবো যে, এই সমাজ কাঠামোর মধ্যে নানা ধরনের শ্রেণিবিন্যাস ছিলো।

Advertisement

ফলে সমাজের প্রান্তে বসবাসরত মানুষের অনুভূতি পণ্ডিতদের দৃষ্টি আকর্ষিত হয়নি; বরং এখানকার সাহিত্য সমাজের উচ্চ শ্রেণির কথাই অধিক ফুটে উঠেছে। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে এই অধ্যায় পাঠককে সমাজের সামনে একটি নির্মোহ চিত্র লেখক তুলে ধরেছেন। অষ্টম অধ্যায়ে সাব-অল্টার্ন তত্ত্বের সাম্প্রতিক প্রবণতাকে সামনে তুলে ধরেছেন তিনি। যদিও এটি ভারতবর্ষীয় সমাজকে বুঝতে বিশেষ অবদান রেখেছিলো। কালের বিবর্তনে তা সমগ্র বিশ্বের জ্ঞানকাণ্ডে এক অনবদ্য সংযোজন হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।উপসংহারে গবেষক পুরো গবেষণার একটি সামগ্রিক দিক তুলে ধরেছেন।

পরিশেষে বলা যেতে পারে, অধ্যাপক ড. মিল্টন বিশ্বাসের লেখা গবেষণামূলক গ্রন্থ সাব-অল্টার্ন তত্ত্ব : উদ্ভব, বিকাশ ও প্রভাব বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে এক নতুন সংযোজন। কারণ এর ফলে গবেষক থেকে শুরু করে সাধারণ পাঠক সকলেই সদর্থক অনুভূতি পাবেন। আমি মনে করি যে, এই গ্রন্থ উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠানে একটি রেফারেন্স বই হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে; লেখাবাহুল্য, বাংলা ভাষায় জ্ঞানকাণ্ডের ক্ষেত্রে একটি নতুন পালক যুক্ত হয়েছে।

বইয়ের নাম : সাব-অল্টার্ন তত্ত্ব : উদ্ভব, বিকাশ ও প্রভাব, লেখক : মিল্টন বিশ্বাস, প্রকাশক : জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা, মার্চ ২০২১, মূল্য : ৪৫০ টাকা।

এইচআর/জেআইএম