বিশেষ প্রতিবেদন

‘নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস করে গেলেন নূরুল হুদা’

ড. বদিউল আলম মজুমদার। অর্থনীতিবিদ, উন্নয়নকর্মী, গবেষক, রাজনীতি বিশ্লেষক, স্থানীয় সরকার ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ। কাজ করছেন দাতব্য সংস্থা ‘দি হাঙ্গার প্রজেক্ট’র বাংলাদেশ শাখার পরিচালক ও বৈশ্বিক সহ-সভাপতি হিসেবে। দায়িত্ব পালন করছেন নাগরিক সংগঠন ‘সুশাসনের জন্য নাগরিক’র (সুজন) প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবেও।

Advertisement

বিদায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা সম্প্রতি কোটি টাকার অনিয়মের অভিযোগ তুলেছেন বদিউল আলম মজুমদারের বিরুদ্ধে। সে প্রসঙ্গসহ নানা বিষয়ে জাগো নিউজের মুখোমুখি হয়েছেন সুজন সম্পাদক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।

জাগো নিউজ: নির্বাচন কমিশনের বিদায়বেলা। এমন সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা আপনার বিরুদ্ধে কোটি টাকার অনিয়মের অভিযোগ তুলেছেন, যে টাকা কমিশন থেকেই দেওয়া। এই অভিযোগের বিষয়ে আপনার বক্তব্য জানতে চাই।

ড. বদিউল আলম মজুমদার: প্রধান নির্বাচন কমিশনার যে অভিযোগ তুলেছেন, তা প্রথমত মিথ্যা, বানোয়াট এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তিনি আমার বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত লেনদেনের যে অভিযোগ তুলেছেন, তার কোনো সত্যতা নেই। মূলত আমার সঙ্গে কমিশনের কোনো লেনদেনের ঘটনাই ঘটেনি। যে কারণে তার অভিযোগ আমি সর্বৈব মিথ্যা বলে মনে করছি।

Advertisement

জাগো নিউজ: (অভিযোগ অনুসারে) সিইসি নূরুল হুদাকে (নাকি) নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা সাবধান করে দিয়েছিলেন আপনার ব্যাপারে, যেন লেনদেনের কোনো প্রসঙ্গ না থাকে। আর (নূরুল হুদা) টাকা লেনদেনের অভিযোগ তুলেছেন ড. এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশনের সময়ে।

ড. বদিউল আলম মজুমদার: আমি কমিশন থেকে কোনো কাজ নেইনি। যে কারণে কাজ অসমাপ্ত রাখার কোনো সুযোগ নেই।

জাগো নিউজ: কিন্তু আগের শামসুল হুদা কমিশনের সময়ে তো কমিশন থেকে টাকা নিয়ে বই ছাপিয়েছেন এবং অভিযোগ এই বই ছাপানো নিয়েই...

ড. বদিউল আলম মজুমদার: আমরা নির্বাচন কমিশনের তথ্য সংবলিত যে বই ছাপিয়েছি, তাতে শামসুল হুদা কমিশনের কোনো অবদান ছিল না এবং কোনো আর্থিক লেনদেনও ছিল না।

Advertisement

সবার মনে রাখা দরকার, ২০০৫ সালে উচ্চ আদালত একটি আদেশ দিয়েছিলেন। প্রার্থীদের আট ধরনের তথ্য দেওয়ার কথা বলা হয় এবং নির্বাচন কমিশন এই তথ্য জনগণের কাছে প্রকাশ করবে বলে উচ্চ আদালত আদেশ দেন।

হলফনামার ব্যাপারে ২০০৮ সালে নির্বাচন কমিশন অনেকের সহায়তা নেয় এবং সেখানে আমরাও সহায়তা করি। এ ব্যাপারে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সবচেয়ে বেশি অগ্রসর ছিল। কারণ আমরাই এ নিয়ে বিস্তর কাজ করেছি। তথ্য প্রকাশের মধ্য দিয়ে প্রার্থীদের আমরা ভোটারদের মুখোমুখি করেছি।

জাগো নিউজ: এই তথ্য প্রকাশের জন্যও তো একটি ব্যয় আছে। সুজন সে ব্যয় কোথা থেকে নির্ধারণ করে?

ড. বদিউল আলম মজুমদার: আমরা কোনো বৈদেশিক সহায়তা নেই না। সুজনের বহু সদস্য এবং শুভাকাঙ্ক্ষীর কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা নিয়ে এ ব্যয় নির্ধারিত হয়।

তবে ২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ এবং ২০১২ সালে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময় কমিশন ১২ লাখ ৫০ হাজার ৬০০ টাকা দিয়েছিল, যা প্রার্থীদের তথ্য সংগ্রহ, প্রকাশ, পোস্টার, লিফলেট, ভোটারদের মুখোমুখি করার জন্য ব্যয় হয়।

ছবিতে বাঁ থেকে ড. এটিএম শামসুল হুদা, ড. বদিউল আলম মজুমদার ও কে এম নূরুল হুদা

জাগো নিউজ: সুজন তো বেসরকারি সংগঠন। নির্বাচন কমিশন এই অর্থ দেওয়ার ক্ষমতা রাখে?

