বিশেষ প্রতিবেদন

প্রচারবিমুখ দানবীর লন্ডন প্রবাসী ডা. আবুল হোসেন

‘এ জগতে হায় সেই বেশি চায়, যার আছে ভুরি ভুরি, রাজার হস্ত করে কাঙ্গালের ধন চুরি’ বহুল প্রচলিত এ প্রবাদটি কমবেশি সবারই জানা। এ সমাজে যার হাজার টাকা আছে সে লাখপতি হতে চান, যার লাখ টাকা আছে তিনি কোটিপতি আর কোটিপতি আরো অনেক অর্থবিত্ত-বৈভবের মালিক হতে চান এমনটাই অধিকাংশ মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বলে ধরে নেয়া হয়।কিন্তু প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় এ সমাজেই ব্যতিক্রমও ব্যক্তিত্ব রয়েছেন! তারা সংখ্যায় খুব বেশি না হলেও অনন্য চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী এ সকল ব্যক্তিরা অকাতরে জীবনের সব উপার্জন সাধারণ মানুষের মাঝে বিলিয়ে দিয়ে মানসিক প্রশান্তি খুঁজে বেড়ান। এ রকম ব্যতিক্রমধর্মী মানুষদেরই একজন লন্ডন প্রবাসী রাজবাড়ি জেলার ভবদিয়া গ্রামের এক কালের বাসিন্দা ৮৬ বছর বয়সি ডা. মো. আবুল হোসেন। গত ৫০ বছরেরও বেশি সময় যাবত লন্ডনে বসবাস করছেন তিনি। প্রবাসে দিনাতিপাত করলেও জন্মভূমির সাধারণ মানুষের কথা এক মুহূর্তের জন্যও ভুলে যাননি তিনি। আর তাইতো প্রায় প্রতিবছরই দেশে এসে গরিব দুঃখী মানুষকে অকাতরে আর্থিক সহায়তা প্রদান করেন ডা. মো. আবুল হোসেন।ব্যক্তিগত উদ্যোগে সাধারণ মানুষের জন্য ভবদিয়া গ্রাম ও রাজবাড়ি শহরে স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিমখানা, শিশু সদন, ঈদগাহ, কবরস্থান, জাদুঘর, স্পোটর্স একাডেমি, ছাত্রী হোস্টেলসহ কত কিছুইনা স্থাপন করেছেন তিনি। প্রচারবিমুখ ডা. আবুল হোসেন গত সপ্তাহেও প্রায় ১১ একর জমিসহ আনুমানিক ৩০ কোটি টাকা মূল্যের সম্পত্তি সাধারণ মানুষের কল্যাণে ট্রাষ্ট গঠন করে দান করে দিয়েছেন। ট্রাষ্টের ব্যয় নির্মাণের জন্য ২০ লাখ টাকার ফিক্সড ডিপোজিট করে দেন তিনি। এছাড়া ট্রাষ্টের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য রাজবাড়ি জেলার ডিসিকে সভাপতি করে ১৫ সদস্যের একটি কমিটি করে দিয়েছেন। তার প্রত্যাশা দায়িত্বপ্রাপ্ত ডিসি ট্রাষ্টের কার্যক্রম সুচারুভাবে পরিচালনায় সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাবেন।  বৃহস্পতিবার রাতে জাগো নিউজের এ প্রতিবেদকের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত সাক্ষাতকারে ডা. আবুল হোসেন খোলামেলাভাবে তার জীবনের কিছু স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন।জানা যায়, রাজবাড়ি জেলা থেকে মাইল তিনেক দূরে ভবদিয়া গ্রামের মরহুম আলহাজ্ব এম এ করিমের এক ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে সবার বড় তিনি। ভাই-বোনের মধ্যে তিনিই একমাত্র জীবিত আছেন। ৬০-এর দশকের প্রথমদিকে তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করে রাজবাড়িতে ফিরে চার বছর গ্রামের মানুষকে চিকিৎসা সেবা প্রদান করেন। ১৯৬৫ সালে উচ্চ শিক্ষার্থে লন্ডনে পাড়ি জমান তিনি। সেখানে অধ্যয়নকালে এমআরসিপি, এফআরসিপিসহ বিভিন্ন ডিগ্রী অর্জন করেন এবং সেখানে বার্নস্লে ডিস্ট্রিট জেনারেল হাসপাতালে রিওম্যাটোলজিস্ট (বাথজ্বর) কনসালটেন্ট পদে ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত চাকরি করে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন তিনি।