জার্মানি মানে মনে হতে পারে যুদ্ধবাজ একটা জাতি। যুদ্ধ করা তাদের ধর্ম! দুই দুইটা বিশ্বযুদ্ধ করলো এই জাতি। দুইটা বিশ্বযুদ্ধের পরেই বদলে গেছে জাতিটি, বদলে দিয়েছে ইউরোপকে। শুরুর দিকে যখন কোরিয়া থেকে জার্মানি আসি তখন আমার কাছে কিছু কিছু বিষয় জটিল ও কঠিন মনে হয়েছে।
Advertisement
তাদের আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রিতা অনেক ক্ষেত্রে অধৈর্য্য করে তোলে। কিন্তু কিছু প্রতিবন্ধকতার পরেও ইউরোপের ক্রাইসিস ম্যানেজারখ্যাত দেশটি ধীরে ধীরে ভালো লাগতে শুরু করে। সত্যিকার অর্থে উচ্চমান ডিগ্রি, চাকরি আর নিরাপদ, বর্ণিল জীবন-এসব বিবেচনা করে আপনিও হয়ত একটা সময় জার্মানিতে থেকে যেতে চাইবেন না।
সবকিছু মিলিয়ে জার্মানির নানাবিধ মুগ্ধকর সুন্দর দিকগুলোর প্রেমে পড়বেন। যেমনটি বলছিলাম, আমার কাছে মনে হয় স্পষ্টভাষী, নিয়ম শৃঙ্খলা ও সময়ানুবর্তিতার প্যারামিটার এই জাতি। জীবনের প্রতিটি পরতে তারা সুশৃঙ্খল, পরিমিত ও নিয়মপ্রেমী।
তারা বিশ্বাস করেন নিয়ম মানলে কেউ পাবে নিয়ম না মানলে কেউ পাবে না। চাইলে আপনি এদেশে অত্যাধিক টাকার মালিক হতে পারবেন না। তবে আপনাকে নিশ্চয়তা দেবে সুন্দর, সুষম, সজীব, নিরাপদ জীবনের। জার্মানদের সঙ্গে কাজ করে গত দেড় বছরে দেখেছি, তারা কথা বলে কম, কাজ করে দ্রুত।
Advertisement
জার্মানদের প্রতিটি সেক্টরে দেখবেন সুপরিকল্পনা, সুপ্রেষণো, সুসংগঠিত ধারণা। উন্নত বিশ্বের প্রতিটি দেশের মানুষই রিয়েক্ট কম করেন। অ্যাক্ট করেন বেশি। সত্য ও ধ্রুবকথা হলো তারা চোখে চোখ রেখে কথা বলে, যা সত্যতা বলে, ইনিয়ে-বিনিয়ে কিছু বলে না। উচিত ও যুক্তিপূর্ণ কথাও মুখের ওপর বলে দেয়, উচিত কথা বলতে রক্ত সম্পর্কিত কাউকে ছাড়ে না।
এক্ষেত্রে কে ইউরোপিয়ান কে নন- ইউরোপিয়ান তা তোয়াক্কা করে না। বস্তুতপক্ষে তারা প্রতিক্রিয়া দেখায় না, কিন্তু কর্ম করে বাস্তবে তা রূপ দেয়। সবকিছুতেই যুক্তি খোঁজে। যুক্তিকে সমীহ করে, যুক্তিকে লালন করে, যুক্তিকে ধারণ করে পুরো জাতি, সমাজ, রাষ্ট্র। সেকেন্ড, মিনিট শুধু গণনা করে না। সময়ের প্রাণখোলা মূল্য দেয়।
তারা ব্যক্তি, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় জীবনে ন্যানো সেকেন্ডের মূল্য দেয়। সময়ের মূল্য দেয় বলে পুরো ইউরোপের ভ্যানগার্ড এই জার্মানি। জার্মানিতে একটি প্রবাদ আছে, চোখ নিজেকে বিশ্বাস করে, কান বিশ্বাস করে অন্যকে। তারা কোনো কিছুতে হার মানতে নারাজ। সত্যিই তাই।
জার্মানরা বিস্ময়ের, মুগ্ধতার, ইউরোপের এই দেশটি পুরো ইউরোপের ড্রাইভিং ফোর্স কীভাবে হলো? এই গল্পের পেছনের মূল মন্ত্র হলো নিয়ম মানা, আর যুক্তি দিয়ে সঠিক কাজটি করা, সময়ের কাজ সময়ে শেষ করা। মোদ্দা কথা, ক্রাইসিসে ঘুরে দাঁড়ানো এই জাতি। দুইটি বিশ্বযুদ্ধ শুধু করেনি, সাহসিকতা সঙ্গে বিশ্বকে পরিচালনা করতে চেয়েছে।
Advertisement
বছরের পর বছর ধরে যেন সবকিছুতেই বৈশ্বিক নজরে। জার্মানরা মডেল গাড়ি শুধু বানায় না, অনুকরণীয় ফুটবল খেলে। শিক্ষা উন্মুক্ত, উন্মুক্ত শিক্ষার বিকিকিনি হচ্ছে প্রতিটি রাজ্য। গবেষণায়, সার্ভিসে দারুণ পেশাদারত্ব। নিয়মানুবর্তিতায় অনন্য। নিয়ম শুধু নিজে মানে না অন্যদের মানতে উদ্বুদ্ধ করে। পরিবার ও বিদ্যালয় থেকে তা শিক্ষা দেওয়া হয়।
এই দেশ যেন শ্রেষ্ঠত্বে প্রতিযোগিতা দেয়, যেন শ্রেষ্ঠ বানায়। এই দেশের আছে জগৎখ্যাত আবিষ্কারক, গণিতজ্ঞ, ফুটবলার। তারা শৈল্পিক ফুটবলে শুধু অনন্য নই মেধায়, শৃঙ্খলায়ও অনন্য। বিশ্বের অন্যদেশগুলোর চেয়ে অগ্রসারিতে অবস্থান। ঐশ্বর্যে ইউরোপের রাজা। নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান শুধু গড়ছে না, বিশ্ব তাক লাগানো আইডিয়া দিচ্ছে, সেজন্য জার্মানিকে বলা হয় ল্যান্ড অব আইডিয়ার দেশ।
এই দেশের মেধাবীরা দারুণ দারুণ আইডিয়া প্রস্রব করে। তা বাস্তবায়ন করে। বিশ্বকে উপকৃত করছে। শান্ত, নীরব জাতি হিসেবে বর্তমানে স্বীকৃত। বর্তমানে বিশ্ব রাজনীতিতেও মধ্যমনীতি অনুসরণ করে। প্রাণোচ্ছল, সৃষ্টিশীল, উৎপাদনমুখী যে অর্থনীতি দাঁড় করিয়েছে তা অবিশ্বাস্য। এর অনবদ্য কারণ হচ্ছে রাষ্ট্র যোগ্য, মেধাবী, সৃষ্টিশীল মানুষদের লালন করে। প্রাণখোলা সহযোগিতা করে।
ওমর ফারুক হিমেল, লেখক-সাংবাদিক
এমআরএম/এএসএম