ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা নির্বাচন কমিশন নিয়ে। এটা ৫০ বছরের ধারাবাহিকতা। দু-একটি ছাড়া প্রায় সব কমিশনের ভাগ্যেই বিতর্ক জুটেছে। কিন্তু সর্বশেষ কমিশনের নিজেদের মধ্যেই বিভাজন এবং নিজেদের মধ্যেই যেভাবে বিতর্ক প্রকাশ্যে এসেছে তা বোধকরি আগের ১১টি কমিশনের সব রেকর্ড ভেঙেছে। এমন বিভাজন দৃশ্য দেখতে দেখতেই বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে ১৪ ফেব্রুয়ারি।
Advertisement
সার্চ কমিটি গঠন হয়েছে এই নিবন্ধ লেখাকালে সার্চ কমিটির প্রথম বৈঠক চলছে, হয়তো প্রকাশের আগে কিংবা কাছাকাছি সময়ই নতুন কমিশনও গঠন হয়ে যেতে পারে। কিন্তু আগামী কমিশনও যে একবারে বিতর্কের বাইরে থাকবে এমনটা আগাম বলার সুযোগ নেই। তবে আলামত বলে, বিতর্ক থাকবে। হয়তো মাহবুব তালুকদারের মতো ‘নীরব জনতার মুখপাত্র’ (প্রথম আলো ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২২) নাও থাকতে পারেন। তবে সেটা হলফ করে বলা যায় না।
আমাদের এখানকার রাজনৈতিক পরিবেশের কারণেই নির্বাচন কমিশন নিয়ে এত হইচই হয়। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অসহিষ্ণুতা নির্বাচন কমিশনে প্রতিফলিত হয়। জনমত উপেক্ষা করে হলেও ক্ষমতারোহণের আকাঙ্ক্ষাই মূলত নির্বাচন কমিশনকে বিতর্কিত করার ক্ষেত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হলেও তার সৃষ্টি হয় রাজনৈতিক আবহে। প্রকারান্তরে সরকারের মাধ্যমে। বিতর্ক হতে পারে এই মন্তব্যে। ঘুরিয়ে যতই বলা হোক না কেন, এটাই সত্য। ৫০ বছর পর যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন ২০২২ প্রণয়ন হলো সেখানেও কি রাজনৈতিক সরকারের হস্তক্ষেপ বন্ধ করার কোনো সুযোগ আছে?
Advertisement
আগে হয়েছে কর্তার ইচ্ছায় কীর্তন এখন হবে আইনের খোলসে। তার মানে হচ্ছে-সরকার যদি চায় একটা নিরপেক্ষ কমিশন গঠিত হবে, তখনই সেটা সম্ভব। আমাদের দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস বলে, আমরা ক্ষমতাকে শক্তির বলয়ে নিয়ে এসেছি। কখনো সামরিক ফরমান বলে কখনো নির্বাচিত সরকার মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠন হয়েছে শাসকদেরই ইচ্ছা পূরণের প্রতিভু হিসেবে।
সংবিধানে উল্লেখ থাকার পরও আইন প্রণয়ন করতেই লেগে গেছে ৫০ বছর। যদিও রাজনৈতিক দলগুলো তাদের এই ব্যর্থতাকে জায়েজ করার জন্য নানা কৌশল অবলম্বন করতেও কসুর করে না। এখনকার সরকার একটি আইন শেষ পর্যন্ত করতে পেরেছে। কিন্তু রাজনৈতিক মতৈক্য প্রতিষ্ঠা হয়নি এই আইন নিয়ে। তারপরও যদি বলা হয়, নতুন নির্বাচন কমিশন যদি আন্তরিক হয় তাহলে হয়তো সঠিক ভূমিকা পালন করতেও সক্ষম হবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভেদ থাকতে পারে সেই হিসেবে সরকারের সহযোগিতায় গঠিত নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে ক্ষমতার বাইরে থাকা দলগুলোর কাছে অপছন্দেরও হতে পারে। তারা সমালোচনাও করতে পারেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, অনেক ক্ষমতাধর নির্বাচন কমিশন কি নির্বাচন ব্যবস্থাপনাকে স্বীয় ক্ষমতাবলে অধিকতর গ্রহণযোগ্য করতে পারেন না?