তিনি জানান, প্রবাসে জীবনের অধিকাংশ সময় কাটলেও জন্মভূমিকে তিনি কখনও ভুলেননি। এদেশের মানুষের জন্য কিছু করতে সব সময় মন ব্যাকুল থাকতো। আর তাইতো প্রায় প্রতিবছরই দেশে আসতেন। ভবদিয়া গ্রামের বাড়িতে বাবার নামে এম এ করিম উচ্চ বিদ্যালয় ও এতিমখানা স্থাপনের মাধ্যমে কার্যক্রম শুরু করেন তিনি। পরবর্তীতে রাজবাড়ি শহরে ডা. আবুল হোসেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ করেন। সেখানে বর্তমানে ৮টি বিষয়ে অনার্সসহ ডিগ্রী ও উচ্চমাধ্যমিকে তিন হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী পড়াশুনা করছে। শিক্ষকের সংখ্যাও ৬০ জনেরও বেশি। ডা. মো. আবুল হোসেন জানান, ব্যক্তিগত উদ্যোগে ভবদিয়া গ্রামের বাড়িতে নিজস্ব সম্পত্তিতে একটি জাদুঘর নির্মাণ করেছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের সময় কেনা প্রায় পাঁচ শতাধিক আইটেম স্থান পেয়েছে জাদুঘরটিতে। এছাড়াও দেশ বিদেশের কবি, সাহিত্যিক, রাজা-রাণী, রাজনীতিবিদ, গ্রামীণ ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সবই পরিচিতিসহ ঠাঁই পেয়েছে এ জাদুঘরে। ব্যক্তিগত পর্যায়ের এ জাদুঘরটিতে ৫ টাকায় নামমাত্র মূল্যে টিকেট কেটে প্রতিদিন শতাধিক দর্শক আসেন। পৈত্রিক নিবাস ভবদিয়া ও রাজবাড়িতে তার ব্যক্তিগত উদ্যোগে এম এ করিম উচ্চ বিদ্যালয়, এম এ করিম শিশু সদন ও এবতেদায়ি মাদ্রাসা, দাবা ক্লাব, আবুল হোসেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, আবুল হোসেন ফুটবল একাডেমি, আবুল হোসেন ক্লাব অ্যান্ড কমিউনিটি সেন্টার, নুরজাহান প্রাইমারি স্কুল ইত্যাদি গড়ে তুলেছেন তিনি। ডা. আবুল হোসেনের আত্মীয় সাবেক জেলা ও দায়রা জজ মো. শামসুল হক জানান, এমন নিঃস্বার্থ মানুষ সমাজে খুব একটা দেখা যায় না। গত ৩ জানুয়ারি তিনি (ডা. আবুল হোসেন)  ট্রাষ্ট গঠন করে সব সহায় সম্পত্তি দান করে দিয়েছেন। দেশের সব সম্পত্তি দান করার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ডা. আবুল হোসেন বলেন, বয়স হয়েছে। ক`দিন পর মারা যাবো। এ ধনসম্পত্তি সাধারণ মানুষের কাজে লাগলে মরেও শান্তি পাবো। দুই ছেলে লন্ডনেই থাকবে বলে মনস্থির করেছে। তাই সব সম্পত্তি দান করে দিলাম। অর্ধশতাব্দি বিলেতে প্রবাসজীবন কাটালেও অন্তিম ইচ্ছে মৃত্যুর পর তাকে যেন গ্রামে বাবা-মায়ের পাশে সমাহিত করা হয়। তিনি বলেন, ছেলেদের বলে রেখেছি লন্ডনে মারা গেলে যেন লাশটি দেশে পাঠানো হয়। বাবা-মায়ের কবরের পাশে সমাহিত হলে শান্তি পাবো।দেশের সব সহায় সম্পত্তি দান করে দিয়ে নিঃস্ব হলেও সন্তুষ্টচিত্তে প্রচারবিমুখ এ দানবীর আগামীকাল (শনিবার) লন্ডনে ফিরে যাবেন বলে জানান।এমইউ/আরএস/পিআর

Advertisement