মতামত

বঙ্গবন্ধু, বাঙালি ও বাংলাদেশ

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট, ইতিহাস যাঁকে ‘সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি’ হিসেবে তৈরি করেছিল এই কলঙ্কিত দিনেই অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে কৃতঘ্ন ঘাতকের দল তাঁকে সপরিবারে হত্যা করেছিল। সেদিন তারা কেবল বাংলাদেশের স্থপতি জনককেই হত্যা করেনি, সেই সাথে হত্যার চেষ্টা করেছিল বাঙালি ও বাংলাদেশকে। মহাকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিবর্গ, যাঁরা মানবতার মুক্তির জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন যেমন- সক্রেটিস, যিশু, জোয়ান অব আর্ক, লিংকন, গান্ধী, মার্টিন লুথার কিং, এঁদেরই নামের তালিকায় আরেকটি উজ্জ্বল তারকা-নাম সেদিন যুক্ত হলো ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’।দীর্ঘদিন থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের ঘৃণ্য বিকৃতির অপচেষ্টা কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। রাষ্ট্রের প্রকৃত ক্ষমতার মালিক জনগণকে ক্ষমতাহীন করার, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট এবং উগ্র মৌলবাদীদের দ্বারা গণতন্ত্রকে পদদলিত করার যে চক্রান্ত পঁচাত্তর পরবর্তী চার দশক ধরে বাংলাদেশে হচ্ছে, এটি তারই অংশ মাত্র। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে এই চক্রান্তকারী গোষ্ঠী একটি রীতিমত খেলো বিষয়ে পরিণত করে অপমান করেছে দেশের মুক্তির লক্ষ্যে জীবনদানকারী ত্রিশ লক্ষ বীর শহীদকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা দীর্ঘ সময়ে সম্মিলিত সংগ্রামের ফসল। ভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ছয় দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন এবং নয়মাসের সশস্ত্র যুদ্ধ ইত্যাদি ঘটনাবলির ভিতর দিয়ে অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা। বাংলাদেশের জনগণ ভিতরে ভিতরে প্রস্তুত হচ্ছিল দীর্ঘ সময় ধরে; নইলে মাত্র নয় মাসের ভিতর সাধারণ নিরস্ত্র জনগণের দ্বারা একটি মারণাস্ত্রসজ্জিত হিংস্ত্র সেনাবাহিনীর শোচনীয় পরাজয়ের হিসাব মেলানো যাবে না। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বোধ করি বাংলার আপামর জনতার এই প্রস্তুতিপর্ব। আর এক কথায় যদি বলতে হয়, বাংলাদেশের জনগণকে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করেছেন বাঙালির ইতিহাসের মহোত্তম নায়ক জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠিত হয়। ছাত্রলীগের প্রধান সংগঠক ছিলেন শেখ মুজিব। ১৯৪৯ সালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের যুগ্ম-সম্পাদক পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার মধ্য দিয়ে শেখ মুজিবের জাতীয় রাজনীতির যাত্রা শুরু। ১৯৫৩ থেকে ১৯৬৬ পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনকারী শেখ মুজিব ১৯৬৬ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। দলকে ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র দিতে ১৯৫৫ সালে তাঁর উদ্যোগেই ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেয়া হয়। ১৯৬৬ সালে তিনি তাঁর বিখ্যাত ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা দেন এবং এই ছয় দফাকে তিনি আখ্যায়িত করেন বাঙালির মুক্তির সনদ হিসেবে। ছয় দফার পরিপ্রেক্ষিতে আইয়ুব সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে কারারুদ্ধ করে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কারণে শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তা আরো বেড়ে যায় এবং সমগ্র জাতি শেখ মুজিবের মুক্তির আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ১৯৬৯ গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে এই মামলার পরিসমাপ্তি ঘটে এবং শেখ মুজিব ২২ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পান। পরদিন সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে এর সভাপতি ও ডাকসুর ভিপি তোফায়েল আহমেদ শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। অসহযোগের সময় (২-২৫ মার্চ, ১৯৭১) সমগ্র বেসামরিক প্রশাসন বঙ্গবন্ধুর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। তিনি কার্যত পূর্বপাকিস্তানের সরকার প্রধান হয়ে যান। লন্ডনের দৈনিক Evening Standard -এ ১২ মার্চ ১৯৭১-এ লেখে, ‘শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমণ্ডির বাড়িটি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের অনুকরণে ইতোমধ্যে ১০নং ডাউনিং স্ট্রিটের মত পরিচিতি লাভ করেছে।’ ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু বিশাল জনসমুদ্রে ঘোষণা দেন- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এর পরিপ্রেক্ষিতেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে ২৫ মার্চ ১৯৭১-এর মধ্যরাত থেকে দেশে বিভিন্ন স্থানে পৈশাচিক তাণ্ডব ও গণহত্যা শুরু করে। ২৫ মার্চ মধ্যরাতের কিছুপর অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রত্যুষে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গ্রেফতার করে সেনানিবাসে নিয়ে যায়। গ্রেফতার হওয়ার পূর্বেই ই পি আর ট্রান্সমিটারে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি ছিল নিম্নরূপ :‘এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা। আজ হতে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণের প্রতি আমার আহবান, আপনারা যে যেখানেই থাকুন এবং যার যা কিছ আছে তা দিয়ে শেষ পর্যন্ত দখলদার সেনাবাহিনীকে প্রতিহত করুন। বাংলাদেশের মাটি থেকে পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈনিকটি বিতাড়িত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আপনাদের এ লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।’যদিও ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুই প্রথম সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণাটি দেন তবু ঘোষণার প্রসঙ্গটি নিয়ে বির্তক সৃষ্টির নানা প্রয়াস এখনও সক্রিয়। বঙ্গবন্ধু না থাকলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা একটি অনিশ্চিত বিষয় হত। স্বাধীনতা যুদ্ধের নৈতিক ভিত্তি তাঁর রচনা, আর যুদ্ধক্ষেত্রেও সঙ্গতকারণেই তিনি প্রধানতম অনুপ্রেরণা। ভারতবর্ষের ইতিহাসে এর পূর্বে কখনো এ ধরনের জাতীয় আন্দোলন সংঘটিত হয়নি। কিংবা কোনোদিন সর্বস্তরের মানুষ একযোগে সংগ্রামও করেনি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আগে মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু কিংবা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহের মতো বড় নেতা জন্মালেও তাঁরা ভারতবর্ষকে এমন কোনো সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত করতে পারেনি যাতে সমগ্র ভারতবাসী একতাবদ্ধ হয়ে ব্রিটিশের কবল থেকে মুক্ত হবার জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত হবে। ঔপনিবেশিক যুগে যতগুলো জাতীয়তাবাদী বা কৃষক আন্দোলন ভারতবর্ষে হয়েছিল তা নীতিগত, শ্রেণিগত বা ভৌগোলিক