অতি সম্প্রতি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দেশব্যাপী আলোচিত হয়েছে। নারী শিক্ষার্থীদের হল সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান নিয়ে উপাচার্যের সাথে আলোচনা ফলপ্রসূ না হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্র আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছিল সেখানে। পরবর্তীতে সেই আন্দোলন উপাচার্যের পদত্যাগের একদফা দাবিতে পরিণত হয়েছিল।
Advertisement
শিক্ষার্থীরা অনশন অব্যাহত রাখলে সরকারি হস্তক্ষেপে এবং সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক প্রফেসর জাফর ইকবাল স্যারের অনুরোধে শিক্ষার্থীরা অনশন ভাঙতে রাজি হয়। সেই সময়ে এই আন্দোলন নিয়ে বিভিন্ন ধরনের কথাবার্তা হয়েছে। অনেকেই উপাচার্যের মনোভাবকে এ আন্দোলনের জন্য দায়ী করেছেন।
আবার অনেকেই শিক্ষার্থীদের দোষারোপ করার চেষ্টা করছে। এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো উপসংহারে পৌঁছানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ আমি সেই জায়গায় ছিলাম না। তবে পত্রপত্রিকার মাধ্যমে যেটা জেনেছিলাম সেটি হচ্ছে প্রশাসনের পক্ষ থেকে আরেকটি সচেতন আচরণ করা গেলে হয়তো এ আন্দোলন কখনই দানা বেঁধে উঠত না। যে কারণেই ঘটনা ঘটুক না কেন সেখানে পরিস্থিতি বর্তমানে শান্ত-এটিই সবচেয়ে স্বস্তির খবর। সরকার এবং সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষামন্ত্রী অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে বিষয়টি বিবেচনা করবেন বলেই আমাদের বিশ্বাস।
গত ১ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হবিবুর রহমান হলের সামনের রাস্তায় পাথরভর্তি ট্রাকের ধাক্কায় মোটরসাইকেল আরোহী গ্রাফিক ডিজাইন, ক্রাফটস অ্যান্ড হিস্ট্রি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মাহমুদ হাবিব হিমেলের নিহত হওয়ার ঘটনা শিক্ষার্থীসহ বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সবাইকে মর্মাহত করেছে। এ ঘটনায় আরেকজন ছাত্র আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাধীন। এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা কখনোই কাম্য হতে পারে না। একজন শিক্ষার্থী যে এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডিই পেরোতে পারেনি, তার এ অকাল প্রয়াণ সবাইকে ব্যথিত করেছে।
Advertisement
শিক্ষার্থীদের আবেগের সাথে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হিসেবে এবং সন্তানের অভিভাবক হিসেবে আমিও একই রকম ভাবে ব্যথিত হয়েছি। দুর্ঘটনা ঘটার অব্যবহিত পরই শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ প্রদর্শন শুরু করে, যা ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া; কারণ তারা কেউ তাদের ভাইকে হারিয়েছে, আবার কেউ তাদের বন্ধুকে হারিয়েছি। স্বজন হারানোর বেদনা যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে, যারা স্বজন হারায়নি তারা সেটা বুঝতে পারবে না। সেই প্রেক্ষাপট থেকে বিচার করলে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ প্রদর্শন করা ছিল অত্যন্ত যৌক্তিক।
তবে শিক্ষার্থীদের সেই আবেগকে খুব সচেতনভাবে প্রশমিত করার চেষ্টা করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য প্রফেসর গোলাম সাব্বির সাত্তার। আমরা প্রায়ই দেখি যে, উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোনো ঘটনা ঘটলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধান প্রথমে নিজে ঘটনাস্থলে না গিয়ে প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের পাঠান এবং সাথে সাথে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের প্রেরণ করেন।
পরিস্থিতি খুব খারাপ আকার ধারণ করলে তবেই তিনি সেই স্থানে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু এ ঘটনায় আমরা পুরো একটা উল্টো চিত্র প্রত্যক্ষ করেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রথম থেকেই নিজে দুর্ঘটনার স্থানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি পুলিশকে সেই স্পট থেকে দূরে রেখেছিলেন। এমনকি তার বাসভবনে অবস্থানরত পুলিশদের গেটের ভেতরে রেখে তিনি নিজে ছাত্রদের সাথে কথা বলেছেন। শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো বিবেচনায় নিয়ে বাস্তবায়নের আশ্বাস দিয়েছেন।
এরই ধারাবাহিকতায় শিক্ষার্থীরা এক সময় কিছুটা হলেও তাদের অনড় অবস্থান পরিবর্তন করে এবং মরদেহ দুর্ঘটনার স্থান থেকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়। পরে তিনি নিজেও রাজশাহী মেডিকেল কলেজে যান গভীর রাতে। পরে শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে হিমেলের জানাজা সম্পন্ন করে নিজে লাশবাহী গাড়ির সাথে নাটোরে গমন করেন হিমেলের মরদেহ পৌঁছে দেওয়ার জন্য।
Advertisement
রাতের এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যে জিনিসটি আমার কাছে মনে হয়েছে সেটি হচ্ছে শিক্ষার্থীদের এ ধরনের বিক্ষোভ হ্যান্ডেল করতে হলে উপাচার্যের নেতৃত্ব এবং শিক্ষার্থীবান্ধব মনোভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে উপাচার্যদের পুলিশকে ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ দমন করতে দেখেছি। এতে হিতে বিপরীত হয়। পুলিশ যখন শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হয় তখন শিক্ষার্থীরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এটিই আমাদের তরুণ সমাজের মূল বৈশিষ্ট্য।
