মতামত

কওমি শিক্ষাব্যবস্থা পরিবর্তন প্রয়োজন

কওমি মাদরাসায় শিক্ষা নিচ্ছে দেশের প্রায় ২০ লাখ শিক্ষার্থী। ১৯ হাজার ২০০ প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাগ্রহণকারী ভবিষ্যৎ এই নাগরিকদের সম্পর্কে আমাদের ভাবনা কি? তারা কি দেশের বোঝা হবে নাকি শক্তি হবে? বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে কেউ ভাবছে বলে মনে হয় না। শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরে বিশাল সংখ্যক তরুণের ভবিষ্যৎ বিবেচনায় কওমি শিক্ষা কার্যক্রমকে আধুনিকায়নের দাবি জানিয়ে আসছেন। বিশিষ্টজনরা কওমি শিক্ষাব্যবস্থাকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনার কথাও বলছেন। কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলেও তার কার্যকারিতা নেই। কেন নেই, সেই বিষয়টিও ফাইলচাপা প্রকল্পের মতো।

Advertisement

বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থীর জীবনযাপন ও নাগরিক সুবিধার কথা চিন্তা করে সরকার দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের সমতুল্য মর্যাদা দিয়ে প্রশংসা যেমন পেয়েছে আবার সমালোচনার মুখেও কম পড়েনি। এই সনদে শিক্ষার্থীদের জীবনের কী পরিবর্তন আসবে সেদিকটি চিন্তা না করেই কওমি মাদরাসা শিক্ষার্থীরাও প্রশংসা করেছেন। বাস্তবতা হচ্ছে-সনদ লাভের কারণে শিক্ষার্থীদের তেমন একটা লাভ হয়নি।

কওমি পদ্ধতির মাদরাসা থেকে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের একটি সামান্য অংশ সরকারি মডেল মসজিদ, নতুন করে প্রতিষ্ঠিত কওমি মাদরাসায় চাকরি লাভ করেছে। কিন্তু উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের তুলনায় চাকরি লাভকারীর সংখ্যা হিসাব করলে সুফল বিষয়ে ধারণা পাওয়া যেতে পারে। ২০১৫ সালের পর প্রায় ৬ হাজার মাদরাসা নতুন করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দেশে।মাদরাসাগুলো থেকে প্রতি বছর গড়ে ২০ হাজার শিক্ষার্থী শিক্ষা লাভ করে বের হয়।

এমন হিসাবে ছয় বছরে অন্তত ১ লাখ ২০ হাজার শিক্ষার্থী বেরিয়েছে এখান থেকে। ৬০ হাজারও যদি মাদরাসায় কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়ে থাকে তাহলে আরও ৬০ হাজার থাকে মাদরাসার চাকরির বাইরে। এর মধ্যে কয়েকশ সুযোগ পেয়েছে মডেল মসজিদে। হয়তো আরও হাজার দু’য়েক পেয়েছে নতুন মসজিদের ইমামতি ও মুয়াজ্জিন হিসেবে। তারপরও অর্ধলাখ শিক্ষার্থী থেকে যায়। তাদের অবস্থা কি?

Advertisement

যে কোনো মাদরাসার শিক্ষক কিংবা শিক্ষার্থীকে প্রশ্ন করলে প্রায় একই জবাব পাওয়া যাবে। তারা বলবেন, কেউ বেকার নেই। তারা কি করছেন? জবাব আসবে অনুমানভিত্তিক। কারণ তাদের ব্যাপারে কোনো জরিপ চালানো হয়নি। সরকার কিংবা মাদরাসা শিক্ষাসংশ্লিষ্ট কারও কাছেই সঠিক তথ্য পাওয়া যাবে না। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাওলানা হুসাইনুল বান্নাকে প্রশ্ন করলে তিনিও প্রথমে বলেন, পাস করা শিক্ষার্থীরা কেউ বেকার নেই। বেকার থাকে না।

কি কাজে নিয়োজিত হয়েছেন তারা? হ্যাঁ, বিভিন্ন পেশায় যুক্ত হয়েছেন। কেউ ক্ষুদ্র ব্যবসা, কেউ হয়তো কায়িক শ্রমের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ গ্রহণ করেছেন অনেকেই। এই বিবিধ পেশার খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, তাদের কেউ হয়তো অনলাইন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পণ্যবাহক হিসেবে কাজ করছেন, কেউ হয়তো খাঁটি সরিষার তেল কিংবা খাঁটি মধু বিক্রির সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন, কেউ সিএনজিচালক কিংবা এমন পেশার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। আপাতদৃষ্টিতে তাদের কর্মসংস্থানে সন্তুষ্টি লাভ করলেও প্রশ্ন আসে, দীর্ঘ সময় শিক্ষাকাল অতিবাহিত করার পর ফলপ্রাপ্তিটা আশানুরূপ কি না।