কারণে খণ্ডিত বা অসম্পূর্ণ ছিল। তিতুমীরের বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ, ফকির বিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলন, সিপাহী বিপ্লব এরকম আরো অনেক উদাহরণ আছে যেখানে মানুষের রক্ত-অশ্রু-ঘামের বিনিময়ে এসকল আন্দোলন বা বিদ্রোহের ফলে কোনো স্থায়ী সমাধান লাভ সম্ভব হয়নি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু ভারতবর্ষের ইতিহাসের একমাত্র সফল আন্দোলনের নির্মাতাই ছিলেন না, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের মধ্য দিয়ে তিনি উপমহাদেশের সর্বকালের সকল শহীদদের ঋণ শোধ করেছেন। বঙ্গবন্ধু হচ্ছেন সেই মানুষ যাঁর জীবন ও কর্ম সফল করেছে ক্ষুদিরাম-প্রীতিলতা-সূর্যসেন থেকে সালাম-বরকত-রফিক কিংবা ঊনসত্তরের শহীদ আসাদের আত্মদানকে। তিনিই একমাত্র নেতা যিনি একই সাথে বাঙালির অতীত ও ভবিষ্যতকে তাৎপর্যপূর্ণ করেছেন। তাই ইতিহাস বিকৃতিকারীদের মূর্খতা ও স্থূলতার জবাব দেয়াটাও অবান্তর হবে। বাঙালির সার্বভৌমত্বের, আর স্বাধীনতার বিষয়ে শ্রদ্ধাশীল হলে এদেরকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করতে হবে। পঁচাত্তরের পনেরই আগস্টের মধ্য দিয়ে যে ইতিহাস বিকৃতির যুগ অতিবাহিত হয়ে আসছে প্রতিটি দেশপ্রেমিক নাগরিককেই এই বিকৃতির চক্রব্যুহ ভেদ করতে হবে। বাঙালির ইতিহাসের ভিতর দিয়ে বাঙালি আপন কথা বলে। বাঙালির ইতিহাস বাঙালির অস্তিত্বের উচ্চারণ। আর বঙ্গবন্ধু সর্বকালের বাঙালির আপনতম কণ্ঠ। তাই পনেরই আগস্টের বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ড বাঙালির কণ্ঠরোধ করারই শামিল। বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রথম রূপকার বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ভিতর দিয়ে ভ্রান্ত-কপট এক বিষাক্ত ধর্মাশ্রয়ী জাতীয়তার দিকে বাঙালিকে চালিত করার পথ প্রশস্ত হয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদও বস্তুত কোনো আকস্মিক বিষয় নয়। কোনো সেনাছাউনিতে এর কলঙ্কিত জন্ম হয়নি। এর রয়েছে হাজার বছরের এক ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার ইতিহাস। আমাদের মনে পড়বে বঙ্গবন্ধুকে যেদিন হত্যা করা হয় তার পরের দিন সৌদি আরবসহ আরও কয়েকটি তথাকথিত মুসলিম রাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। এর থেকে প্রমাণিত হয় যে, ধর্মনিরপেক্ষতা যে জাতীয়তার অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল বিশ্বের প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিসমূহ কোনো দিন তা সমর্থন করতে পারে নি। উল্লেখ্য, একাত্তরের ঘাতক গোলাম আযম ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা তখন পাকিস্তান ও সৌদি আরবে অবস্থান করছিল। আর তাদের দোসররাই সেদিন শ্লোগান দিচ্ছিল “তোয়াব ভাই তোয়াব ভাই, চাঁদ-তারা পতাকা চাই।” এরা বাঙালির পতাকা ও জাতীয় সংগীতকে পরিবর্তনেরও দাবি তুলে। কিন্তু বেশির ভাগ বাঙালি স্বভাবগত উদার ধর্মীয় চেতনাধারী। সকল ধর্মের মিলনের ভিতর দিয়েই এর পূর্ণতা। মৌলবাদী ধর্মান্ধদের বাদ দিলে বাঙালিরা বহু ধর্ম-দর্শনকে নিজের উদারতা দিয়ে আপন করে নিয়েছে।  