ড. বদিউল আলম মজুমদার: নিশ্চয়ই ক্ষমতা রাখে। আর হলফনামা নিয়ে আমরাই একমাত্র কাজ করে আসছিলাম এবং জনগণের মধ্যে বই আকারে প্রকাশ করেছি। জনগণকে সচেতন করার দায় থেকেই এই কাজ করা।

জাগো নিউজ: আপনি দায়ের কথা বলছেন। সিইসি বলছেন, এই বই প্রকাশের কোনো মূল্য নেই। বইয়ের পাতাকে মুড়ির ঠোঙার সঙ্গে তুলনা করেছেন তিনি।

ড. বদিউল আলম মজুমদার: আমাদের দুর্ভাগ্য যে, আমরা আমাদের অবস্থান সম্পর্কে অবগত থাকতে পারি না। কোন অবস্থান থেকে কী কথা বলতে হয়, তা ভুলে যাই।

আদালতের নির্দেশ আছে—হলফনামার তথ্যগুলো পাওয়া নাগরিকের অধিকার। বাকস্বাধীনতার মতো মৌলিক অধিকার এটি। জনগণের ক্ষমতায়নের জন্য আমরা ২০০২ সাল থেকে লড়াই করে আসছি। আদালতের রায় আছে, এ তথ্যগুলো প্রকাশ না হলে নির্বাচন সুষ্ঠু না হওয়ার আশঙ্কা আছে।

সিইসি তার অবস্থানটাই উপলব্ধি করার ক্ষমতা রাখেননি। এ কারণেই এমন মন্তব্য করেছেন।

জাগো নিউজ: আপনি শ্রীলঙ্কায় গিয়ে সিইসির সঙ্গে সাক্ষাৎ চেয়েছেন। সেখানেও সুবিধার প্রসঙ্গ ছিল বলে অভিযোগ করেছেন তিনি...

ড. বদিউল আলম মজুমদার: বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার নূরুল হুদার সঙ্গে মোট তিনবার দেখা হয়েছে আমার। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর সৌজন্য সাক্ষাৎ করি, যেখানে আমাদের প্রতিষ্ঠানের অনেকেই ছিলেন। এরপর ২০১৮ সালে শ্রীলঙ্কায় একটি কনফারেন্সে দেখা হয়। সেখানে অন্য কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনাই হয়নি। সেখানে ভোট, নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কনফারেন্স ছিল।

তার সঙ্গে একাকি কোথাও বসা বা লেনদেন সংক্রান্ত কোনো আলোচনা হয়নি। কোনো প্রমাণ দিতে পারবেন না। চরম মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে সিইসি বানোয়াট বক্তব্য দিয়েছেন।

জাগো নিউজ: সিইসি আপনার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ তুলে বিরাগভাজন হবেন কেন? কমিশনের সমালোচনা তো অনেকেই করছেন…

ড. বদিউল আলম মজুমদার: বিষয়টি আপনাকে বুঝতে হবে। ব্যক্তির জায়গা থেকে অভিযোগ তোলা আর প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে অভিযোগ তোলা ভিন্ন ব্যাপার। আমরা সুজনের পক্ষ থেকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনের জালিয়াতি-কারচুপি নিয়ে প্রশ্ন তুলে আসছি। আমরা সাহসের সঙ্গে তার ব্যর্থতা জানান দিয়ে আসছি। আমি নিজেও একটি সোচ্চার কণ্ঠ এবং অকাট্য প্রমাণসহ জনগণের সামনে তার নির্বাচন জালিয়াতির বিষয়টি উপস্থাপন করেছি।

এই কমিশনের আরেকটা ব্যর্থতা হচ্ছে, তারা ইভিএমের জন্য নির্দিষ্ট একটি যন্ত্র ব্যবহার করেছে। এর মাধ্যমে ডিজিটাল জালিয়াতির সুযোগ করে দিয়েছে। জাতিকে বড় মূল্য দিতে হবে সিইসির ব্যর্থতায়। তার জালিয়াতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছি। এ কারণেই সিইসির গাত্রদাহ।

জাগো নিউজ: কারণ কি এটিই? নাকি ব্যক্তিগত কোনো রেষারেষি?

ড. বদিউল আলম মজুমদার: না। সিইসির সঙ্গে আমার কোনো ব্যক্তিগত রেষারেষি নেই। নূরুল হুদা নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়ে জাতির বড় ক্ষতি করে গেলেন, এটিই আমাদের সমালোচনার বিষয়।

আমরা শুধু সমালোচনাই করেছি, তা নয়। যেমন- রংপুর এবং নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে, আমরা তাও বলে এসেছি।

এএসএস/এইচএ/জিকেএস