১৯৯০ সালে জেনারেল এরশাদ শিক্ষার্থীদের ওপর যত দমন-পীড়ন করেছে আন্দোলন আরও দানা বেঁধেছে। ফলে শিক্ষার্থীবান্ধব চিন্তাভাবনা নিয়ে উপাচার্যরা যদি সমস্যার সমাধান করতে চান তাহলে সমস্যা খুব বেশি দূরে যায় না এবং সমস্যা গভীর সমস্যায় পরিণত হয় না। শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে উপাচার্য তার প্রক্টরকে অপসারণ করেছেন, যা শিক্ষার্থীদের কিছুটা হলেও সন্তুষ্ট করেছে।
কারণ তাদের কয়েকটি দাবির মধ্যে প্রক্টরিয়াল বডির পদত্যাগের দাবি ছিল অন্যতম। এ ঘটনায় প্রক্টর কতটুকু দায়ী বা দায়ী নয় সে বিচার করার সময় ওই দিন রাতে ছিল না। উপাচার্য মহোদয় সঠিকভাবেই তাদের দাবির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ কিছুটা হলেও শান্ত করার চেষ্টা করেছেন।
আমাদের মাথায় রাখতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সাথে জড়িত কেউই এ ধরনের কোনো দুর্ঘটনা কামনা করেন না। ওই দিনের ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা তো অবশ্যই নয়। আমরা জানি যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে অনেকগুলো উন্নয়ন প্রকল্প পরিচালিত হচ্ছে। ফলে উন্নয়ন প্রকল্পের উপকরণ- যেমন বালি, ইট, পাথরসহ অন্যান্য সামগ্রী বহন করার জন্য ক্যাম্পাসের মধ্যে বিভিন্ন রাস্তায় ট্রাক চলাচল করে।
যদিও প্যারিস রোড ছাড়া অন্য রাস্তাগুলো তেমন প্রশস্ত নয়। ফলে এখন সময় এসেছে এ ঘটনা থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন করে কীভাবে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা কমানো যায় সে বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করার। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে বর্তমান উপাচার্য যে ভাবে শিক্ষার্থীদের দাবির সাথে নিজের মনোভাবকে মিলিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছেন তার পক্ষেই সম্ভব আগামী দিনে এ ধরনের ঘটনা ঘটা বন্ধ করা। দায়িত্ব নেওয়ার পরে তিনি বেশকিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন, যেগুলোর মাধ্যমে তার শিক্ষার্থীবান্ধব মানসিকতার ফুটে উঠেছে।
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য একদিকে যেমন প্রয়োজন উপাচার্যের অ্যাকাডেমিক এক্সেলেন্স, ঠিক একইভাবে শিক্ষার্থীদের পরিচালনার জন্য দরকার শিক্ষার্থীবান্ধব মনোভাব। অ্যাকাডেমিক এক্সেলেন্স না থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়কে পঠন-পাঠন এবং গবেষণার উচ্চ শিখরে যেমন নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, ঠিক তেমনি শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ কিংবা তাদের অসন্তোষ দূর করার জন্য উপাচার্য যদি নিজের মানসিকতায় পরিবর্তন না নিয়ে আসেন সেক্ষেত্রেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য একদিকে যেমন একাডেমিক বিষয়গুলোকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে চলছেন, ঠিক তেমনি তার শিক্ষার্থীবান্ধব মনোভাব এবং নেতৃত্বের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারে সবার সহাবস্থান নিশ্চিত করার চেষ্টা করছেন। এ দুইয়ের সমন্বয়ের মাধ্যমেই প্রকৃতপক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে যাবে।
আমাদের মাথায় রাখতে হবে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ। শিক্ষার্থীরা না থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় চলবে না। অতএব শিক্ষার্থীদের দুঃখ, বেদনা, আবেগ কিংবা হতাশার বিষয়গুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক হিসেবে উপাচার্য মহোদয় যদি সঠিকভাবে অনুধাবন করতে না পারেন তবে সেখানে শিক্ষার্থীরা কখনোই ভালোভাবে অবস্থান করতে পারবে না।
সার্বিক বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য শিক্ষার্থীবান্ধব মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন বিধায় তিনি সাধুবাদ পাওয়ার দাবি রাখেন। আমরা আশা করব এ ঘটনা থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের দুঃখজনক ঘটনা আর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে না ঘটে সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
হিমেলের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তার পরিবার যে কষ্ট ভোগ করবে সে কষ্ট লাঘব করার কোনো উপায় নেই আমাদের কাছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের উচিত হিমেলের পরিবারের পাশে দাঁড়ানো। সন্তান হারানো মায়ের বেদনা অবশ্যই কমানো যাবে না। তবে এই দুর্দিনে হিমেলের মায়ের পাশে দাঁড়ালে তার মা একদিকে যেমন মানসিকভাবে শক্তি পাবে, তেমনি হিমেলের বন্ধু-বান্ধবরা শান্তি পাবে।
পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উচিত পুলিশ প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ রেখে ট্রাকের ঘাতক ড্রাইভার এবং হেলপারকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা। এটা করা গেলে হিমেলের আত্মা যেমন শান্তি পাবে, ঠিক তেমনি তার পরিবারের সদস্যরা স্বস্তি পাবে।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের প্রফেসর।
এইচআর/ফারুক/এমএস