বিপিএম ও পিপিএম- বাংলাদেশ পুলিশের দুটি মর্যাদাশীল পুরস্কার। সেবা, অসীম বীরত্ব ও সাহসিকতাপূর্ণ কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ দেওয়া হয় এ পদক। টেকনাফ থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি প্রদীপ কুমার দাশের ঝুলিতে ছিল দুটি পদকই। পিপিএম পেয়েছেন একাধিকবার। তথ্য গোপন করে ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে তিনি এই পদক নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে খোদ আদালতে। পদক বাতিলের আবেদনও করা হয়েছে। প্রদীপের পদকপ্রাপ্তির বিষয়ে ‘দায়’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন পুলিশের বর্তমান ও সাবেক কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও।
Advertisement
আদালত সূত্রে জানা যায়, প্রদীপ বিপিএম (বাংলাদেশ পুলিশ পদক) ও পিপিএম (রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক) পাওয়ার জন্য আবেদনের ক্ষেত্রে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মানুষ হত্যাকে ‘মাদক নির্মূলে’ সফলতা দেখাতে নিহতদের ‘মাদক কারবারি’ দাবি করেছেন। এ ‘অবদানের’ জন্যই দেওয়া হয় বাংলাদেশ পুলিশের সর্বোচ্চ পদক বিপিএম-পিপিএম।
১৯৯৬ সালে চাকরিতে যোগ দেওয়া এই পুলিশ কর্মকর্তা দু’বার পুলিশ বিভাগের সর্বোচ্চ সম্মাননা পুরস্কার পিপিএম পান। তিনি আইজিপি ব্যাজ পান দু’বার। এছাড়া ২০১৯ সালে পুলিশ সপ্তাহে বিপিএম সাহসিকতা পদক পান তৎকালীন টেকনাফ থানার এই ওসি।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ওসি প্রদীপকে বিপিএম-পিপিএম পদক দেওয়ার কারণে পদকের সম্মান ভূলুণ্ঠিত হয়েছে বলে মনে করছেন আদালত। মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা মামলার রায় ঘোষণার সাতদিন পর মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয়েছে। ২৮৮ পৃষ্ঠার রায়ে ওসি প্রদীপের নানা বিষয় তুলে ধরার পাশাপাশি আদালত পদকের বিষয়ে এমন মন্তব্য করেছেন।
Advertisement
গত ৩১ জানুয়ারি মেজর (অব.) সিনহা হত্যার রায়ে কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ ইসমাঈল বলেন, ওসি প্রদীপের অতীত রেকর্ড খারাপ হওয়া সত্ত্বেও তাকে একাধিকবার বিপিএম-পিপিএম পদকে ভূষিত করায় ওই পদকের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছে।
কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ও পিপি অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, ওসি প্রদীপের মতো একজন বিতর্কিত পুলিশ কর্মকর্তা এত অপকর্ম করার পরও বিপিএম-পিপিএম পদকে ভূষিত করা পুলিশ বাহিনীর জন্য লজ্জার বলে মনে করেন আদালত।
পিপি অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম বলেন, প্রদীপ যে থানায়ই দায়িত্ব পালন করেছেন সে থানায়ই তিনি অপরাধ করেছেন। টাকার প্রতি তার লোভ ছিল অনেক বেশি। তথ্য গোপন করে বিপিএম-পিপিএম পদক নিয়েছেন। যখন টেকনাফ থানায় এসআই ছিলেন তখন একটি মামলায় এফআইআরবহির্ভূত এক ব্যক্তিকে চার্জশিটে এনে আসামি করার কারণে তার বিরুদ্ধে কক্সবাজার অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতে মামলা হয় এবং তার শাস্তি হয়। তার বিপিএম-পিপিএম পদক প্রত্যাহারের জন্য আদালতে আবেদন করা হয়েছে।
টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ২০৫তম শিকার নিহত মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান। কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ ইসমাঈল রায় পড়ার সময় এ তথ্য উঠে আসে। প্রদীপ কুমার দাশ বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়াদের ডাকাত, মাদক ব্যবসায়ী, মানব পাচারকারী হিসেবে অপরাধী সাব্যস্ত করে হত্যা করে ক্রসফায়ারের নাটক সাজাতেন। প্রায় প্রত্যেক হত্যাকাণ্ডের শিকার ভিকটিম/ভিকটিমদের নিকটাত্মীয়, পাড়া-প্রতিবেশীসহ ৩০-৪০ জনকে আসামি করে একটি হত্যা, একটি মাদক ও একটি অস্ত্র মামলা করতেন।
Advertisement
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) মো. কামরুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, প্রতি বছর বিপিএম-পিপিএম পদক একটি কমিটির মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিয়ে দেওয়া হয়। এটি পুলিশে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদক। প্রধানমন্ত্রী থেকে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর হয়ে পদকগুলো দেওয়া হয়। ওসি প্রদীপের পদকের বিষয়টি যদি ভুল হয়ে থাকে, আদালত যদি মনে করেন তদন্ত কমিটি করে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন, তাহলে তদন্ত কমিটি করা হবে। বিষয়টি আদালত আমলে নিয়ে থাকলে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে পুলিশ সদর দপ্তর।
পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (অতিরিক্ত আইজিপি) মোখলেসুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, মিথ্যা তথ্য দিয়ে পদক নেওয়া সম্ভব নয়। পদক দেওয়ার আগে যাচাই-বাছাই করা হয়। যেদিক থেকে পদকের বিষয়ে প্রোপোজালটা আসে তার ঊর্ধ্বতন পুলিশ সুপার ডিআইজি সাহেব সেটি দেখেন। এরপর পুলিশ সদর দপ্তরে আসার পর একটি কমিটি যাচাই-বাছাই করে যোগ্যতার ভিত্তিতে কে পদক পাবে না পাবে নির্ধারণ করা হয়।
তিনি বলেন, যে কেউ আদালতে শরণাপন্ন হতে পারেন। আদালত যদি পদক প্রত্যাহারের কথা বলেন তাহলে পুলিশের তা পালন করা কর্তব্য।
জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক জাগো নিউজকে বলেন, যিনি বিপিএম-পিপিএম পদক পাবেন তার নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তা থাকে। জেলা হলে পুলিশ সুপার ডিআইজির মাধ্যমে আর মেট্রোপলিটন এলাকা হলে ডিসি পুলিশ কমিশনারের মাধ্যমে পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠাবেন। তারা তাদের অধস্তন কর্মকর্তাদের নাম সুপারিশ করেন। পুলিশ সদর দপ্তরে বড় কমিটি রয়েছে। তারা যাচাই-বাছাইয়ের পর আইজিপি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠান। মন্ত্রণালয় থেকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যায় এরপর রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে জিও হয়।
ওসি প্রদীপের পদকের বিষয়ে তিনি বলেন, প্রদীপের মূল্যায়ন করেছিলেন তার ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা। প্রদীপের ভালো কাজের মূল্যায়নের ভিত্তিতে পদক দিতে সুপারিশ করেছিলেন তারা। প্রদীপ মিথ্যা তথ্য দিয়েছে, এটা বললে তো হবে না। প্রদীপের কন্ট্রোলিং অফিসার ছিলেন যারা তারা তার কাজের রেকর্ড মূল্যায়নের পরই নাম সুপারিশ করেছিলেন। ভুয়া কিংবা মিথ্যা তথ্য দিয়ে পদক পাওয়ার কথা নয়।
এখন পর্যন্ত পুলিশের কোনো সদস্যের বিপিএম-পিপিএম পদক প্রত্যাহারের নজির নেই জানিয়ে সাবেক এই আইজিপি বলেন, কর্তৃপক্ষ যা দিতে পারে তারা তা বাতিলও করতে পারে। ওসি প্রদীপের বিষয়ে যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে।
তৎকালীন কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) (বর্তমানে রাজশাহী জেলা পুলিশ সুপার) এ বি এম মাসুদ হোসেনের সরকারি মোবাইল নম্বরে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।
টেকনাফ থানায় যোগ দেওয়ার আগে ওসি প্রদীপ কক্সবাজার জেলার মহেশখালী থানা, উখিয়া থানা, কক্সবাজার সদর মডেল থানা, চট্টগ্রামের পতেঙ্গা, পাঁচলাইশ ও বায়েজিদ বোস্তামি থানায় কর্মরত ছিলেন।
২০১৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ওসি প্রদীপ কুমার দাশ কক্সবাজারের মহেশখালী থানায় যোগ দেন।
২০২০ সালের ৩১ জুলাই ঈদুল আজহার আগের রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিনড্রাইভ সড়কের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর এপিবিএন চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন মেজর সিনহা।
হত্যাকাণ্ডের চারদিন পর ৫ আগস্ট সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদী হয়ে কক্সবাজার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিমের আদালতে হত্যা মামলা করেন। মামলায় টেকনাফ থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশসহ নয়জনকে আসামি করা হয়।
মামলায় প্রধান আসামি করা হয় বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে। ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে করা হয় দুই নম্বর আসামি। মামলার তিন নম্বর আসামি বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রে কর্মরত উপ-পরিদর্শক (এসআই) নন্দ দুলাল রক্ষিত। কক্সবাজারের র্যাব-১৫ মামলাটির তদন্তভার পায়।
ওই বছরের ৭ আগস্ট মামলার আসামি সাত পুলিশ সদস্য আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। পরে তদন্তে নেমে হত্যার ঘটনায় স্থানীয় তিন বাসিন্দা, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) তিন সদস্য ও ওসি প্রদীপের দেহরক্ষীসহ আরও সাতজনকে গ্রেফতার করে র্যাব। এরপর ২০২১ সালের ২৪ জুন মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি কনস্টেবল সাগর দেবের আদালতে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে আলোচিত এই মামলার ১৫ আসামির সবাই আইনের আওতায় আসেন।
মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা মামলায় অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় বিতর্কিত ওসি (বরখাস্ত) প্রদীপ কুমার দাশ ও লিয়াকত আলীর মৃত্যুদণ্ড এবং ছয়জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেন আদালত। তবে এ মামলা থেকে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) তিন সদস্যসহ সাতজনকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়।
টিটি/এএ/এমএস