বাঙালি জাতীয়তাবাদ হচ্ছে সেই সত্তা যাকে রামমোহন-বিদ্যাসাগর-বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-সোহরাওয়ার্দীর মতো মহান ব্যক্তিবর্গ নিজের মতো করে আকার দিয়েছেন, আর সেই মৃত্তিকামূর্তির আকারে এক কঠিন সন্ধিক্ষণে বঙ্গবন্ধুকে এই দায়িত্ব নিতে হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ছাড়া বাংলার ইতিহাস হয়ত দীর্ঘকালের জন্য অশুভ অন্ধকারে থমকে থাকত। আওয়ামী লীগের সত্তরের নির্বাচনী ইশতেহারের কিছু অংশ এখানে প্রাসঙ্গিক হবে-‘‘শেরে বাংলা আজ পরলোকে। হোসেন শাহীদ সোহরাওয়ার্দী আমাদের মাঝে নাই। যাঁরা প্রবীণতার দাবি করেছেন তাঁদের অধিকাংশই হয় ইতিমধ্যেই পশ্চিম পাকিস্তানের এক শ্রেণীর বাঙালি-বিদ্বেষীর কাছে নিজেদের বিকিয়ে দিতে তল্পীবাহকের ভূমিকা গ্রহণ করেছেন, নয়তো নিষ্কর্মা, নির্জীব হয়ে পড়েছেন এবং অন্যের সলা-পরামর্শে বশীভূত হয়ে কথা ও কাজে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। আমি নিশ্চিত বুঝতে পারছি, ভাগ্য-বিপর্যস্ত মানুষের হয়ে আমাদেরকেই কথা বলতে হবে।’’ [বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্বাচনী আবেদন]বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল একটি স্বচ্ছ-জবাবদিহিতামূলক গণতান্ত্রিক কল্যাণ-রাষ্ট্র হিসেবে। পাকিস্তান আমলে এদেশের মানুষকে ভোগ করতে হয়েছে সামরিক এক নায়কত্ব। আমরা দেখেছি দক্ষিণ আমেরিকার অনেক রাষ্ট্র কিংবা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার পাকিস্তান বা মায়ানমার, তখনো যেমন, এখনো তেমনই সামরিক অপশাসনের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে। আমরা বলব এ সকল হতভাগ্য দেশ আর বাংলাদেশের মধ্যে একটাই পার্থক্য-তা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। ইতিহাসে সহজেই এর যুক্তি মিলবে- পনের আগস্টের হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়েই সূচিত হয়েছিল পাকিস্তানি আদলে বাংলাদেশের দীর্ঘ সামরিক দুঃশাসনের। এরপর গণতন্ত্রের ছদ্মবেশে চলেছে সেনানিবাস থেকেই বেসামরিক মনোভাবের অপশাসন। নিরীহ জনগণের উপর বারবার হয়েছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাহিনীর জুলুম-নির্যাতন। বস্তুত পঁচাত্তরের পনেরই আগস্ট বাংলাদেশ নামক কল্যাণ রাষ্ট্রটির হত্যারই একটি অপচেষ্টা, ঘাতকের এটা জানা ছিল যে বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকতে সামরিক সন্ত্রাস, উগ্র-মৌলবাদ আর সন্ত্রাসের অভয়ারণ্যের বাংলাদেশ তৈরি সম্ভব নয়। বাংলাদেশ দশকের পর দশক ধুঁকে ধুঁকে মরেছে। আর আকাশে ধ্বনিত হয়েছে খুনিদের উল্লাস। তাই বাঙালি জাতীয়তাবাদের মতো লাখো শহীদের রক্তে রঞ্জিত রাষ্ট্র বাংলাদেশেরও মৃত্যুঘণ্টা বাজানোর চেষ্টা হয় পঁচাত্তরের পনেরই আগস্ট। বাংলাদেশের ভিত্তি যে শাসনতন্ত্র তা ভূলুণ্ঠিত করার প্রক্রিয়া শুরু হয় তখনই। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদ কর্তৃক গৃহীত হয়। তারও পাঁচ মাস আগেই ১৯৭২ সালের ৭ জুন ঐতিহাসিক ছয় দফা দিবসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু যে বক্তৃতা করেন তাতে বাংলাদেশের সংবিধান বা শাসনতন্ত্র সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব ভাবনা সুস্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত হয়েছিল। তিনি ঐ বক্তৃতায় বাংলাদেশের সংবিধানের চার স্তম্ভ সম্পর্কে বিশদ বলেন-`আমার বাংলার সভ্যতা, আমার বাঙালি জাতি, এ নিয়ে হল বাঙালি জাতীয়তাবাদ। বাংলার বুকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ থাকবে। এ হলো আমার এক নম্বর স্তম্ভ।দ্বিতীয় স্তম্ভ, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র। এ সমাজতন্ত্র আমি দুনিয়া থেকে ভাড়া করে আনতে চাই না, এ সমাজতন্ত্র হবে বাংলার মাটির সমাজতন্ত্র। এ সমাজতন্ত্র বাংলার মানুষের সমাজতন্ত্র, তার অর্থ হল শোষণহীন সমাজ, সম্পদের সুষম বণ্টন।... কিন্তু সমাজতন্ত্র যেখানে আছে সেখানে গণতন্ত্র নাই। দুনিয়ায় আমি বাংলার মাটি থেকে দেখাতে চাই যে, গণতন্ত্রের মাধ্যমে আমি সমাজতন্ত্র কায়েম করবো। আমি ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি।....  