১২ বছর শিক্ষা লাভ করে যদি একজন তরুণ অনলাইন ব্যবসার খাবার সরবরাহকারী হিসেবে কাজ করেন তাহলে শিক্ষাকালটা তার অপচয় হিসেবে গণ্য হবে কি না। আলিয়া মাদরাসা শিক্ষায় শিক্ষিত একটা ছেলে এইচএসসি সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধাতালিকায় স্থান পেয়ে ভর্তি হতে পারে, সেখানে কওমি মাদরাসায় ১২ বছর শিক্ষা লাভ করে তাকে খাবার সরবরাহকারীর চাকরি নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়।

অন্যদিকে একই চাকরি পাচ্ছে স্কুলে পঞ্চম কিংবা অষ্টম শ্রেণি উত্তীর্ণ শিক্ষার্থী। কিংবা আলিয়া মাদরাসা থেকেও অষ্টম শ্রেণির সমমর্যাদার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া শিক্ষার্থী। তাহলে এই কর্মীর জীবন থেকে যে কয়টা বছর অপচয় হলো তা কি জাতীয় খাতে ক্ষতির কারণ হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে না?

Advertisement

ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি জীবিকার জন্য শিক্ষাটাও জরুরি। না হলে উচ্চ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও নিন্মপদে নিজেকে যুক্ত করতে হবে। এতে ব্যক্তির অর্জন যেমন কম হয় তেমনি জাতীয় উৎপাদনশীলতায়ও কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা রাখতে পারে না। তা শুধু ওই একজন ব্যক্তির পিছিয়ে যাওয়াই নয়, জাতীয় সমৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে।

এসব বিষয় মোটামুটি সবাই জানেন। সংশ্লিষ্টরাও কম বেশি স্বীকার করেন। সরকারও চায় বিশাল জনগোষ্ঠীকে মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত করে, সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অংশীদার করতে। সম্ভবত বছর দশেক আগে ধর্মীয় নেতারা একটি উদ্যোগও নিয়েছিলেন। যতটা মনে আসে মাওলানা আহমদ শফী এবং মাওলানা ফরিদ উদ্দীন মসউদ এ বিষয়ে সরকারি পর্যায়ে আলোচনা-পর্যালোচনা এবং মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থাকে উন্নত করার বিষয়ে উদ্যোগও নিয়েছিলেন।

সেই উদ্দেশে গঠিত আল হাইআতুল উলয়া লিল জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশ এখনও কার্যকর। কিন্তু পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ ছাড়া শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ তথা কারিকুলাম সংস্কার বিষয়ে তাদের কোনো ভূমিকা লক্ষ্য করা যায় না। শুধু তাই নয়, সর্বোচ্চ এই প্রতিষ্ঠান থেকে সংশোধন-সংস্কার পরিকল্পনাকে অনেকটা অবহেলা করা হয় বলেও সংশ্লিষ্টদের কেউ কেউ অভিযোগ করছেন, যা স্পষ্ট করে দেয়-সংশ্লিষ্টদের মধ্যে নীতিগতভাবে পরস্পরবিরোধী অবস্থানকে। বিভেদ ও মতানৈক্য থাকায় এ উদ্যোগের উদ্দেশ্যও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে।

ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি জীবনমুখী সিলেবাস বিষয়ে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। যতটা জানি ইসলামী নেতাদের একটি গ্রুপ সরাসরি তা প্রত্যাখ্যান করে। আরেকটি গ্রুপ গ্রহণে সম্মত হয়। কিন্তু বিভাজন তৈরি হওয়ায় কোনোটাই এগিয়ে যেতে পারেনি। আমার মনে হয়, এই মুহূর্তে যেসব মাদরাসা যুগের উপযোগী কারিকুলাম গ্রহণ করতে চায় তাদের নিয়েই সরকারের উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত।

আমি মনে করি এটা শুরু হলে সরকার নিয়ন্ত্রিত এবং কারিকুলাম সংস্কার হওয়া মাদরাসাগুলোর অনুকরণে বাকিরাও পরিবর্তিত কারিকুলাম গ্রহণে উৎসাহী হবে। এতে রাজনৈতিক সুফল কতটা এই মুহূর্তেই পাওয়া যাবে, সেটা বিবেচ্য নয়। অন্তত দেশের নাগরিকদের বড় একটি অংশ অন্তত ধর্ম ও আধুনিক জীবনব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত হতে পারবে। তাই এ মুহূর্তে সরকারি উদ্যোগ হওয়া প্রয়োজন-যারা কারিকুলাম সংস্কারে বিশ্বাসী তাদের নিয়ে কাজ শুরু করাই হচ্ছে উত্তম।

