শ্রী পবণ তির্গা (১০) ও সজিব তির্গা (১০) দুজনই আদিবাসী। উরাও সম্প্রদায়ে দুই শিক্ষার্থী। পড়ালেখা করে দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলার সীমান্তঘেঁষা কাটলা ইউনিয়নের রামচন্দ্রপুর আদিবাসী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বিদ্যালয়ের নাম আদিবাসী হলেও সেখানে শিশুদের পড়ানো হয় বাংলা ভাষার পাঠ্যবই।
Advertisement
শুধু আদিবাসী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নয়; ওই এলাকার সব প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে আদিবাসী শিক্ষার্থীরা অনেকটা বাধ্য হয়েই হিন্দু অথবা খ্রিস্টান ধর্মের বই পড়ে। এতে করে তারা নিজ ধর্মের বিষয়ে অনেক কিছুই জানতে পারছে না বলে দাবি অভিভাবদের।
বিদ্যালয়ে নিজের ভাষায় না পড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষার্থীরা জানায়, বাড়িতে বাবা, মায়ের সঙ্গে আদিবাসী ভাষায় কথা বলি, কিন্তু বিদ্যালয়ে গিয়ে সমবয়সী অনেক শিশু থাকলেও সে ভাষায় কথা বলতে পারি না। বাংলা ভাষা আয়ত্ব করতে অনেক কষ্ট হয়। আমাদের জন্য আলাদা শিক্ষকের ব্যবস্থা নেই। নিজ ভাষার পাঠ্যবই থাকলে ভালো হতো।
ওই দুই শিশুর অভিভাবকরা জানান, নিজ ভাষায় পড়ার সুযোগ না পেয়ে বাধ্য হয়ে আমাদের সন্তানদের বাংলা পড়তে হচ্ছে। এছাড়াও ধর্মের বই হিসেবে খ্রিস্টান ধর্মের বই পড়তে হচ্ছে তাদের। ফলে আমাদের ধর্মের বিষয়ে শিশুরা জানছে না। যারা বাংলা ভাষায় লেখাপড়া শেষ করে তারাও নিজ ভাষা সমৃদ্ধের তেমন সুযোগ পায় না। এতে আবার অনেক শিশুই প্রাথমিকে ঝরে যায়। ভাষা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে দ্রুত পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ও শিক্ষক নিয়োগের মাধ্যমে শিক্ষাদান জরুরি বলে মনে করেন তারা।
Advertisement
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উত্তরের জেলা দিনাজপুরের বিরামপুর, নবাবগঞ্জ, হাকিমপুর ও ঘোড়াঘাট উপজেলায় সবচেয়ে বেশি আদিবাসী নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর জনগণ বাস করেন। সম্প্রতি এক জরিপে দেখা গেছে এই চার উপজেলায় প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর লোকের বাস। এই এলাকায় বসবাসরত মুসলিম, হিন্দু ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের জন্য আলাদা ধর্মের পাঠ্যবই থাকলেও কোনো বিদ্যালয়ে আদিবাসী শিশুদের নিজের ভাষার পাঠ্যবই পড়ানো হয় না।
তথ্য বলছে, এই এলাকায় প্রায় ৬ থেকে ৭টি নৃ-গোষ্ঠীর লোকেরা বাস করেন। তাদের মধ্যে সাঁওতাল, উরাও, মাহাতো, মাহালি, মুচি সম্প্রদায় অন্যতম। এখানকার আদিবাসী শিশুরা প্রাথমিক পর্যায় থেকেই নিজ ভাষায় বই পড়ার সুযোগ পায় না। কোনো বিদ্যালয়েই নেই ওই ভাষার পাঠ্যপুস্তক বা শিক্ষক।
চার উপজেলা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, উপজেলায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে ৪২১টি এবং কেজি স্কুল রয়েছে প্রায় ৭০টি। এছাড়াও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ মিলিয়ে প্রায় ২০০ প্রতিষ্ঠান আছে। শুধু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আদিবাসী শিক্ষার্থী রয়েছে প্রায় ৪ হাজার ৫ শ।
বিরামপুর উপজেলা আদিবাসী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস মুর্মু বলেন, প্রতিটি জাতির যেমন আলাদা আলাদা ভাষা রয়েছে তেমনি আদিবাসীদেরও নিজস্ব ভাষা রয়েছে। কিন্তু আদিবাসী হয়েও আমাদের সন্তানরা বাংলা ভাষায় পড়ছে। বিদ্যালয়ে নিজ ভাষায় পড়ালেখার তেমন সুযোগ পায় না। প্রাথমিক থেকেই আমাদের শিশুদের জন্য নিজ মাতৃভাষার পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করে শিক্ষা দেওয়া জরুরি। এছাড়াও প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত প্রতিটি বিদ্যালয়ে নৃ-গোষ্ঠী থেকে শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে পাঠদান করলে শিশুরা প্রাথমিক থেকেই নিজের ভাষা আয়ত্ব করতে পারবে।
Advertisement
জানতে চাইলে বিরামপুর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মিনারা পারভিন বলেন, উপজেলায় ১১৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ প্রায় ‘শ’ খানেক বেসরকারি বিদ্যালয় রয়েছে। আমাদের এই এলাকায় আদিবাসী শিশুদের জন্য আলাদা কোনো পাঠ্যপুস্তক নেই এবং আলাদাভাবে তাদের শিক্ষক নেই। আমার জানামতে তারা খ্রিস্টান ধর্মের বই পড়ে। তাদের জন্য আলাদা ভাষা শিক্ষার যদি কোনো সুযোগ থাকে তাহলে বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে।
জানতে চাইলে বিরামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পরিমল কুমার সরকার বলেন, আমার জানামতে উপজেলায় আদিবাসী শিশুদের তাদের নিজস্ব ভাষা শেখার কোনো প্রতিষ্ঠান নেই বা পাঠ্যপুস্তক নেই। এ বিষয়টি নিয়ে আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করবো। আগামীতে তারা যেন নিজের ভাষার বই পায় সেই বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে চেষ্টা করব।
এফএ/এমএস