প্রায় দেড়শ বছর ধরে এক নম্বর অর্থনীতির দেশ হিসেবে বিশ্বজুড়ে দোর্দণ্ড প্রতাপ দেখিয়ে আসছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। গত কয়েক বছরে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে এগিয়ে আসতে শুরু করেছে চীন। চীনকে মনে করা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের বড় প্রতিদ্বন্দ্বী। শুধু বাণিজ্য নয়, রাজনীতি নিয়ন্ত্রণেও চীন এখন ভূমিকা রাখতে চায় বা রাখছে বলে মনে করা হয়।
Advertisement
ঋণসহায়তা দিয়ে চীন অনেক দেশকে নিজেদের প্রভাবে রাখতে চাইছে বলেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছে চীন। ‘চীনা ঋণের ফাঁদ’ বলে একটি কথা এরই মধ্যে চালু হয়ে গেছে। চীন তার বিশ্ব আধিপত্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রধানত মহাসড়ক, রেলপথ, গভীর সমুদ্রবন্দর, বিদ্যুৎ উৎপাদন প্ল্যান্ট, খনিজ আহরণ প্রকল্প ইত্যাদি ভৌত অবকাঠামোতে যে বিপুল ঋণ প্রদান করছে, তাতে বেশির ভাগ দেশ প্রলুব্ধ হয়ে এমন সব প্রকল্পে এ ঋণের অর্থ বিনিয়োগ করছে, যেগুলোর কোনো কোনোটি অর্থনৈতিকভাবে নড়বড়ে হওয়ায় প্রকল্প সম্পন্ন হওয়ার পর ওই সব প্রকল্পের আয় থেকে সুদসহ চীনের ঋণ পরিশোধ করা কঠিন হয়ে পড়ছে। দু-একটি দেশ চীনা ঋণের ফাঁদে আটকা পড়ে ওই প্রকল্পগুলোর দীর্ঘমেয়াদি কর্তৃত্ব চীনের হাতে ছেড়ে দিচ্ছে অথবা চীনকে নিজেদের সার্বভৌমত্ববিরোধী নানা সুবিধা দিতে বাধ্য হচ্ছে বলেও অভিযোগ আছে।
পাকিস্তানের চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর (সিপেক বা সিপিইসি) ও গোয়াদার গভীর সমুদ্রবন্দর, শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা গভীর সমুদ্রবন্দর ও কলম্বো চায়নিজ সিটি, মালদ্বীপের আন্তদ্বীপ যোগাযোগ সেতু, মিয়ানমারের কিয়াকফ্যু গভীর সমুদ্রবন্দর ও তেল-গ্যাস পাইপলাইন—এগুলো চীনা ঋণের ফাঁদের উদাহরণ হিসেবে সাম্প্রতিক সময়ে সামনে আসছে।
বিশেষত, বন্দর ব্যবহার বাড়াতে ব্যর্থ হয়ে শ্রীলঙ্কা হাম্বানটোটা বন্দরকে চীনের কাছে ৯৯ বছরের জন্য ইজারা দিতে বাধ্য হওয়ায় ব্যাপারটিকে ‘ফাঁদ’ হিসেবে সহজেই ব্যবহার করা যাচ্ছে। পাকিস্তানের গোয়াদার বন্দরের ব্যবহারও তেমন বাড়ানো যাচ্ছে না এবং সিপেকের সুবিধা নিয়ে চীন থেকে গোয়াদার বন্দর পর্যন্ত নির্মিত দীর্ঘ মহাসড়কের আশপাশে ব্যাপক শিল্পায়ন বা উন্নয়ন কর্মকাণ্ড শুরু হবে বলে যে আশাবাদ পাকিস্তানে দেখা দিয়েছিল, তা-ও বাস্তবে হয়নি। দরিদ্র দেশগুলোকে চীন ঋণের জালে জড়িয়ে তাদের বৈশ্বিক রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করায় দেশটির সমালোচনা হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে যে, এই ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে সেসব দেশ হিমশিম খাচ্ছে এবং এর ফলে তারা বেইজিংয়ের কাছ থেকে চাপের মুখেও পড়ছে।
Advertisement
গত এক দশকে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোকে দেওয়া চীনের ঋণের পরিমাণ তিনগুণ বৃদ্ধি বেড়েছে। ২০২০ সালের শেষ নাগাদ এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭০ বিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যের উইলিয়াম অ্যান্ড মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কেন্দ্র এইডডাটা-র এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোকে চীন যে পরিমাণ ঋণ দিয়েছে তার অর্ধেকই সরকারি পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়নি। এসব ঋণ প্রায়ই সরকারি হিসাবপত্রের বাইরে রাখা হয়।