প্রচলিত কারিকুলামকে আঁকড়ে ধরার পেছনে ইসলামি চিন্তাবিদদের মত হচ্ছে- কওমি শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা যায় না। এটা গর্হিত কাজ। কিন্তু তাদের এই ভাবনার যৌক্তিকতা অবশ্যই প্রশ্নবোধক। তারা যদি খেয়াল করেন দেখতে পাবেন, তাদের প্রিয় শিক্ষার্থীরা মাস্টার ডিগ্রির সমতুল্য স্বীকৃতি পাওয়ার পরও সেই সুবিধাটা পাচ্ছে না। যার পরিণতিতে বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থী শিক্ষাকালের হিসেবে নিম্নপদে কর্মসংস্থানে যুক্ত হচ্ছে। তাদের কর্মসংস্থানের প্রধান ক্ষেত্র হচ্ছে মাদরাসা ও মসজিদ।

অধিক সংখ্যক শিক্ষার্থী বের হওয়ার পর তারা মসজিদ ও মাদরাসায় চাকরি তল্লাশি করতে থাকে। কিন্তু পুরোনোগুলোতে নতুন করে পদ সৃষ্টি হচ্ছে না। তাই তাদের নতুন মাদরাসা ও মসজিদ প্রতিষ্ঠা করতে হচ্ছে নিজেদের কর্মসংস্থানের প্রয়োজনে।

নতুন মাদরাসা ও নতুন মসজিদ হওয়ায় সমাজের একটি অংশ আবেগে সন্তোষ প্রকাশ করছে। কিন্তু এরপর কী করা হবে সেই বিষয়ে তাদের মাথায় নেই। হতে হতে যদি দুই বাড়ির মধ্যে একটি মসজিদ হয়ে যায়, তারপর কী হবে? একটি গ্রামে একটি মাদরাসা যথেষ্ট হলেও সেখানে হয়ে গেছে একাধিক। তারপর কী হবে? মসজিদ ও মাদরাসা হওয়ারও মাত্রা আছে। প্রয়োজনীয়তার প্রসঙ্গ আছে।

উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ নিয়োজিত হচ্ছে ওয়াজ এর সঙ্গে। তারা ইউটিউবে ওয়াজ প্রকাশ করছে। কর্তৃপক্ষীয় পরিবেশিত বিজ্ঞাপন প্রচার হচ্ছে ওয়াজের মধ্যে। এমনও দেখা যায় বিজ্ঞাপনের মডেলের যে পোশাক থাকে সেগুলোও ইসলামি বিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। অন্যদিকে তারা তাদের গুরুজনদের কাছ থেকেই শিখছে, টাকা রোজগার কারও কিন্তু রাষ্ট্রকে কর দেওয়ার প্রয়োজন নেই। দেয় বলেও জানি না।

সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক হচ্ছে-লাইক-ভিউ পাওয়ার জন্য কোনো কোনো বক্তা ওয়াজের নামে অশালীন মন্তব্যও সম্প্রচার করেন, যা ইসলামের মূল বৈশিষ্ট্যের সম্পূর্ণ বিপরীত। এ নিয়ে ইসলামি বিশিষ্টজনই বিরক্ত বোধ করেন। অশালীন অঙ্গভঙ্গি, অশালীন ভাষা প্রয়োগই শুধু নয় কিছু ওয়াজে এমন ভাষা প্রয়োগও হয়, যা সাধারণত লোকসমাজে পরিত্যাজ্যও।

মোটা দাগে বলতে গেলে-এ কাজগুলো হচ্ছে দর্শকপ্রিয় হওয়ার জন্য। যাকে আমরা সহজেই পুণ্যের কাজ হিসেবে গণ্য করতে পারি না। সেগুলো করছে মূলত আর্থিক প্রতিযোগিতায় নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য। বলতে দ্বিধা নেই রোজগারের জন্য এটিই তার জানা পথ। এখানেও মূল বিষয় শিক্ষাব্যবস্থায় জীবনমুখী কারিকুলামের অভাব।

সম্প্রতি সরকার কওমি মাদরাসা শিক্ষা কারিকুলাম বিষয়ে ভাবছে বলে সংবাদ পাওয়া গেছে। শুধু তাই নয় মাদরাসাগুলোকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনার বিষয়েও পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। একটি দেশের ভিতরে হাজার হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দেশের নিয়ন্ত্রণে থাকবে না এটা ভাবা যায় না। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে কওমি মাদরাসাগুলো দাননির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসতে চায় না।

আমি মনে করি প্রথম দফায় যদি ৫০০ মাদরাসাকেও নিয়ন্ত্রণে আনার উদ্যোগ নেয়া হয়, যদি তাদের কারিকুলাম আধুনিক করা হয়, তাদের পরিচালনায় সরকারের নীতিমালা কার্যকর হয় তাহলে দ্রুত অন্যরাও সুযোগ গ্রহণে আগ্রহী হবে। এটা প্রমাণিত সব কওমি মাদরাসাকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা সফল হবে না। তাই যারা সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসতে চায় তাদের বঞ্চিত না করে জীবনমুখী ও ধর্মীয় শিক্ষাব্যবস্থা চালু করে নেয়া জরুরি। এতে বিশাল সংখ্যক তরুণ মূলধারায় সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ পাবে।

লেখক : সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।

এইচআর/এএসএম