চুতর্থ : বাংলাদেশ হবে ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ধর্ম নিরপেক্ষ মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমান মুসলমানদের ধর্ম পালন করবে। হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে। খৃস্টান তার ধর্ম পালন করবে। বৌদ্ধও তার নিজের ধর্ম পালন করবে। এ মাটিতে ধর্মহীনতা নাই, ধর্ম নিরপেক্ষতা আছে। এখানে ধর্মের নামে ব্যবসা চলবে না। ধর্মের নামে মানুষকে লুট করে যাওয়া চলবে না। ধর্মের নামে রাজনীতি করে রাজাকার, আলবদর পয়দা করা বাংলার বুকে আর চলবে না। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করতে দেয়া হবে না। এই হলো চার দফা, চার স্তম্ভ।’’  তাঁর এই বক্তব্য প্রমাণ করে যে সংবিধানে জাতীয় চারনীতির অন্তর্ভুক্তি কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না। পাকিস্তান আমলের দ্বিতীয় গণপরিষদ ও জাতীয় সংসদে ১৯৫৫ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত দেয়া বিভিন্ন ভাষণে তাঁর রাষ্ট্র চিন্তা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। তিনি সাধারণ পেশাজীবী রাজনীতিক ছিলেন না, ছিলেন প্রকৃত অর্থে একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন জাতীয় নেতা। বঙ্গবন্ধু চিরকাল সংবিধানের চার স্তম্ভের উপর জোর দিতেন। তাই তাঁকে হত্যা করে ঐ চার স্তম্ভকে বিকৃত করা হবে তা স্বাভাবিক। আর এভাবেই পনেরই আগস্ট একজন মহান স্থপতিকে হত্যার মাধ্যমেই শুরু হয় তাঁর সৃষ্ট স্থাপনার ধ্বংসযজ্ঞ। আজকের বাংলাদেশের অসহিষ্ণুতা ও জঙ্গিবাদীদের উত্থানের দিকে ভালো করে তাকালে বোঝা যাবে বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর সংবিধানের পবিত্রতা নষ্ট করার কী ফলাফল। ১৯৭৮ সালে সংবিধানের মূলনীতি সংক্রান্ত ৮ (১) দফা পরিবর্তন এবং “ধর্ম নিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা” শীর্ষক ১২ নং অনুচ্ছেদটি বিলুপ্ত করা হয়। যদিও তখন দেশে সাংগঠনিক গণতন্ত্র একেবারেই অনুপস্থিত ছিল। সেদিন জাতীয়তা পরিবর্তনের সময় ১ শতাংশ আদিবাসী সম্প্রদায়ের দোহাই দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সংবিধানকে ইসলামীকরণের সময় তারা বেমালুম অস্বীকার করেছিল ১২ শতাংশ ভিন্নধর্মী মানুষকে। আজকের বাংলাদেশে যখন অহরহ মত প্রকাশের স্বাধীনতা আক্রান্ত হয়, ব্যক্তি স্বাধীনতা হয় খর্ব কিংবা যখন উগ্র মৌলবাদের থাবায় ছিন্ন ছিন্ন হয় সাধারণের জীবন, নির্যাতন হয় সংখ্যালঘুরা, কেড়ে নেয়া হয় তাদের সম্পত্তি তখন বঙ্গবন্ধুর উল্লিখিত ভাষণটি পড়ে অবাকই হতে হয় যে, তিনি কতটা সুদূরপ্রসারী চিন্তক ছিলেন। বস্তুত বাংলাদেশকে ও এদেশের মানুষকে তাঁর চেয়ে ভালো কেউ চিনত না। ধর্মের নামে যে রাজাকার তৈরির প্রচেষ্টা আবার হবে তা বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালেই বলেছিলেন। আর সেই বাস্তবতাই আজ প্রতিফলিত হয়েছে প্রয়াত অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের ভাষায়-‘‘১৯৭১-এ যারা পাকিস্তানের সাথে যোগ দিয়েছিল, তারাই শুধু রাজাকার, এ ধারণা বাদ দিতে হবে; স্বাধীনতার পর রাজাকারের সংখ্যা বেড়েছে। যারা প্রতিক্রিয়াশীল, ধর্মান্ধ, বাংলাদেশের ইতিহাস বিকৃত করে, এখন তারাই রাজাকার।... রাজাকার শুধু ব্যক্তি নয়, ধারণাও; আমি তো এখন দিকে দিকে রাজাকার দেখি, ১৯৭১-এ এত দেখতাম না।’’   