সম্প্রতি জানুয়ারি মাসে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার তৃতীয় মেয়াদের তিন বছর অতিবাহিত করেছে। এই তিন বছর ছিল সরকারের জন্য অত্যন্ত ঘটনাবহুল। কারণ ২০২০ সালের শুরুর দিক থেকে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অন্যান্য প্রায় সব দেশ করোনা অতিমারির প্রভাব মোকাবিলা করতেই সবচেয়ে বেশি সময় অতিবাহিত করেছে।
Advertisement
এই সময়ে রাজনৈতিক কর্মসূচি বিশেষত সীমাবদ্ধ ছিল ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে। সরকারি ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ভার্চুয়ালি সম্পাদন করেছে। কারণ কোভিড-১৯ সংক্রমণের গতি কমানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় হচ্ছে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং ভিড় এড়িয়ে চলা।
তবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত হলেও যখনই কোভিড পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে রাজনীতির মাঠ গরম করার চেষ্টা করা হয়েছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর জাতীয় সংসদে তেমন সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকলেও তারা চেষ্টা করেছে যে কোনো উপায়ে জনগণকে সরকারবিরোধী আন্দোলনে শামিল করতে। কিন্তু বাস্তবতা হলো তাদের পক্ষে জনগণ মাঠে নামেনি। এমনকি একটি বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেত্রীর মুক্তির আন্দোলনে জনগণকে সম্পৃক্ত করা যায়নি। এর কারণ হলো গত ১৩ বছরে বাংলাদেশে যে উন্নয়ন সাধিত হয়েছে সেই উন্নয়ন এক হাতে নেতৃত্ব দিয়েছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রিয়তা জনগণের কাছে বেড়েছে কয়েকগুণ। অনেকেই প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারেন যে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। এই বিষয়টিতে তর্ক করা যেতেই পারে। তবে শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা যে জনগণের মধ্যে কয়েকগুণ বেড়েছে এ বিষয়ে কোনো তর্কের অবকাশ নেই। কারণ এ বিষয়টি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থার গবেষণার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
Advertisement
করোনা অতিমারির কারণে উন্মুক্ত স্থানে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ থাকলেও এ সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল অপপ্রচারকে ক্ষমতা পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে সরকারের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিকভাবে লবিস্ট নিয়োগের মাধ্যমে সরকার এবং দেশকে নেতিবাচকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন ইউরোপিয়ান রাষ্ট্রের সামনে উপস্থাপন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপি।
তাদের এ অপপ্রচারে বিশ্বাস করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার বাংলাদেশের পুলিশ এবং র্যাবের বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এই নিষেধাজ্ঞা জারির পর থেকে এই গোষ্ঠী আত্মতৃপ্তিতে ভুগছে। তারা এখনও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কীভাবে লবিস্টের মাধ্যমে দেশ এবং সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মিথ্যা তথ্য উপস্থাপনের মাধ্যমে দেশ এবং সরকারকে আন্তর্জাতিকভাবে খাটো করা যায়।
এই গোষ্ঠী দেশ থেকে অবৈধ উপায়ে বিপুল পরিমাণ অর্থপাচার করে লবিস্টদের প্রদান করেছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই যে প্রশ্নটি সবার মধ্যে আলোচিত হচ্ছে তা হলো বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভিলেন্স ফাঁকি দিয়ে কীভাবে বিএনপি নেতারা এ বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশের বাইরে পাঠাতে সক্ষম হলেন? আন্তর্জাতিকভাবে লবিস্ট নিয়োগের পাশাপাশি এই গোষ্ঠী দেশের বাইরে ভার্চুয়াল মিডিয়ায় সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করে চলেছে। এমনকি দেশের ভেতরে এই গোষ্ঠী সরকারের সফল মন্ত্রীদের টার্গেট করেছে। যেসব মন্ত্রী সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করছেন তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মিথ্যা তথ্য উপস্থাপনের মাধ্যমে জনগণের সামনে তাদের খাটো করার প্রয়াস অব্যাহত রয়েছে। আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি যে তথ্যমন্ত্রীর বাসায় দাওয়াত সংক্রান্ত একটি ছবি প্রচারের মাধ্যমে একটি গোষ্ঠী তাকে জনগণের সামনে ছোট করার চেষ্টা করেছে। পরবর্তীতে তিনি এ বিষয়ে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের ঘোষণা দিলে সেই গোষ্ঠী তাদের সেই অপচেষ্টা থেকে পিছপা হয়।
আমরা শিক্ষামন্ত্রীর বিরুদ্ধে একটি গোষ্ঠীর সুসংগঠিত অপপ্রচার প্রত্যক্ষ করেছি। কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ ছাড়া শিক্ষামন্ত্রী এবং তার পরিবারের সদস্যদের চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত বিষয়ে জড়িয়ে বিভিন্ন মিথ্যা তথ্য প্রচারের মাধ্যমে সম্মানহানি করার চেষ্টা করা হয়েছে। এমনকি মৎস্য এবং প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীর (যিনি অত্যন্ত সফলভাবে মন্ত্রণালয় চালিয়েছেন) বিরুদ্ধে এ ধরনের অপপ্রচার চালানো হয়েছে।
Advertisement
এখন স্বাভাবিকভাবেই যে প্রশ্নটি সবার মধ্যে আলোচিত হচ্ছে সেটি হলো এই গোষ্ঠী কেন সরকারের সফল মন্ত্রীদের টার্গেট করে এ ধরনের অপপ্রচার চালাচ্ছে? আমাদের মাথায় রাখতে হবে ২০২৩ সালের শেষ ভাগে আমাদের পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। অতএব এ নির্বাচন টার্গেট করে বিরোধী দল এবং রাজনৈতিক জোট প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে সরকারকে জনগণের সামনে এবং আন্তর্জাতিকভাবে খাটো করার। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই এই গোষ্ঠী সরকারের সব মন্ত্রীর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে।
এই গোষ্ঠীর অপপ্রচারের বিরুদ্ধে যদি এখনই সুসংগঠিতভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলা না যায় তাহলে তারা অন্যান্য নেতার বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য উপস্থাপনের মাধ্যমে জাতির সামনে তাদের হেয়প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করবে। আমাদের মাথায় রাখতে হবে মিথ্যাকে বারবার প্রচার করা হলে সেটিকে এক সময় জনগণ সত্য হিসেবে বিশ্বাস করতে শুরু করে। তারা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে কোনো রকম তথ্য প্রচার করতে ব্যর্থ হয়েছে কারণ এ সুযোগ প্রধানমন্ত্রী কাউকেই প্রদান করেননি।
অতএব এবার তাদের পরবর্তী টার্গেট হলো প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ এবং তার ক্যাবিনেটের সফল মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার পরিচালনা করা। এমনকি আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের সম্পর্কেও বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক সংবাদ পরিবেশন করে তাদের সম্মানহানির চেষ্টা করা হয়েছে। অতএব এখন সময় এসেছে এই সুসংগঠিত গোষ্ঠীকে আইনানুগ ভাবে এবং ভার্চুয়ালি প্রতিরোধ করার।
এদের প্রতিরোধ করতে হলে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ এবং সরকারের উচিত এ ধরনের অপপ্রচার চালানো ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে খুঁজে বের করা এবং তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রকৃত সত্য তথ্য প্রচারের মাধ্যমে জনগণকে বিভ্রান্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।
পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকা বাহিনীর উচিত ভার্চুয়াল মিডিয়ায় কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যারা এ ধরনের অপপ্রচার করছে তাদের খুঁজে বের করে দ্রুত আইনের আওতায় নিয়ে আসা। এদের আইনের আওতায় নিয়ে এসে বিচার নিশ্চিত করা গেলে অন্যরা ভবিষ্যতে এ ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, বিরোধী রাজনৈতিক জোট দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকার কারণে জনগণ থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। অতএব তারা যে কোনো উপায়ে ছোবল মারার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। তারা নিশ্চিত ভাবেই জানে যে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যদি ক্ষমতায় আসে তাহলে সেই সব রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একেবারে বিলীন হয়ে যাবে। তাই তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে যে কোনো উপায়ে ক্ষমতা পরিবর্তন করার। ফলে সবাইকে একত্রিত ভাবে এই গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
শত্রু যত দুর্বলই হোক না কেন তাকে কখনোই দুর্বল হিসেবে ভাবা ঠিক নয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে যারা বিভিন্ন অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে তাদের খুঁজে বের করার পাশাপাশি যারা অবৈধভাবে দেশ থেকে অর্থ পাচার করে লবিস্ট নিয়োগের মাধ্যমে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার চেষ্টা করছে তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর আশু ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি।
পাশাপাশি সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান তাদের দায়িত্ব সঠিক ভাবে পালন করতে পারছে কি না সে বিষয়টিও খতিয়ে দেখা দরকার। কারণ এত বিপুল পরিমাণ অর্থ কীভাবে দেশের বাইরে গেলো সে বিষয়টি খুঁজে বের করা দরকার। আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অবস্থানরত থাকা সত্ত্বেও কীভাবে এই গোষ্ঠী মার্কিন প্রশাসনকে বাংলাদেশবিরোধী অবস্থান নিতে সক্ষম করলো সে বিষয়টিও ভেবে দরকার। কারণ যে সরিষা দিয়ে ভুত ছাড়ানো হয় সেই সরিষার মধ্যে অনেক সময় ভুত থাকে।
আগামী দুই বছরে সরকারের রাজনৈতিক ভাবে যেমন শক্ত অবস্থান নেওয়া উচিত, তেমনি কূটনৈতিকভাবেও সরকারের অবস্থান শক্তিশালী হওয়া উচিত। প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে হলে আওয়ামী লীগকে আবার ক্ষমতায় আসতে হবে।
গত ১৩ বছরে বাংলাদেশে যে অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয়েছে উন্নয়নের সেই ধারা অব্যাহত রাখতে হলে ২০২৩ সালের নির্বাচনে অবশ্যই আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসতে হবে। এই গোষ্ঠী যেন অপপ্রচারের মাধ্যমে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে না পারে সেজন্য আমাদের সবাইকে এ চক্রের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করতে হবে।
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের প্রফেসর।
এইচআর/ফারুক/এমএস