কোনো একটি দেশের সরকারকে দেওয়া ঋণকে চীন সরকারের সরাসরি ঋণ হিসেবে না দেখিয়ে চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি এবং ব্যাংক, যৌথ প্রকল্প কিংবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে দেওয়া ঋণ হিসেবে দেখানো হয়। এইডডাটার হিসাব অনুসারে, বর্তমানে ৪০টিরও বেশি নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশ আছে, এসব ‘গোপন ঋণের’ কারণে চীনা ঋণদাতাদের কাছে যাদের ঋণের পরিমাণ তাদের বার্ষিক মোট জাতীয় উৎপাদনের ১০ শতাংশের চাইতেও বেশি।
চীনের কাছে জিবুতি, লাওস, জাম্বিয়া এবং কিরগিজস্তানের ঋণের পরিমাণ তাদের বার্ষিক মোট জাতীয় উৎপাদনের ২০ শতাংশের সমান। চীনের কাছ থেকে নেওয়া এসব ঋণের বেশিরভাগই বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্পের জন্য, যার মধ্যে রয়েছে সড়ক, রেলওয়ে এবং বন্দর নির্মাণ। খনি উত্তোলন থেকে শুরু করে জ্বালানি শিল্পের জন্যেও এসব ঋণ নেওয়া হয়েছে। অধিকাংশ ঋণই প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পের আওতায়।
বিবিসিকের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ব্রিটেনের বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা এমআই সিক্সের প্রধান রিচার্ড মুর বলেছেন, অন্যান্য দেশের কাছ থেকে সুবিধা লাভের জন্য চীন তাদের এই ‘ঋণের ফাঁদ’ ব্যবহার করে। চীন যেসব দেশকে ঋণ হিসেবে অর্থসহায়তা দিয়ে থাকে তারা সেই ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে তাদের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ বা অধিকার ছেড়ে দেয়।
Advertisement
শ্রীলঙ্কা কয়েক বছর আগে চীনা বিনিয়োগের মাধ্যমে হাম্বানটোটায় একটি বৃহৎ আকারের বন্দর নির্মাণের প্রকল্প শুরু করেছে। কয়েকশ কোটি ডলারের এই প্রকল্প, যাতে চীনের ঋণ এবং ঠিকাদার ব্যবহার করা হচ্ছে, সেটিকে ঘিরে ইতোমধ্যে বহু বিতর্ক তৈরি হয়েছে। এ প্রকল্প কতোটা বাস্তবায়নযোগ্য সেটা প্রমাণ করাও এখন বেশ কঠিন। ফলে শ্রীলঙ্কা ক্রমবর্ধমান ঋণের চাপে জর্জরিত হয়ে পড়েছে। শেষ পর্যন্ত, ২০১৭ সালে, শ্রীলঙ্কা আরও চীনা বিনিয়োগের বিনিময়ে এই বন্দরের ৭০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চায়না মার্চেন্টস কোম্পানির কাছে ৯৯ বছরের জন্য ছেড়ে দিতে সম্মত হয়েছে।
বিশ্বের অন্যান্য জায়গায়ও চীনের দেওয়া ঋণ বিতর্ক তৈরি করেছে। এসব ঋণের পেছনে এমন শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে, ফলে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদের ব্যাপারে চীন বিশেষ সুবিধা পেতে পারে। চীন তাদের বৈদেশিক ঋণের ব্যাপারে কোনো তথ্য প্রকাশ করে না এবং ঋণের ব্যাপারে যেসব চুক্তি হয় তার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব প্রকাশ না করার শর্ত দেওয়া থাকে। ফলে যারা ঋণ গ্রহণ করে তারাও চুক্তির বিষয়ে কিছু প্রকাশ করে না। তাদের যুক্তি হচ্ছে, আন্তর্জাতিক ঋণ চুক্তির ক্ষেত্রে এই গোপনীয়তা রক্ষা একটি সাধারণ বিষয়। চীন থেকে করোনা টিকা কেনা নিয়ে বাংলাদেশকে হ্যাপা পোহাতে হয়েছে। একজন কর্মকর্তা চীনা টিকার দাম সাংবাদিকদের কাছে প্রকাশ করায় চীনা কর্তৃপক্ষ নাখোশ হয়েছিল। পরে বিষয়টি মিটমাট হয়েছে।
শিল্পোন্নত বেশিরভাগ দেশই তাদের ঋণ দেওয়া-নেওয়ার ব্যাপারে প্যারিস ক্লাবের মাধ্যমে তথ্য শেয়ার করে। এসব দেশ এই ক্লাবের সদস্য। চীন এই গ্রুপে যোগ না দেওয়ার পথ বেছে নিয়েছে। তবে বিশ্বব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করে অন্যান্য দেশের সঙ্গে চীনের ক্রমবর্ধমান ঋণ কর্মসূচির তুলনামূলক একটি চিত্র পাওয়া যায়। পশ্চিমা দেশের সরকার যত সুদে ঋণ দেয় চীন তার চাইতেও বেশি সুদে ঋণ দেয়। তাদের সুদের হার প্রায় ৪ শতাংশ, যা বাণিজ্যিক মার্কেটগুলোর সুদের হারের প্রায় সমান।