পঁচাত্তরের ঘাতকদের প্রকৃত লক্ষ্য ছিল বাঙালি ও বাংলাদেশকে অভিভাবকহীন করা। যেসব রাজনৈতিক নেতা একথা উচ্চারণ করে যে বঙ্গবন্ধু হত্যার মধ্য দিয়ে বহুদলীয় গণতন্ত্র কায়েম হয়েছে তাঁদেরকে বাঙালির ইতিহাস ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করবে। তথাকথিত বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রবর্তনের দাবিদার আমাদেরকে উপহার দিয়েছে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের নাগরিকত্ব। গণতন্ত্রের নানা প্রকারভেদ আছে। যে গ্রীকদের গণতন্ত্রের প্রথম চর্চাকারী বলা হয়ে থাকে সেখানেও কিন্তু সকল নাগরিকের ভোটাধিকার ছিল না। এথেন্সীয় গণতন্ত্র আর আধুনিক মার্কিনী গণতন্ত্রে আকাশ-পাতাল তফাৎ। মানুষের অধিকার মানুষকে ফিরিয়ে দেবার নানা পথ রয়েছে। প্রসঙ্গত বঙ্গভবনে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশে কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম বৈঠকে দলীয় চেয়ারম্যান এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের কিছু অংশ প্রণিধানযোগ্য-‘‘বাংলাদেশ নির্বাচন দিয়েই ৯৭ পারসেন্ট ভোট, আউট অব থ্রি হানড্রেড ফিফটিন, থ্রি হানড্রেড সেভেন সীটস আমাদের পার্টি আওয়ামী লীগের ছিল। যদি তারপরেও ইলেকশন দিতাম এখনো বিশ্বাস করি, দুই এক পারসেন্ট বাদও দেয়া যেতে পারে। কিন্তু নব্বই পারসেন্টের কম পাবে না আমাদের পার্টি। সেজন্য এই সিস্টেমে ক্ষমতাচ্যুত হবার সম্ভাবনা আমাদের অনেকদিন ছিল না, যদি ক্ষমতায় থাকতে চাইতাম তাহলে আমরা অনেকবারই ক্ষমতায় আসতে পারতাম।’’ পনেরই আগস্টের ঘাতকেরা একথা জানত। তারা জানত পেশিশক্তি প্রয়োগ না করলে বাংলাদেশ ও বাংলার জনগণের বুক থেকে আওয়ামী লীগকে উপড়ে ফেলা যাবে না। তাই একুশ বছর হীন চক্রান্ত করে ঠেকিয়ে রাখা হয় আওয়ামী লীগকে। আবার কারচুপির নির্লজ্জ নির্বাচনের মাধ্যমে ২০০১ সালে অগণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতায় বসে পঁচাত্তরের ঘাতকদের পৃষ্টপোষকরা। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার প্রক্রিয়াকেও তারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিলম্বিত করেছিল। একাত্তরের ঘাতকদেরকে বসানো হয়েছে রাষ্ট্রক্ষমতায়। তাই পনেরই আগস্টের হত্যাকাণ্ডকে বাংলাদেশের হত্যাকাণ্ডই বলা চলে। বাংলাদেশের মূলনীতিগুলোকে হত্যা করার অপচেষ্টা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ইতিহাসের মহোত্তম ঘটনাসমূহের একটি। মানব ইতিহাসের এটি হয়ে থাকবে সম্ভবত সবচেয়ে শক্তিশালী দৃষ্টান্ত যাতে একজন মানুষকে আমরা দেখি একটি জাতিগত স্বপ্নের অবয়ব নিতে এবং সেই মানুষের ব্যক্তিত্বের প্রভাব এতটাই গভীরে ছিল যে তাঁর উদ্দীপক উপস্থিতি রোধ করা যায় নি। পৃথিবীর ইতিহাসের এ ধরনের জাতীয় আন্দোলন অনেকই হয়েছে। কিন্তু এরকম বাঁধনছাড়া এমন ভালোবাসা কম নেতাই পেয়েছেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় বাঙালির কোনোদিন কোনো রাষ্ট্র ছিল না। বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করে দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র উপহার দেয়ার কৃতিত্ব বঙ্গবন্ধুর। শেখ মুজিব সকল বাঙালিকে অতিক্রম করেছিলেন তেজে, সাহসে, স্নেহে, ভালোবাসায়। এমন কি দুর্বলতায়ও। তাঁর দুর্বলতা ছিল তিনি বাংলার মানুষকে ভালবাসতেন এবং বিশ্বাস করতেন। মুজিব হত্যার অন্যতম কারণগুলোর একটি ছিল ঈর্ষা। মুশতাক মুজিবকে ঈর্ষা করতেন। অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিমের ভাষায়- “কেবল এই কথাটি বুঝেনি যে, ঈর্ষার পীড়িত হয়ে ঈর্ষিতের স্থান দখল করা যায় না।”বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে বাংলাদেশে যে দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল বাস্তব পৃৃথিবীতে এরকম নজির মিলবে না। একে কেবল তুলনা করা চলে বনবাস শেষে রামচন্দ্রের অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তনের সাথে। একযুগ বনবাসে থেকে তিনি যখন ফিরে আসেন তখনও অযোধ্যাবাসী তাঁর উচ্চতা আর গুণে মোহাচ্ছন্ন। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা হিসেবে তাঁরই সিংহাসন পাবার কথা; সৈয়দ নজরুল ইসলাম যেন সেদিন ঠিক ভরতের মতোই উচ্ছ্বাসে উদ্বেল হয়ে বাংলার সিংহাসনের প্রকৃত মালিক জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে তাঁর প্রাপ্য বুঝিয়ে দেন। রাজনৈতিকভাবে বঙ্গবন্ধুর যে শক্তিমত্তা ছিল তার সাথে কারোরই তুলনা হতে পারে না। ভারতীয় সৈন্য ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে তিনি যে সুচারু দক্ষতা প্রদর্শন করেন তা পৃথিবীর যেকোনো রাষ্ট্রনায়কের পাঠ্য হতে পারে। গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর মতো দক্ষ  নেতাও পৃথিবীতে নেই। গ্রীক গণতন্ত্র টিকতে পারেনি অর্থনৈতিক নীতির দুর্বলতার কারণে। পেরিক্লিসের মতো ইতিহাস বিখ্যাত গ্রীক গণতন্ত্রীও অর্থনৈতিক সংস্কার করে এথেন্সের রাষ্ট্র কাঠামোকে সুস্থিত রাখতে পারেনি। বস্তুত তাঁর পক্ষে সাম্রাজ্য রক্ষা ও শ্রেণিস্বার্থ রক্ষার মধ্যে ভারসাম্য রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রের নৈতিক ভিত্তির সাথে বরাবরই অর্থনৈতিক বিষয়ের সংযুক্তি ঘটাতেন। ভূমিসংস্কার নিয়ে তাঁর যে চিন্তাভাবনা ছিল তার বাস্তবায়ন ঘটলে আজকের বাংলাদেশে আমরা একটি সুঠাম অর্থনৈতিক অবস্থা পেতাম যা গণতন্ত্রকে সুদৃঢ় করত। বঙ্গবন্ধু বরাবরই সকল মানুষের কথা ভাবতেন। তিনি ব্যক্তি হিসেবে বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ খেটে খাওয়া মানুষের প্রতিনিধি ছিলেন। উপমহাদেশের রাজনীতির নিয়ন্ত্রণে সুদীর্ঘকাল যে উচ্চ বংশের সন্তান, ব্যারিস্টার ও উচ্চবিত্তের আধিপত্য ছিল বঙ্গবন্ধু তার উজ্বলতম ব্যতিক্রম। সপ্তদশ শতকের ইংল্যান্ডে রাজতন্ত্রের উৎখাতে যে বিপ্লব সাধিত হয় তাকে সংসদীয় গণতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বিবেচনা করা যেতে পারে। কিন্তু অন্য অনেক বিপ্লবের মতই এটিও ছিল একটি অসম্পূর্ণ খণ্ডিত ঘটনা। ক্রমওয়েল রাষ্ট্রের নেতৃত্ব দিতে চেয়েছিলেন বিত্তশালী বণিক শ্রেণিকে, লিলবার্ন শহরবাসী স্বল্পবিত্ত বা মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে, ইউনস্ট্যানলি ভূমিহীন জনতাকে। তাই গণতন্ত্রের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের মতো এরকম সকল সম্প্রদায়ের মানুষের একযোগে অংশগ্রহণের কোনো বিপ্লবের তুলনা পাওয়া যাবে না। গান্ধিজী যখন অহিংস অসহযোগের ডাক দিয়েছিলেন তখন র্যাডিক্যাল গ্রুপের সদস্যরা জঙ্গি আন্দোলন চালিয়েছিলেন, শহীদ হয়েছিলেন ভগত সিংহের মতো নেতারা। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু হংকংয়ে সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু একাত্তরে বাঙালি জাতির মধ্যে নীতি বা নেতৃত্বের কোনো সংকটই উপস্থিত হয়নি কেবল শেখ মুজিবের মতো ক্যারিশমাটিক নেতার উপস্থিতির কারণে।