সুন্দরবন বাংলাদেশের ঢাল। বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ যে সব সময় ঠেকিয়ে দেয় বুক চিতিয়ে। দুর্যোগ যে ক্ষত তৈরি করে তা সারিয়ে তোলে রুখে দাঁড়ায় বারবার। প্রাণবৈচিত্র্যে ভরপুর এই বন দেশের অমূল্য সম্পদ। জীবন-জীবিকার অন্যতম আধার। বনের প্রতি ভালোবাসায় প্রতি বছর ১৪ ফেব্রুয়ারি পালিত হয় জাতীয় সুন্দরবন দিবস।
Advertisement
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুন্দরবন থেকে গাছ কাটা, বাঘের সংখ্যা কমে যাওয়া হুমকিস্বরূপ। বাঘ থাকলে জীববৈচিত্র্য টিকে থাকে, কমে গাছ কাটা। কিন্তু চোরা শিকারিদের দাপটে সেই বাঘও হুমকির মুখে। ক্রমেই কমছে বাঘের সংখ্যা। বাস্তুসংস্থান ঠিক রেখে এই বনকে বাঁচিয়ে রাখাই হবে আমাদের বেঁচে থাকার অন্যতম পাথেয়।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষত প্রাকৃতিকভাবেই সেরে ওঠে। কিন্তু মনুষ্যসৃষ্ট ক্ষত সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় হুমকি। বন ধ্বংস মানে নিজেদের ধ্বংসের মুখে ফেলা। গত দুই বছর আগুনে সুন্দরবন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হরিণ শিকার চলছেই। পানিতে বিষ দিয়ে মাছ ধরা পরিণত হয়েছে একটি বড় সমস্যায়। এতে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের পাশাপাশি জলজ প্রাণী ও পাখ-পাখালি হুমকির মুখে। তবে গত কয়েক বছরে একটি সফলতা আছে সুন্দরবন ঘিরে। বলা চলে সুন্দরবন এখন দস্যুমুক্ত। ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী এই সাফল্যের ঘোষণা দেন। গত তিন বছর র্যাব এই সফলতা ধরে রেখেছে।
গত বছর জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সুন্দরবনের আয়তন বাড়ানোর জন্য সরকার কৃত্রিম ম্যানগ্রোভ সৃষ্টির উদ্যোগ নিয়েছে। পুরো উপকূলীয় অঞ্চলে এর বিস্তৃতি ঘটানোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে সুন্দরবনের বৃক্ষ ও বন্যপ্রাণী রক্ষার জন্য তথা বন অপরাধ দমনের জন্য স্মার্ট পেট্রোলিংসহ নানা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। জীববৈচিত্র্যের আধার সুন্দরবনে এখন ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদ, ১৬৫ প্রজাতির শৈবাল, ১৩ প্রজাতির অর্কিড এবং ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণী রয়েছে। বন্যপ্রাণীর মধ্যে ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ, ৮ প্রজাতির উভচর, ৩১৫ প্রজাতির পাখি, ২১০ প্রজাতির মাছ, ২৪ প্রজাতির চিংড়ি ও ১৪ প্রজাতির কাঁকড়া।
Advertisement
তিনি আরও বলেন, ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের মাধ্যমে ২০১৫ সালের বাঘশুমারি অনুযায়ী সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ছিল ১০৬টি। ২০১৮ সালের শুমারিতে এর সংখ্যা ১১৪টি।
সুন্দরবনের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে বেড়ানো ও সুন্দরবনকে শান্তির জনপদে রূপান্তরে অনন্য ভূমিকা রাখা সাংবাদিক মোহসীন-উল হাকিম জাগো নিউজকে বলেন, শুধু বাঘ রক্ষা করলে হবে না। সুন্দরবন সংরক্ষণ ও এর প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ করা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা যারা সুন্দরবনকে বাঁচাতে চেয়েছি তারা শুধু বাঘ নিয়ে মনোনিবেশ করেছি। কিন্তু সামগ্রিক ইকো সিস্টেম নিয়ে কাজ করছি না। আমরা রক্ষার কথা মুখে বললেও বাস্তবে কেউ করছি না। সুন্দরবন মানে গাছপালা, বন, মাটি, পানি, বাতাস, বাঘ, হরিণ, ডলফিন, বানর, মৌমাছি, সাপসহ সামগ্রিক বিষয়।
আমরা রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে কথা বললেও ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন, উজানের পানি ও মিঠা পানির সংকটের কারণ এবং উত্তরণের উপায় নিয়ে কেউ কথা বলছি না।
মানুষের দ্বারা সুন্দরবনে ক্ষতির বিষয়গুলো নিয়ে সাংবাদিক মোহসীন-উল হাকিম বলেন, সুন্দরবনে ৬০ শতাংশ এলাকা অভয়াশ্রম। সেখানে চুরি করে নদীতে মাছ ধরার কাজ চলে। বৈধ যে জায়গাটুকু রয়েছে সেখানে সাধারণ জেলেরা মাছ ধরতে পারে না। মাছ ধরার বৈধ জায়গাটুকু প্রভাবশালীদের দখলে। বৈধ জায়গায় প্রভাবশালীদের কারণে মাছ না ধরতে পেরে জেলেরা অভয়াশ্রমে গিয়ে মাছ ধরে। এছাড়া সুন্দরবনে বিষ দিয়ে মাছ শিকার সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয়। এটি নিয়ে কেউ কথা বলে না। বিষ দিয়ে মাছ শিকারের বিষয়টি বন বিভাগের পদক্ষেপটুকুও খুব নগণ্য। সামগ্রিকভাবে সুন্দরবনকে সংরক্ষণ করার জায়গায় অনেক পিছিয়ে।
Advertisement