আমাদের এখানকার ইতিহাস ভিন্নতর। সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান নুরুল ইসলাম সাহেবকে সিইসি নিয়োগ করেছিলেন-নিজের প্রয়োজন মেটাতে। তৎকালীন সিইসি নুরুল ইসলাম জিয়ার হ্যাঁ-না ভোট উপহার দিয়ে নিজের নামটি বিতর্কের তালিকায় স্থায়ী করেছিলেন।
Advertisement
একইভাবে এম এ আজিজ প্রায় সোয়া কোটি ভুয়া ভোটার তালিকাভুক্ত করে নির্বাচন ব্যবস্থায় কলঙ্কের দাগ ফেলেছেন। আসলে প্রতিটি নির্বাচন কমিশনকেই রাজনৈতিক দলগুলোর কারও না কারও তীব্র সমালোচানার মুখে পড়তে হয়েছে। কখনো নির্বাচন কমিশনের নিজেদের ব্যর্থতার কারণে কখনো রাজনৈতিক কারণে।
অথচ ভারতের দিকে যদি তাকাই, দেখতে পাবো একজন টি এন সেসন ভারতের নির্বাচন কমিশনের ইতিহাসে এমন শক্ত ভিত তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন, যাকে রাজনৈতিক সমালোচনার ঝড়ও বাঁকা করতে পারে না। অথচ এই টি এন সেসনও সেখানকার রাজনৈতিক সরকার আমলেই গঠিত হয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়া এবং ভারতের নির্বাচন কমিশন গঠনের আইনি কাঠামোও প্রায় একই।
ভারতের সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার টি এন সেসনকে নির্বাচন ব্যবস্থাপনায় চেঞ্জমেকার আখ্যায়িত করা হয়েছেন। আর এই চেঞ্জমেকারটিকে সে দেশের প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশের ওপর ভিত্তি করে ওখানকার রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করেছিলেন। আমাদের এখানকার নির্বাচন কমিশন আইনে রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতা দিলেও সার্চ কমিটির সহযোগিতার স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। বরং বলা চলে এখানে রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্ত গ্রহণকালেও সহযোগিতা নেওয়াটা আইনিভাবে প্রতিষ্ঠিত হলো নতুন আইন মাধ্যমে। এদিক থেকে বলা যায় আমাদের আইনগত কাঠামো ভারতের তুলনায় এগিয়ে।
অথচ নিউজিল্যান্ড কিংবা অস্ট্রেলিয়ায় গভর্নর জেনারেলরা একক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করন। সেই অর্থে আমাদের দেশে রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্ত গ্রহণেও সহযোগিতা করার জন্য সার্চ কমিটি গঠনের সুযোগ রাখা হয়েছে। সবদিক বিবেচনা করে বলা যায়, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ আইনি দিক দিয়ে অগ্রসর। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তারপরও সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থা আমাদের এখানে নেই কেন? যারা মনে করেন, নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন পরিচালনা করতে হবে তাদেরও যুক্তি কতটা গ্রহণযোগ্য।
অন্তত এই মুহূর্তে নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে যখন তোড়জোড় চলছে, তখনও একটি বড় রাজনৈতিক দল তাকে গুরুত্ব না দিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার বিষয়ে সোচ্চার। অথচ তাদের জোর দেওয়ার কথা ছিল নির্বাচন কমিশনকে কীভাবে শক্তিশালী করা যায়, তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়ার ক্ষেত্র কীভাবে তৈরি হয় সেদিকে নজর দেওয়া।
সংবিধান, আইন নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা দিয়েছে যথেষ্ট, তা যথাযথ প্রয়োগ না করার দায় তাদেরই। যারা বলেন ভারতের টি এন সেসন ভারতের সরকারগুলোর কাছ থেকে শুধু সহযোগিতাই পেয়েছে, তারা হয়তো ভুলে যান, তাকে রাজনৈতিক চাপ থেকে শুরু করে আদালতেও যেতে হয়েছে। তারপরও নিজের সিদ্ধান্ত থেকে তিনি এক চুলও সরে আসেননি।
অন্যদিকে সেসন যখন সিইসি হয়েছিলেন, তখন ভারতে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছিল। চন্দ্রশেখর ভিপি সিং আমলের কথা নিশ্চয়ই আমাদের মনে আছে। একদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছিল অন্যদিকে তাকে মধ্যবর্তী নির্বাচন করতে হয়েছিল। সেসনের কর্মকালে কিংবা আগে ও পরে কখনো ভারতে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়নি। যারা কথায় কথায় সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের পূর্বশর্ত হিসেবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলেন, তারা হয়তো এদিকটি খেয়াল করেননি।
আসলে সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনার প্রথম শর্ত হচ্ছে শক্ত মেরুদণ্ডসমেত নির্বাচন কমিশন-যারা রাজনৈতিক প্রভাবকে পাশ কাটানোর ক্ষমতা রাখেন। যেমনি টি এন সেসন রেখেছিলেন। তিনি তো সরকারের নিরাপত্তা সহযোগিতা প্রসঙ্গে মতভেদের কারণে নির্বাচন স্থগিত করার উদাহরণও তৈরি করেছিলেন।
তাকে এ বিষয়ে আদালতেও যেতে হয়েছে। কিন্তু সে দেশের আদালত সিইসির সিদ্ধান্তকেই সঠিক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি ঠিকই সরকারের কাছ থেকে সহযোগিতা আদায় করে ছেড়েছেন। এখানে প্রমাণ হয় সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন কমিশনকে কাজ করতে দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজন অনুযায়ী আদালতের ভূমিকাও আছে।
বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করতে হলে তাই এমন একজন ব্যক্তির প্রয়োজন যিনি সংবিধান ও আইনের প্রতি নিবেদিত থাকবেন। নিজের প্রয়োজনীয় ক্ষমতা প্রয়োগে কখনো কারও মুখের দিকে তাকাবেন না। কারও অনুরোধে সোয়া কোটি ভুয়া ভোটার বানানোর মতো গর্হিত কাজ করবেন না। প্রয়োজনে প্রশাসনকে কমিশনের অধীনে আনার ব্যবস্থা করবেন।
তেমন হলে রাজনৈতিক শক্তি কিংবা সমালোচনাও সহনীয় পর্যায়ে চলে আসবে। এই নিবন্ধ লেখাকালে সার্চ কমিটির বৈঠক হচ্ছে, তারা এমনই শক্তিশালী কাউকে নতুন সিইসি মনোনয়ন দেবে আশা করতে অসুবিধা নেই। তারা নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে নাম প্রস্তাব আহ্বান করেছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর দু-একটি রাষ্ট্রপতি আহুত সংলাপেও অংশগ্রহণ করেনি।
তাদের এ সিদ্ধান্ত রাজনৈতিকভাবে কতটা সুবিধা বয়ে আনবে তা দেখার বিষয়। তবে নিষ্ক্রিয়তা যে ব্যর্থতা মেনে নেওয়ার মতোই তা বোধকরি বলার অপেক্ষা রাখে না। অনুসন্ধান কমিটির আহ্বানে যদি তারা সাড়া না দেন তাহলে হয়তো নির্বাচন কমিশন গঠনে প্রভাব ফেলবে না। কিন্তু নিজেদের মতামত প্রকাশের সুযোগটি হাতছাড়া হয়ে যাবে।
নির্বাচন কমিশন গঠনে ক্ষমতায় থাকা কিংবা ক্ষমতার বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা রয়েছে, তাই তারা সেই সুযোগটি গ্রহণ করলেই ভালো। যদি না-ও করে তারপরও অনুসন্ধান কমিটিকে নির্মোহ থেকে মনোনয়নগুলো দিতে হবে। যাতে বাংলাদেশ একজন চেঞ্জমেকার পেতে পারে।
লেখক: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।
এইচআর/ফারুক/এমএস