বাঙালি বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুকে আলাদা করে দেখা যাবে না। বাংলাদেশ নামক যে রাষ্ট্র তার ভৌগোলিক উপস্থিতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জীবনব্যাপী সাধনারই ফল। প্রকৃতঅর্থে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব একাত্তরের পূর্বে কখনো প্রতিষ্ঠা পায়নি। সিরাজউদ্দৌলাকে বলা হয় বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব। কিন্তু তিনি জনগণকে তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন নি। বলা হয়ে থাকে পলাশীর প্রান্তরের চারপাশের প্রত্যেকটি লোক যদি একটি করে ইটও ছুড়ত তাহলে লর্ড ক্লাইভের দখলদার বাহিনীর পক্ষে জয়লাভ সম্ভব হত না। তাই, যে বাংলাদেশ জনগণের রাজনৈতিক সচেতনতার উপর ভিত্তি করে পৃথিবীর মানচিত্রে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে তার রূপকার জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। বাংলাদেশ আর মুজিবকে আলাদা করা যাবে না। মুজিব হচ্ছে সেই সোনার কাঠি যা বাঙালি নামক ঘুমন্ত জাতিকে জাগিয়েছিল। তাই বঙ্গবন্ধু হত্যা সেই জাতিকে ঘুম পাড়ানোর ঘৃণ্য অপচেষ্টা। কোনো জাতিকে যদি শৈশবেই দাবিয়ে রাখা হয় তাহলে পরিণত অবস্থায় সে জাতি পিছিয়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক। জর্জ ওয়াশিংটন যুক্তরাষ্ট্রের জাতির পিতা। তিনি তাঁর মৃত্যকাল পর্যন্ত নিজ হাতে যুক্তরাষ্ট্রকে গড়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর চিন্তার ধারাবাহিকতাতেই পরবর্তী কয়েক যুগ আমেরিকা পরিচালিত হয়েছে। জর্জ ওয়াশিংটনের সতীর্থ আমেরিকার তৃতীয় রাষ্ট্রপতি টমাস জেফারসন পর্যন্ত তাঁর রাষ্ট্র চিন্তারও বাস্তবায়ন ঘটিয়েছেন। আজ আমরা এটা লক্ষ করে অবাক হই যে রাষ্ট্র ও ধর্মের মধ্যে সম্পর্ক সম্বন্ধে বঙ্গবন্ধু যা ভাবতেন তা টমাস জেফারসনের ১৭৮৬ সালে প্রণীত যুগান্তকারী আইনের মতই কল্যাণকামী ও উচ্চাকাক্ষী। পনেরই আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার মাধ্যমেই মৃত্যু ঘটে বাঙালি জাতির উচ্চাকাক্ষা ও স্বপ্নের। এর কিছুদিন পর ৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতাকে হত্যার মধ্য দিয়েও বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও চিন্তার ধারাবাহিকতাকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করা হয়। বাংলাদেশকে এখন পুনঃপাকিস্তানিকরণ করে একটি উগ্র মৌলবাদী পশ্চাদপদ মধ্যযুগীয় অকল্যাণকর রাষ্ট্রে পরিণত করার ষড়যন্ত্র চলছে। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে অসুস্থ দ্বিজাতিতত্ত্বভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তানকে ব্যর্থ করেই বাংলাদেশের অভ্যুদয়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে বলেছিলেন- ‘মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ।’ তাই বাংলার আপামর জনতার উপর আস্থা রেখে বলা যায় এই ষড়যন্ত্র সফল হবে না। কবির ভাষায়- ‘শোনো একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিববের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি।’ হ্যাঁ আমরা সেই ধ্বনি শুনতে পাই। পিতার অপূর্ণ কাজ সম্পাদন করবে সন্তান। বঙ্গবন্ধুর চেতনা কখনো ম্লান হবে না। সূর্য কখনো চিরতরে অস্ত যায় না। আওয়ামী লীগের সভানেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা আর লক্ষ মুজিবসেনা ধরে রাখবে বঙ্গবন্ধুর চেতনা। ব্যক্তির মৃত্যু হয় কিন্তু চেতনার মৃত্যু হয় না। তাই বঙ্গবন্ধুর দৈহিক তিরোধানই তাঁর মৃত্যু নয় বরং তাঁকে হত্যা করার এক অক্ষম প্রচেষ্টা মাত্র। আসুন সকলে মিলে ঐসব খুনিদের স্মরণ করিয়ে দেই বঙ্গবন্ধু হচ্ছে গ্রীক পুরাণের ফিনিক্স পাখি, যে বারবার আগুনের ভিতর থেকে জন্ম নেয়। ভস্ম হয়ে গেলেও মরে না।  লেখক : উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়এইচআর/এমএস

Advertisement