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের ইকোলজি এনভায়রনমেন্ট ন্যাচারাল ল্যাবরেটরির অধ্যাপক ড. আসফাক আহমদ জাগো নিউজকে বলেন, সুন্দরবন একটি ম্যানগ্রোভ বন। সুন্দরবনে স্বচ্ছ পানি ও লবণাক্ত পানি মিশ্রিত হয়। কিন্তু ধীরে ধীরে স্বচ্ছ পানি কমে যাওয়ার কারণে লবণাক্ত পানির পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। গত ২০ থেকে ৩০ বছরে সুন্দরবনের অনেক পরিবর্তন দেখা দিয়েছে।
সুন্দরবনের ভেতর প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, সুন্দরবনের ভেতর পর্যটকরা যেখানে সেখানে প্লাস্টিক ফেলে রেখে যায়। পানি নেমে যাওয়ার পর শ্বাসমূল ভেসে ওঠে, আর প্লাস্টিকের কারণে যদি শ্বাসমূল আটকে যায় তাহলে নিশ্চিত মারা যাবে গাছগুলো। নিয়ম করে হলেও যদি সুন্দরবনের ভেতর প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধ করা যায় তাহলে দূষণ কমে আসবে।
প্রফেসর ড. আসফাক আহমদ আরও বলেন, সুন্দরবনের পূর্বদিকে বিভিন্ন সময় আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। গত বছর এমন আগুনে কয়েক একর জায়গা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এদিক থেকে মানুষকে সচেতন করতে হবে। মানুষ সচেতন না হলে, না বুঝলে সুন্দরবন রক্ষা করা কঠিন। সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ ও কাঠ কাটা এগুলো প্রাকৃতিক অর্থাৎ ব্যাল্যান্স করা।
‘কোনো কিছু ধ্বংস করতে সময় লাগে না কিন্তু রক্ষা করতে সময় লাগবে। চেষ্টা করলে সবার প্রচেষ্টায় ধীরে ধীরে সুন্দরবন আগের অবস্থানে ফিরিয়ে নিয়ে আসা সম্ভব। বিশেষ করে কটকা এলাকায় সরকার উদ্যোগ নিলে গাছ লাগিয়ে আগের রূপ ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।’
সুন্দরবনের হুমকির কথা জানিয়ে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের জাগো নিউজকে বলেন, সুন্দরবনে উজান থেকে পানি আসছে। নদীতে একাধিক বাঁধ দেওয়া হয়েছে অর্থাৎ, পানির যে প্রাকৃতিক স্রোত তা বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। লবণ পানির পরিমাণ বাড়ছে। বিষ দিয়ে মাছ শিকার করা হচ্ছে। বনের ভেতরে ও আশপাশে বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ সরকারি-ব্যক্তিগত উদ্যোগে একাধিক স্থাপনা তৈরি হচ্ছে। এসব স্থাপনাকে কেন্দ্র করে ব্যাপক লোক জনসমাগম ঘটে। এছাড়া বাঘ কমে যাওয়া সুন্দরবনের জন্য বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
সুন্দরবন রক্ষায় ভূমিকা জানতে চাইলে খুলনা বন অধিদপ্তরের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দে জাগো নিউজকে বলেন, সুন্দরবন রক্ষা চলমান প্রক্রিয়া। বন যতদিন থাকবে ততদিন সুন্দরবন রক্ষায় বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সরকারের প্রধান একটি এজেন্ডা ছিল সুন্দরবনকে বনদস্যুমুক্ত করা। সেটি এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। সুন্দরবনে আগে বিভিন্ন কাঠ বিশেষ করে সুন্দরী, কেওড়া ও পশুর পাচার হতো, সেটি এখন বন। এছাড়া আবহাওয়া পরিবর্তনের যে চ্যালেঞ্জ সেটি এখনো রয়ে গেছে। সুন্দরবন এলাকায় জলোচ্ছ্বাস-ঘূর্ণিঝড়ের কারণে লোনা পানি বাড়ায় কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। যার একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব রয়েছে। হরিণ শিকার আগের তুলনায় কিছুটা কম হলেও আমরা একেবারে বলতে পারি না বন্ধ হয়ে গেছে। সামগ্রিকভাবে বন বিভাগ, কোস্টগার্ড, র্যাব, পুলিশের সঙ্গে সমন্বিতভাবে বন সংরক্ষণে কাজ করে চলেছি।
আইলা, আম্ফান ও ঘূর্ণিঝড় ইয়াস সুন্দরবনের মারাত্মক ক্ষতি করে। এই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য সরকারিভাবে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে বন বিভাগের এই কর্মকর্তা বলেন, প্রাকৃতিকভাবে যে ক্ষতি হয় তা একটি সময় পর ধীরে ধীরে প্রাকৃতিকভাবেই আগের অবস্থানে চলে আসে। কিন্তু প্রাকৃতিকভাবে হরিণ মারা গেলে হরিণ তৈরি করার সাধ্য নেই। তবে যেগুলো থাকবে সেগুলো রক্ষা করলে পরবর্তীসময়ে বাড়বে বলে আশা করা যায়। ঘূর্ণিঝড়ে অবকাঠামোগত যেসব ক্ষতি হয়েছিল সেগুলো মেরামত করা হয়েছে।
২০০১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের আওতায় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনার স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রূপান্তর ও পরশের উদ্যোগে এবং দেশের আরও ৭০টি পরিবেশবাদী সংগঠনের অংশগ্রহণে প্রথম জাতীয় সুন্দরবন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনে ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ‘সুন্দরবন দিবস’ ঘোষণা করা হয়। এরপর থেকেই প্রতিব ছর দেশে সুন্দরবন দিবস পালিত হয়ে আসছে।
টিটি/এএ/জিকেএস