সাহিত্য

লতা মঙ্গেশকর: কণ্ঠই চিরকালীন সংগীত পরিচয়

লেখক ও সংগীত পরিচালক দেবজ্যোতি মিশ্র লতা মঙ্গেশকরের প্রয়াণে লেখেন, ‘তাঁর সামনে মৃত্যুও বড় বিব্রত, অবিন্যস্ত হয়ে তাঁর পায়ের কাছে শোকে মুহ্যমান। আজ সেই মহানদীর পাড়ে বিসর্জনের সানাই বাজছে। অথচ মৃত্যু সে কি নিশ্চিন্ত। চপলা হরিণীর মতো কিংবা এক অনন্ত মুগ্ধতার মাঝে আঁচল বিছিয়ে দিয়েছেন ঈশ্বর।’

Advertisement

সংগীত হলো সূর্যের কিরণ। সুরের সৌন্দর্য উপলব্ধির বিষয়। সংগীত, সুগন্ধি, রং আর চিত্রকলার মধ্যে এক গভীর সম্পর্ক রয়েছে। সংগীত, রং, পুষ্প, পানি, বায়ু, মহাকাশ, সুগন্ধি—এদের কোনো ধর্ম নেই। কিন্তু সব ধর্মের প্রয়োজন পুষ্প, সংগীত ও রংকে। সুরই পুরো পৃথিবীকে একটি সুতোয় বেঁধে রেখেছে। সংগীতের শক্তির কাছে আজ নতজানু—হিমালয় থেকে বঙ্গোপসাগর। সংগীতবিশ্বে চিরকালীন হয়ে থেকে যাবেন লতা মঙ্গেশকর।

কিন্নরকণ্ঠী লতা মঙ্গেশকর, কণ্ঠ দিয়েই তাঁর পরিচিতি। ‘নাম গুম যায়েগা, চেহরা ইয়ে বদল যায়েগা। মেরি আওয়াজ হি পহেচান হ্যায়।’ নিজেই গেয়েছেন গীতিকার গুলজার আর রাহুল দেববর্মনের করা সুরে। বিস্ময়কর!

৯২ বছর বয়সে (৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২) শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন উপমহাদেশের কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী লতা মঙ্গেশকর। ১৯২৯ সালে ভারতের ইন্দোরে এক মারাঠি পরিবারে জন্ম। বাবা দীননাথ মঙ্গেশকর ও মা সুধামতীর জ্যেষ্ঠ সন্তান লতা মঙ্গেশকর। মাত্র ১৩ বছর বয়সেই বাবাকে হারিয়ে জীবনসংগ্রাম শুরু করেন প্রবাদপ্রতীম এ শিল্পী।

Advertisement

লতা মঙ্গেশকর গান গেয়েছেন ৩৬ ভাষায়, ৩০ হাজারের বেশি। হিন্দি ভাষায় গান গেয়েছেন সবচেয়ে বেশি। ১৮৫টির বেশি গেয়েছেন বাংলা গান। সুরের ঈশ্বরী যেন ভর করেছিলেন তাঁর কণ্ঠে। বাবা দীননাথ মঙ্গেশকরের হাত ধরে অভিনয় ও গানের জগতে পদার্পণ। জীবদ্দশায় প্রতিভাবান অনেক সুরকার-গীতিকারের আশীর্বাদ ও সান্নিধ্য পেয়েছেন। সি রামচন্দ্রন, মদনমোহন, নৌশাদ আলী, মুহম্মদ জহর খৈয়াম, হুসনলাল ভগতরাম, সলিল চৌধুরী, শচিন দেব বর্মণের মতো স্মরণীয় সংগীত পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করেছেন। গত আট দশকে সংগীত জগতের গীতিকার, সুরকার এমনকি শ্রোতাদের রুচি ও শ্রেণির বদল হয়েছে। কিন্তু তিনি ছিলেন গানের জগতের সুরসম্রাজ্ঞী। লতা মঙ্গেশকরকে নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে কবি ও গীতিকার জাভেদ আখতার বলেন, ‘যদি বিশ্বের সব সুগন্ধি, সব চাঁদের আলো আর সমস্ত মধু একসঙ্গে করা হয়, তারপরও তা লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠের মতো কিছু তৈরি হবে না।’ সহশিল্পী কিংবদন্তি মান্না দে বলেছিলেন, ‘লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে ঈশ্বর বাস করেন।’

তিনি ছিলেন বাঙালির স্বজন। মুক্তিযুদ্ধের সময় এক লাখ রুপি অনুদান দিয়েছিলেন বাংলাদেশের ফান্ডে। রুপি ছাড়াও ফান্ডের নামে লিখে দিয়েছিলেন সেদিন নিজের গাওয়া কিছু বিখ্যাত গানের রয়্যালিটি। যতদিন মুক্তিযুদ্ধ চলবে; ততদিন এসব গান থেকে প্রাপ্ত অর্থ জমা হবে ফান্ডে। শরণার্থী এবং আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র, চিকিৎসা সরঞ্জামের জন্য ছিল সে ফান্ড। ১৯৭১ সালে অজন্তা শিল্পীগোষ্ঠীর সঙ্গে ভারতীয় সেনাবাহিনীর উড়োজাহাজে চড়ে বিভিন্ন স্থানে গান পরিবেশন করে বাঙালি রিফিউজিদের জন্য তহবিলও সংগ্রহ করেন এ কিংবদন্তি। গড়ে তুলেছিলেন বাংলাদেশের জন্য বিশ্বব্যাপী গণসচেতনতা। ২০১৯ সালে করা এক টুইট বার্তায় সেসব দিনের কথা স্মরণ করেন তিনি।

সুরের সরস্বতী—এ বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি সরস্বতী পূজার পরদিন চলে গেলেন। লতা মঙ্গেশকরের চলে যাওয়া যেন জীবন্ত দেবীর বিসর্জন। প্রতিটি বিসর্জনের থাকে একটি নতুন যাত্রা। এ যাত্রা মহাকালের। এ যাত্রা যেন শেষ না হওয়া কেবলই প্রজন্মান্তরে বয়ে যাওয়া। তাঁর মৃত্যৃতে রুনা লায়লা শোকবার্তায় লেখেন, ‘গভীর এক নির্জনতা আর শূন্যতার মধ্যে ডুবে গেছি, যে কণ্ঠ আমার মতো লাখো শিল্পীর অনুপ্রেরণা ছিল, এখন সেই কণ্ঠ গাইবে স্বর্গের দূতদের জন্য।’

লতা মঙ্গেশকর নিজেই বলেছিলেন কোনো এক সাক্ষাৎকারে, ‘স্রষ্টা আমাকে পুনর্জন্ম না দিলেই ভালো। একটি জীবনই যথেষ্ট।’

Advertisement

এক জীবনেই লতা মঙ্গেশকর এ উপমহাদেশের সংস্কৃতির কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিলেন এবং সে ধারা বহমান থাকবে। সংগীত বিশ্বে চিরকালীন হয়ে থেকে যাবেন লতা মঙ্গেশকর। অনন্ত প্রহর আমাদের বলে যেতে হবে, আমরাও ছিলাম—চিরঞ্জীব লতাজীর সময়ে।

লেখক: গবেষক ও পরিবেশবিদ।

এসইউ/জিকেএস