মতামত

দুর্নীতিবাজরা তওবা করেছে কি?

পৃথিবীতে দুর্নীতিমুক্ত কোনো দেশ নেই। সব দেশেই দুর্নীতি আছে। আবার দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযানও আছে। বিরামহীন প্রচেষ্টার ফলে অনেক দেশই দুর্নীতি হ্রাস করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু আমাদের অবস্থান একই রয়েছে। কিছুটা পরিবর্তন হলেও আমূল কোনো পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না।

Advertisement

গত ২৫ জানুয়ারি দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) ‘দুর্নীতির ধারণা সূচক ২০২১’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) ২০২১ সালে দুর্নীতির যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সেখানে বাংলাদেশের স্কোর ২৬। তিন বছর ধরে আমাদের স্কোর ২৬ এ অপরিবর্তিত রয়েছে। ১৮০টি দেশের মধ্যে এবার আমাদের অবস্থান ১৪৭তম। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের নিচে শুধু আফগানিস্তানের অবস্থাই নাজুক। তবে নিচের দিক থেকে আমাদের অবস্থান ১৩তম। মানে ১২টি দেশের চেয়ে আমাদের অবস্থান ভালো।

দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে নিঃসন্দেহে উন্নত দেশগুলো এগিয়ে আছে। উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের তুলনা না করলেও কেন আমরা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর পেছনে পড়ে থাকবো সেটা বোধগম্য নয়। ভুটান, ভারত, মালদ্বীপ এমনকি পাকিস্তানও আমাদের চেয়ে এগিয়ে আছে।

গণমাধ্যমগুলোতে প্রায়শই দুর্নীতির খবর প্রকাশ হয়। সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে দুর্নীতি ও অনিয়মের খতিয়ান দিনকে দিন দীর্ঘ হচ্ছে। বালিশকাণ্ড থেকে শুরু করে বেগমপাড়া সবই দুর্নীতিজাত আলোচ্য বিষয়। সর্বোত্র বিস্তৃত দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রকে কদাচিৎ পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়। আগে রাঘববোয়ালরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকতো। এখন চুনোপুঁটিদেরও ধরা যায় না।

Advertisement

মাঝে মাঝে নামকাওয়াস্তে দুদক কারও সম্পদের হিসাব তলব করে। কিন্তু দুর্নীতি দমনে দুদকের কোনো কার্যকর ভূমিকা দেখা যায় না। উপরন্তু দুদকের কর্মচারী-কর্মকর্তাদেরও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার খবর পাওয়া যায়। দুদকের দায়েরকৃত মামলার কোনো অগ্রগতি দেখা যায় না। সুষ্ঠু তদন্তের অভাবে অনেক মামলাই আলোর মুখ দেখে না। পাশাপাশি দুদক স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে কি না সেটাও একটা প্রশ্ন। একজন সরকারি কর্মকর্তাকে ধরতে হলে দুদককে ওই কর্মকর্তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হয়। এছাড়া দুদকের কাজের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও নিরপেক্ষতা প্রশ্নাতীত নয়।

সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করার দাবি করছে। কিন্তু বাস্তবে সে রকম কার্যক্রম চোখে পড়ে না। সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অভিযান এখন মুখ থুবড়ে পড়েছে। আগের বিএনপি সরকার কতবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে সেটিই বড় কথা। অথচ সরকার ও প্রশাসনে দুর্নীতির বিস্তার তথা রাষ্ট্রের সর্বস্তরে বিরাজমান দুর্নীতি প্রতিরোধে সরকারের দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ দেখা যায় না। তার বিপরীতে ক্ষমতার যোগসাজশে দুর্নীতিবাজরা আরও বেপরোয়া।

টিআইবির দুর্নীতির প্রতিবেদন প্রকাশের একদিন পরে (২৬ ডিসেম্বর) সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ‘বাংলাদেশ ব্যবসায় পরিবেশ ২০২১; উদ্যোক্তা জরিপের ফলাফল’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে প্রকাশ করে। সে প্রতিবেদন বলছে, ব্যবসায়ীদের অধিকাংশই মনে করেন, দেশে ব্যবসা উন্নয়নের পথে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে দুর্নীতি। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যবসাক্ষেত্রে তিনটি প্রধান প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে- দুর্নীতি, অদক্ষ প্রশাসন এবং অর্থায়নে সীমাবদ্ধতা। কাজেই সিপিডির ওই প্রতিবেদনও টিআইবির প্রতিবেদনের সত্যতাই প্রমাণ করে।

টিআইবি ও সিপিডি প্রতিবেদনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে অতীতের সব সরকারই প্রশ্ন তুলেছে এবং অতীতের সব বিরোধী দলই সরকারের সমালোচনার অস্ত্র হিসেবে ওইসব প্রতিবেদনকে ব্যবহার করেছে। বর্তমান সরকার ও বিরোধী দলও তাই করছে। এসব প্রতিবেদনের তথ্য-উপাত্ত বা গবেষণা পদ্ধতি-প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলাই যেতে পারে। কিন্তু তাতে এসব প্রতিবেদনের গ্রহণযোগ্যতা পুরোপুরি রহিত হয়ে যায় না। পরিসংখ্যানের হেরফের কিছুটা হলেও হতে পারে, কিন্তু বাস্তবতা উল্টে যায় না।

Advertisement

দেশের ৬৮ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করেন, ব্যবসা উন্নয়নের পথে প্রধান বাধা হচ্ছে দুর্নীতি। যদি ৫০ শতাংশ ব্যবসায়ীও মনে করেন যে দুর্নীতিই প্রধান বাধা সেটাও কি যথেষ্ট হতাশাজনক নয়? কাজেই রাজনৈতিক সমালোচনার বাইরে গিয়ে এসব প্রতিবেদনের মর্মার্থ আমাদের উপলব্ধি করতে হবে।

দেশের দুর্নীতির একটি বড় ক্ষেত্র হচ্ছে আমলাতন্ত্র। ব্যবসা করতে গেলে আমলাতন্ত্রের পথ ধরেই করতে হয়। আমলাতন্ত্র ব্যবসায়িক অগ্রগতির পথে একটি বড় বাধা। আমলাতন্ত্র নিয়ে কিছুদিন আগে সংসদেও আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। সংসদের বাইরেও এ নিয়ে কথা হচ্ছে। কিছুদিন আগে ডিসি সম্মেলনে প্রশাসকরা আরও ক্ষমতা দাবি করেছেন। দেশের রাজনীতি যখন শক্তিহীন হয়ে পড়ে তখন আমলাতন্ত্র শক্তিশালী হয়। প্রশাসনের সর্বস্তরে জবাবদিহিতার অভাবে আমলাতন্ত্র আজ জেঁকে বসে।

এক এমপি দাবি করেছেন, ‘এমপি হিসেবে একজন সচিবের কাছে গেলে তারা যেভাবে শ্রদ্ধা করবেন, সেই শ্রদ্ধাবোধ নেই। পিয়ন পর্যন্ত আমাদের দাম দেয় না। স্যারডা না বইলা পারে না। আমলাতন্ত্রের হাতে আমরা জিম্মি হয়ে গেছি।’ অথচ গণতন্ত্রে জনপ্রতিনিধিদের সম্মান সবার ওপরে। কেন এমন হলো এ প্রশ্নের জবাব খুঁজে বের করতে হবে এমপি সাহেবদেরই।

জবাবদিহিতার অভাবে দুর্নীতি আরও বেড়ে যায়। দেশে এখন সে অবস্থাই চলছে। দেশের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও দুর্নীতি নিয়ে আগেও গবেষণা-জরিপ হয়েছে। কিন্তু অবস্থার উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন হয়নি। মাঝে মাঝে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। এক সময় ব্যবসার সুবিধার জন্য ওয়ান স্টপ সার্ভিসের সূচনা হয়েছিল। কিন্তু তা বেশি দিন টেকেনি।

দেশে দুর্নীতি নতুন কিছু নয়। ঔপনিবেশিক আমল থেকেই এদেশে দুর্নীতি ছিল। পাকিস্তান আমলের দুর্নীতির ধারাবাহিকতাই স্বাধীন বাংলাদেশে বিস্তার লাভ করেছে। স্বাধীনতার পর থেকে বঙ্গবন্ধু বহু ভাষণে দুর্নীতি নিয়ে কথা বলেছেন। পাকিস্তান-উত্তর চোরের দল ও চাটার দলের উত্তরাধিকারীরাই আজ স্বাধীন দেশে দুর্নীতি করে বেড়াচ্ছে। বঙ্গবন্ধু ওদের বহুবার ভালো হয়ে যাওয়ার উপদেশ দিয়েছেন। কাজ হয়নি।

ঘুস ও স্বজনপ্রীতি যখন সবকিছু গ্রাস করছিল, তখন প্রশাসনের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু একবার বলেছিলেন, আমি বিশ্বাস করি, ‘শুধু নিজেরা ঘুস খাওয়াই করাপশন নয়। এ সম্পর্কে আমার কথা হলো করাপ্ট পিপলকে সাহায্য করাও করাপশন। নেপোটিজমও কিন্তু এ টাইপ অব করাপশন। স্বজনপ্রীতিও করাপশন। আপনারা এসব বন্ধ করুন। কোনো ভয় নেই, কোনো ভয় নেই। কারও ভয় নেই। আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করবেন না। আমিও আপনাদের সঙ্গে আছি।’

বঙ্গবন্ধু আজীবন দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রেখেছিলেন। স্বাধীনতার পরে গত ৫০ বছরে আমরা এগিয়েছি অনেক সন্দেহ নেই। উন্নয়ন হয়েছে, অর্থনীতিও বড় হয়েছে। কিন্তু দুর্নীতির ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান আগের মতোই আছে। তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। অর্থনৈতিক দুর্নীতির পাশাপাশি দেশে এখন সেই নেপোটিজন ও স্বজনপ্রীতি রয়ে গেছে, বরং আগের চেয়ে আরও বেড়েছে।

বঙ্গবন্ধু সবাইকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি প্রতিরোধকারীদের পাশে দাঁড়াবেন বলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তার সে আহ্বান আজও প্রাসঙ্গিক, দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিরামহীন অভিযান আজও জরুরি। ক্যাসিনো অভিযানের মতো কয়েকটি শোডাউন করে দুর্নীতি প্রতিরোধ করা যাবে না। দুর্নীতি প্রতিরোধে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত জরুরি।

সন্দেহ নেই, দুর্নীতিবাজরা আগের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। তাদের শক্তির উৎস অনেক গভীরে প্রোথিত। কিন্তু তারা যতোই শক্তিশালী হোক না কেন, সবার ঐক্যবদ্ধ অংশগ্রহণে দুর্নীতিবাজরা নির্মূল হবেই। রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ও ঐক্য ছাড়া সেটি সম্ভব নয়। দুর্নীতি দমন করা না গেলে প্যারাডাইস পেপার্স ও পানামা পেপার্সে আমাদের নাম আসতেই থাকব, সুইস ব্যাংকে আমানতকারীদের তালিকা দীর্ঘ হতেই থাকবে।

১৯৭৫ সালের ২১ জুলাই নবনিযুক্ত জেলা গভর্নরদের এক প্রশিক্ষণ কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দুর্নীতি প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আজ আমার কাছে আপনারা তওবা করে যান যে স্বজনপ্রীতি করবেন না। ঘুসখোরদের সাহায্য করবেন না।’ বঙ্গবন্ধুর সে আহ্বান তারা সেদিনও শোনেননি। ঘুসখোর ও দুর্নীতিবাজরা সেদিনও তওবা করেননি, আজও তওবা করেননি। হয়তো করবেনও না কোনো দিন। তাই রাষ্ট্রকেই এগিয়ে আসতে হবে তাদের প্রতিরোধ করতে।

লেখক: আইনজীবী ও কলাম লেখক।

এইচআর/ফারুক/জিকেএস