এছাড়া বিশ্বব্যাংক কিংবা ফ্রান্স অথবা জার্মানির মতো ভিন্ন কোনো দেশের দেওয়া ঋণের সুদের হারের চেয়ে চীনা ঋণের সুদের হার প্রায় চারগুণ বেশি। চীনা ঋণ সাধারণত অল্প সময়ের মধ্যে পরিশোধ করতে হয়- ১০ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে। কিন্তু অন্য দাতারা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে যেসব ঋণ দেয় সেগুলো পরিশোধ করতে সময় দেওয়া হয় ২৮ বছরের মতো। একটি বিষয় হলো, চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন দাতারা চান ঋণগ্রহীতাদের যেন ভিন্ন কোনো দেশে অ্যাকাউন্ট থাকে (অফশোর অ্যাকাউন্ট) যাতে তাদেরও নিয়ন্ত্রণ থাকবে।
‘ঋণগ্রহীতা যদি তাদের ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়, কোনো ধরনের বিচার প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে না গিয়েই চীন এধরনের অ্যাকাউন্ট থেকে তাদের অর্থ সংগ্রহ করতে পারে’ বলেন ব্র্যাড পার্কস, এইডডাটার নির্বাহী পরিচালক। কিন্তু পশ্চিমা দাতাদের ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে এ বিষয়টি খুব কমই দেখা যায়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় চীন প্রকাশ্যে পাকিস্তানের পক্ষে এবং আমাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও এখন চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক খুবই ভালো। বাংলাদেশের অনেক উন্নয়ন প্রকল্পে চীন এখন অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে। তবে এসব সহযোগিতার জন্য কোনো ফাঁদ পাতা আছে কি না তা প্রকাশ্য নয়। রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসনের প্রশ্নে চীনের অবস্থান বাংলাদেশের স্বার্থের অনুকূল বলে মনে হয় না।
চীনের ঋণসহায়তা নেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সতর্কতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রযোজন বলে অনেকেই মনে করেন। চীনা ঋণে কোনো কম গুরুত্বপূর্ণ বা অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প না নেওয়াই শ্রেয় বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা। কূটনীতিক সম্পর্ক ও অর্থনৈতিক যোগাযোগ বহতা নদীর মতো, তারপরও এমন সম্পর্কে জড়ানো ঠিক নয়, যা কখনো মনে খেদ তৈরি করতে পারে। কাউকে শিক্ষা দেওয়ার মানসিকতা থেকে নয়, আত্মমর্যাদা বজায় রেখে, জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে ভারসাম্যপূর্ণ নীতি-কৌশল নিয়ে চলা উচিত।
কম প্রয়োজনীয় এমন একটি প্রকল্প হিসেবে কেউ কেউ চীনা ঋণে অর্থায়িত ঢাকা-ফরিদপুর-যশোর রেললাইনের কথা উল্পেখ করে থাকেন। পদ্মা সেতু দিয়ে মহাসড়কের মাধ্যমে ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণবঙ্গের সড়ক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এই রেললাইন অনেকখানি অপ্রয়োজনীয় হবে। অথচ প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। যমুনা রেলসেতু নির্মাণ সম্পন্ন হলে বর্তমান বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুর রেলপথের সীমাবদ্ধতা দূর হয়ে যাবে।
আরেকটি অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প মনে করা হচ্ছে দ্বিতীয় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ প্রকল্প। পত্রপত্রিকার খবর অনুযায়ী বর্তমান স্যাটেলাইটের সক্ষমতাই আমরা পুরোপুরি ব্যবহার করতে পারছি না। এ অবস্থায় দ্বিতীয় স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের উদ্যোগ অযৌক্তিক। এ ধরনের ব্যয়বহুল অথচ অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পের মোহগ্রস্ত হলে বাংলাদেশেরও একসময় ‘ঋণের ফাঁদে’ আটকে যাওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম